সি রা জু র র হ মা ন
তারিখটা স্মরণ করতে অনুরোধ করছি সুহৃদ পাঠকদের। সে তারিখ ছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিয়েছে। এর মধ্যে চমত্কারিত্ব কিছু ছিল না। চমত্কারিত্ব (তাঁর নিজের কথায় চমক) দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা তারপর। সরকারের বিদায়ের মুহূর্ত থেকে দেশ অচল করে দেয়ার আয়োজন করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ আগে থেকেই। লগি-লাঠি-বৈঠা যার যা আছে তা নিয়েই রাজধানীতে আসার ডাক দিলেন শেখ হাসিনা দলীয় কর্মীদের (এবং হাজার হাজার ভাড়াটে লোককে)। একটি বড় এনজিও কয়েকশ’ বাস ভাড়া করে দিয়েছিল ভাড়া করা মানুষগুলোকে রাজধানীতে নিয়ে আসার জন্য।
উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার ছিল রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। তাদের উর্বর মস্তিষ্ক হিসাব করে বের করল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হলে তাদের নির্বাচনী বিজয় সহজ হবে। দুটি কাজ তখন তারা করেছিল। জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্র করল তারা, আর নানা প্রলোভনে ফেলে জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রাজি করালো। জামায়াতে ইসলামী নেতাদের তখন যুদ্ধাপরাধী বলে মনে হয়নি শেখ হাসিনার। এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযমকেও না। কেননা তিনি মতিউর রহমান নিজামীর পাশে বসে আন্দোলনের কলাকৌশল স্থির করেছিলেন এবং সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনের আগে ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে এসেছিলেন।
কয়েকজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তার সতর্কতার ফলে জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, হরতাল, নাশকতা আর সন্ত্রাসের দরুন দেশ ও অর্থনীতি অচল হয়ে গেল, বহু লোক হতাহত হলো। অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়া প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিলেন। অতিদ্রুত সংসদে সংবিধান সংশোধন করে (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সে পদ্ধতি অনুসারে সাধারণ নির্বাচন ডাকলেন।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক বৃহত্তম দল হলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। আবারও জামায়াতে ইসলামীর শরণাপন্ন হতে হলো শেখ হাসিনাকে। জামায়াত দলীয় সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করলেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সত্ কিংবা সাধু ছিল না। সরকার গঠনের ফলে সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলো পেল আওয়ামী লীগ। তখন আর জামায়াতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ছেঁড়া জুতোর মতো জামায়াতকে ছুড়ে ফেলে দিলেন শেখ হাসিনা। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আবার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু মোনাফেকি আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ নয়। ২০০১ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনও হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সদ্যসাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং ১৯৯০ সালে সর্বদল স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। জনসমর্থন না থাকলে নির্বাচনে পরাজয় হবেই, সেজন্য পদ্ধতিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই—এ ব্যাপারটা শেখ হাসিনা কখনোই স্বীকার করেন না। দুই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে (সাহাবুদ্দীন আহমদ ও লতিফুর রহমান) তিনি যে অশ্লীল ও অশোভন ভাষায় গালাগালি করেন, অন্য কোনো দেশের কোনো প্রথম শ্রেণীর নেতা তেমন ভাষা ব্যবহার করেছেন বলে আমার জানা নেই। কথায় বলে, নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। শেখ হাসিনার স্বভাব ঠিক সে রকমের। এবার তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ওপর (যে পদ্ধতি ছিল তাঁরই আন্দোলনের ফসল) বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন। মনে মনে স্থির করলেন, তাঁর নিজের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করে নিজের ও নিজ দলের বিজয় সুনিশ্চিত করবেন।
দুই ডজন হত্যা, রাষ্ট্রপতিকে বন্দী
দু’হাজার আট সালের ডিসেম্বরে ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে’ একটা মাস্টার প্ল্যানের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সে ব্যবস্থাই তিনি করেছেন। কিন্তু তার জন্যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-লাঠি-বৈঠার হরতালের প্রয়োজন হয়েছিল। হাসিনার ভাড়া করা পেশিশক্তি রাজধানীর রাজপথে লগি, লাঠি ও বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে প্রায় দুই ডজন মানুষকে হত্যা করেছিল। লাগাতার হরতালে দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। সব প্রধান সড়ক ও বন্দর অবরুদ্ধ হয়, রেলপথের লোহার রেললাইন তুলে নেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতির সরকারি নিবাস বঙ্গভবন অবরোধ করে টেলিফোন, বিদ্যুত্ ও পানির সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রপতিকে কার্যত গৃহবন্দী করে ফেলা হয়। একটি পত্রিকাগোষ্ঠী ও দুই রাষ্ট্রদূতের সমর্থনে এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সক্রিয় ভূমিকায় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে বাধ্য করা হয় (যেমন করে লে. জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে পিস্তল উঁচিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন)।
এখন আর কেউই অস্বীকার করেন না যে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (এক-এগারো) বঙ্গভবনে যে নাটকের অভিনয় হয়েছিল, শেখ হাসিনা আগে থাকতেই সেটা জানতেন; কেননা ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটিনেসের সঙ্গে কয়েক মাস আগে থাকতেই তাঁর নিয়মিত শলাপরামর্শ চলছিল। ফখরুদ্দীন আহমদের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকার ছিল, সে সম্পর্কেও এখন কারও সন্দেহ নেই।
তৃতীয় সন্দেহাতীত ব্যাপার এই যে, সে সরকার যখন খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করে রেখেছিল, তখন চিকিত্সার অছিলায় শেখ হাসিনাকে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ড সফর করে সেসব দেশে রাজনৈতিক সভাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিক ও পত্রিকা পাঠকদের অবশ্যই মনে থাকার কথা যে, ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল সে সফরে যাত্রার আগে বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার তাঁর আন্দোলনের ফসল এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের গোটা ইতিহাস ইতোমধ্যেই বিকৃত করে ফেলেছে। শুনেছি, আমাদের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকেও বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু ২০০৬-০৭ সাল খুব বেশিদিনের কথা নয়। সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে কিন্তু এতো দুর্বল নয় যে, পাঁচ-ছয় বছরের আগের এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সত্যতাও তারা ভুলে যাবে। তবু শেখ হাসিনা এই সদ্যসাবেক ইতিহাসও বিকৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন গত শুক্রবার তাঁর টেলি-ভাষণে। এ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলার চেষ্টা করেছেন যে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে এক-এগারো পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির কারুকার্য করেছিল বিএনপি। তিনি বলেছেন, মাইনাস-টু প্রবর্তকরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ইতিহাস অবশ্যই কথা কয়
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন যা বলেন, তার সবকিছু সত্য হয় না। সত্যকেও প্রায়ই তিনি বিকৃত করেন, অন্তত বাঁকা করে বলেন। শুক্রবারের ভাষণে তিনি আবারও আওয়ামী লীগকে গদিতে ফিরিয়ে আনার আবেদন করেছেন দেশবাসীর কাছে। কিন্তু দেশবাসী জানে, শেখ হাসিনার অধীনে ও ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হলেও জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তবু তারা জানে যে, জনসাধারণের ভোট উপেক্ষা করে আবারও একটি মাস্টার প্ল্যানের নির্বাচনে গদি পাওয়াই হচ্ছে শেখ হাসিনার মতলব। সেজন্যই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনসাধারণ তাতে ভোট দেবে না। বস্তুত এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দিতেই তারা নারাজ। সেজন্যই বিএনপির এবং ১৮ দলের জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার পেছনে কাতারবন্দী হয়ে তারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে।
আরও একটি নির্বাচনের আগে আগে শেখ হাসিনার আরেকটি টেলি-ভাষণ ঢাকায় বসেই আমি শুনেছিলাম। পুরো ৪৫ মিনিট ধরে তিনি সত্য ও ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন, শহীদ জিয়াউর রহমান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ও অশ্লীল গালিগালাজ করেছেন। সে ভাষণের রাতেই আওয়ামী লীগের পুরাতন সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, শেখ হাসিনার ভাষণ শোনার পর আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার প্রবৃত্তি তাদের হবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে বড় রকমে পরাজিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার গত শুক্রবারের ভাষণেও উল্টো ফল ফলতে পারে বলে আমার ধারণা।
serajurrahaman34@gmail.com
উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার ছিল রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। তাদের উর্বর মস্তিষ্ক হিসাব করে বের করল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হলে তাদের নির্বাচনী বিজয় সহজ হবে। দুটি কাজ তখন তারা করেছিল। জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্র করল তারা, আর নানা প্রলোভনে ফেলে জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রাজি করালো। জামায়াতে ইসলামী নেতাদের তখন যুদ্ধাপরাধী বলে মনে হয়নি শেখ হাসিনার। এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযমকেও না। কেননা তিনি মতিউর রহমান নিজামীর পাশে বসে আন্দোলনের কলাকৌশল স্থির করেছিলেন এবং সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনের আগে ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে এসেছিলেন।
কয়েকজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তার সতর্কতার ফলে জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, হরতাল, নাশকতা আর সন্ত্রাসের দরুন দেশ ও অর্থনীতি অচল হয়ে গেল, বহু লোক হতাহত হলো। অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়া প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিলেন। অতিদ্রুত সংসদে সংবিধান সংশোধন করে (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সে পদ্ধতি অনুসারে সাধারণ নির্বাচন ডাকলেন।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক বৃহত্তম দল হলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। আবারও জামায়াতে ইসলামীর শরণাপন্ন হতে হলো শেখ হাসিনাকে। জামায়াত দলীয় সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করলেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সত্ কিংবা সাধু ছিল না। সরকার গঠনের ফলে সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলো পেল আওয়ামী লীগ। তখন আর জামায়াতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ছেঁড়া জুতোর মতো জামায়াতকে ছুড়ে ফেলে দিলেন শেখ হাসিনা। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আবার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু মোনাফেকি আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ নয়। ২০০১ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনও হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সদ্যসাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং ১৯৯০ সালে সর্বদল স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। জনসমর্থন না থাকলে নির্বাচনে পরাজয় হবেই, সেজন্য পদ্ধতিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই—এ ব্যাপারটা শেখ হাসিনা কখনোই স্বীকার করেন না। দুই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে (সাহাবুদ্দীন আহমদ ও লতিফুর রহমান) তিনি যে অশ্লীল ও অশোভন ভাষায় গালাগালি করেন, অন্য কোনো দেশের কোনো প্রথম শ্রেণীর নেতা তেমন ভাষা ব্যবহার করেছেন বলে আমার জানা নেই। কথায় বলে, নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। শেখ হাসিনার স্বভাব ঠিক সে রকমের। এবার তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ওপর (যে পদ্ধতি ছিল তাঁরই আন্দোলনের ফসল) বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন। মনে মনে স্থির করলেন, তাঁর নিজের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করে নিজের ও নিজ দলের বিজয় সুনিশ্চিত করবেন।
দুই ডজন হত্যা, রাষ্ট্রপতিকে বন্দী
দু’হাজার আট সালের ডিসেম্বরে ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে’ একটা মাস্টার প্ল্যানের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সে ব্যবস্থাই তিনি করেছেন। কিন্তু তার জন্যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-লাঠি-বৈঠার হরতালের প্রয়োজন হয়েছিল। হাসিনার ভাড়া করা পেশিশক্তি রাজধানীর রাজপথে লগি, লাঠি ও বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে প্রায় দুই ডজন মানুষকে হত্যা করেছিল। লাগাতার হরতালে দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। সব প্রধান সড়ক ও বন্দর অবরুদ্ধ হয়, রেলপথের লোহার রেললাইন তুলে নেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতির সরকারি নিবাস বঙ্গভবন অবরোধ করে টেলিফোন, বিদ্যুত্ ও পানির সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রপতিকে কার্যত গৃহবন্দী করে ফেলা হয়। একটি পত্রিকাগোষ্ঠী ও দুই রাষ্ট্রদূতের সমর্থনে এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সক্রিয় ভূমিকায় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে বাধ্য করা হয় (যেমন করে লে. জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে পিস্তল উঁচিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন)।
এখন আর কেউই অস্বীকার করেন না যে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (এক-এগারো) বঙ্গভবনে যে নাটকের অভিনয় হয়েছিল, শেখ হাসিনা আগে থাকতেই সেটা জানতেন; কেননা ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটিনেসের সঙ্গে কয়েক মাস আগে থাকতেই তাঁর নিয়মিত শলাপরামর্শ চলছিল। ফখরুদ্দীন আহমদের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকার ছিল, সে সম্পর্কেও এখন কারও সন্দেহ নেই।
তৃতীয় সন্দেহাতীত ব্যাপার এই যে, সে সরকার যখন খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করে রেখেছিল, তখন চিকিত্সার অছিলায় শেখ হাসিনাকে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ড সফর করে সেসব দেশে রাজনৈতিক সভাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিক ও পত্রিকা পাঠকদের অবশ্যই মনে থাকার কথা যে, ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল সে সফরে যাত্রার আগে বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার তাঁর আন্দোলনের ফসল এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের গোটা ইতিহাস ইতোমধ্যেই বিকৃত করে ফেলেছে। শুনেছি, আমাদের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকেও বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু ২০০৬-০৭ সাল খুব বেশিদিনের কথা নয়। সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে কিন্তু এতো দুর্বল নয় যে, পাঁচ-ছয় বছরের আগের এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সত্যতাও তারা ভুলে যাবে। তবু শেখ হাসিনা এই সদ্যসাবেক ইতিহাসও বিকৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন গত শুক্রবার তাঁর টেলি-ভাষণে। এ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলার চেষ্টা করেছেন যে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে এক-এগারো পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির কারুকার্য করেছিল বিএনপি। তিনি বলেছেন, মাইনাস-টু প্রবর্তকরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ইতিহাস অবশ্যই কথা কয়
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন যা বলেন, তার সবকিছু সত্য হয় না। সত্যকেও প্রায়ই তিনি বিকৃত করেন, অন্তত বাঁকা করে বলেন। শুক্রবারের ভাষণে তিনি আবারও আওয়ামী লীগকে গদিতে ফিরিয়ে আনার আবেদন করেছেন দেশবাসীর কাছে। কিন্তু দেশবাসী জানে, শেখ হাসিনার অধীনে ও ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হলেও জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তবু তারা জানে যে, জনসাধারণের ভোট উপেক্ষা করে আবারও একটি মাস্টার প্ল্যানের নির্বাচনে গদি পাওয়াই হচ্ছে শেখ হাসিনার মতলব। সেজন্যই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনসাধারণ তাতে ভোট দেবে না। বস্তুত এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দিতেই তারা নারাজ। সেজন্যই বিএনপির এবং ১৮ দলের জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার পেছনে কাতারবন্দী হয়ে তারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে।
আরও একটি নির্বাচনের আগে আগে শেখ হাসিনার আরেকটি টেলি-ভাষণ ঢাকায় বসেই আমি শুনেছিলাম। পুরো ৪৫ মিনিট ধরে তিনি সত্য ও ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন, শহীদ জিয়াউর রহমান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ও অশ্লীল গালিগালাজ করেছেন। সে ভাষণের রাতেই আওয়ামী লীগের পুরাতন সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, শেখ হাসিনার ভাষণ শোনার পর আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার প্রবৃত্তি তাদের হবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে বড় রকমে পরাজিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার গত শুক্রবারের ভাষণেও উল্টো ফল ফলতে পারে বলে আমার ধারণা।
serajurrahaman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন