মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

এক ভয়ঙ্কর দানব ছাত্রলীগ


সুশীল বড়–য়া

‘আমি হিন্দু। আমার নাম বিশ্বজিৎ দাস।’ এভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে বিপন্ন তরুণটি জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলেন দানবদের হাত থেকে। বিশ্বজিৎ দাস মনে করেছিলেন হিন্দু পরিচয় জানলে ছাত্রলীগ নামক ভয়ঙ্কর দানবের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু মনুষ্যরূপী দানবেরা তার কথায় কর্ণপাত না করে চাপাতি ও রডের আঘাতে আঘাতে বিশ্বজিতের জীবনবাতি দিনে দুপুরে নিভিয়ে দিয়ে বীরের বেশে তাদের আস্তানায় পুলিশ বাহিনীর সম্মুখ দিয়ে চলে গেল।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবরোধ কর্মসূচি প্রতিরোধ করার জন্য পুরনো ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল কলেজে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মিছিল বের করে। সেই মিছিল থেকে বিশ্বজিতের ওপরই নগ্ন হামলা করা হয়। বিশ্বজিৎ তখন তার কর্মস্থল দর্জির দোকানে যাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে কয়েক মিটার দূরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান করছিল। কিন্তু বিশ্বজিতের প্রাণ রক্ষায় তাদের কোনো উদ্যোগই ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘বিরোধী দলের আন্দোলন প্রতিহত’ করার। বিশ্বজিতের নৃশংস ও বিভীষিকাময় এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল কলেজ ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর ক্যাডাররা।
ছাত্রলীগের ভয়াবহ সন্ত্রাসীদের দানবদের এরকম তাণ্ডব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের জঘন্য কার্যকলাপে বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ অতিষ্ঠ। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য রাস্তায় নামানো হয়েছে এদের। এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণসহ নানা অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সচেতন ছাত্র শিক্ষকসহ সমাজের বিবেকবান মানুষ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের। ২৯ এপ্রিল ২০১২ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মী এবং আন্দোলনরত শিক্ষক ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের কর্মীরা নৃশংস হামলা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি কাজী মাহমুদকে গুরুতরভাবে আহত করেছে। ১৫ মে সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এম এ কলেজ এবং সদর উপজেলা ছাত্রলীগের কয়েক নেতার নেতৃত্বে জমি দখল করতে ওরা ছালিয়া এলাকার গ্রামবাসীর সাথে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়। ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা দুই ছাত্রলীগ নেতা অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি তাদের জামিনে ছাড়িয়ে আনেন। ৯ জুন হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিহত হয়। ৮ জুলাই সিলেট এম সি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে ধ্বংস করে। ৭ জানুয়ারি মাগুরায় সিআইডির ভবন নির্মাণের দরপত্র ছিনতাই করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের মাগুরা জেলার সাধারণ সম্পাদক মীর সুমন। টাঙ্গাইলের মধুপুরে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের জঘন্য পাশবিকতার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের মানববন্ধনে বাধা দেয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জাকির। তারা কেন নরপশু ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়াল জনমনে এটা একটা বড় প্রশ্ন।
স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্রলীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এমন অপকর্ম নেই যা তারা করতে পারে না। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তারা ব্যাংক ডাকাতি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, গুদাম লুটসহ সব অপকর্ম করেছিল। আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ক্ষতচিহ্ন এখনো বহন করে চলেছেন মহাজোট শরীক, জাসদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ১৯৭৩ সালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক (বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ)। তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে থেকে অপহরণ করে উইলি জিপে তুলে নিয়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা। তাদের ওপর ওরা ব্যাপক নির্যাতন চালায়, যার পরিণতিতে সারা জীবনের জন্য শরীফ নুরুল আম্বিয়ার একটি হাত অকেজো হয়ে যায়। একই সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মিয়া মোশতাক আহমদকে (সরকারের অস্কারপ্রাপ্ত সচিব) থাপ্পড় মেরে নিচতলার মাটিতে ফেলে দেন তখন যিনি অনেকের ভাষায়, রাজপুত্র। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ভরাডুবি দেখে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন পণ্ড করে দেয় এই ছাত্রলীগ। ডাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী আ ফ ম মাহবুবুল হকের মাহবুব-জহুর প্যানেলের কাছে তৎকালীন মুজিববাদী ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের লেনিন-গামা প্যানেল বিপুল ভোটে পরাজয় দেখে খুব বড় নেতার পুত্রের নেতৃত্বে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ডাকসু নির্বাচন বানচাল করে দেয়। ১৯৭৪ সালে মুজিববাদী ছাত্রলীগের খুব বড় নেতার কোন্দলে সূর্য সেন হলে নাজমুল হক কোহিনূরসহ সাত ছাত্রকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়, যা সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের ফলে তখন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঁচানব্বই শতাংশ ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছিল সরকারবিরোধী জাসদ ছাত্রলীগ। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের পুরনো আতঙ্ক আবারো বাংলাদেশের জনগণের সামনে হাজির হয়। সে সময় ছাত্রলীগের ক্যাডারদের মাত্র দুটো ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডারের ছাত্রী ধর্ষণের সেঞ্চুরি ঘটা করে পালন করা হয়, যা দেশের বিবেকবান মানুষের অন্তরে ব্যাপক রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে। অন্য ঘটনাটি হলো ইংরেজি নববর্ষের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তরুণী বাঁধনের ওপর ছাত্রলীগ ক্যাডারদের পাশবিক নির্যাতন, যা দেশের বাইরেও আলোড়ন সৃষ্টি করে।
শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত পত্রিকা শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানে ২৩ এপ্রিল ২০১২ প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর ১০০ জন বাছাই করা ক্যাডারকে ২০০৯ সালে ভারতের দেরাদুনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে ছয় মাসের কমান্ডো ট্রেনিং দিয়ে সেদেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডো ট্রেনাররা বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। ট্রেনিংপ্রাপ্ত এ ক্যাডারদের কোড বা গোপন নাম হলো ‘ক্রুসেডার-১০০’। সেই রিপোর্টের শিরোনাম হলো “বাংলার বাঘরা ‘র’ কারাগারে।” এতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক ট্রেনিং দেয়ার প্রকল্পটি ‘র’ দ্বারা তৈরি হওয়ার পর এর সামগ্রিক কার্যক্রম সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা, যাদের যোগাযোগ রয়েছে সরাসরি ‘র’ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর সঙ্গে আরো বলা হয়, ‘ক্রুসেডার-১০০’ গ্রুপটি ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংবাদকর্মী এবং অন্যদের অপহরণ, খুন, গুম করে ফেলেছে।
জনগণ মনে করে, আজ দুর্বৃত্ত ছাত্রলীগ দানবদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজনীতির মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাস, গুম, খুন, অপহরণের মাধ্যমে ঘায়েল করতে পারে। তারা জন মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, যাতে সরকারের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়েও রাজপথে কেউ আন্দোলন করতে না পারে।
লেখক : সাংবাদিক, উইকলি নিউজ ম্যাগাজিন প্রোব

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads