সোমবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৩

কানাডায় ইসলামের ব্যাপারে উপলব্ধি বাড়ছে


মঈনুল আলম

কানাডায় মতাসীন ডানপন্থী কনজার্ভেটিভ সরকার নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, ভোট দেয়ার বুথ ও সরকারি কলেজগুলোতে নেকাব পরে মুখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। কানাডার সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের এক রুলিং সরকারের এ সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর শীতল পানি ঢেলে দিলো। ২০ ডিসেম্বর কানাডার সুপ্রিম কোর্ট ৪-২-১ বিভক্ত ভোটে চূড়ান্ত রুলিং দিয়ে বলেছেন, মুখ থেকে পর্দা সরানোর ব্যাপারে প্রত্যেকটি েেত্র সে সময়ের প্রেতি ও পরিস্থিতির বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ রায়ের ফলে প্রত্যেকটি কেসে বিচারককে কোনো কোর্টে স্যা দেয়ার সময় মুসলিম মহিলা সাীর অবাধে তার নিজের ধর্র্মবিধি পালনের অধিকার পেল। এর বিপরীতে একজন অভিযুক্তের নিজের পে সাফাই স্যা দেয়ার এবং অভিযোগকারীকে (এ েেত্র অভিযোগকারী একজন পর্দানশিন মুসলিম মহিলা) অভিযুক্তের জেরা করার সংবিধান প্রদত্ত অধিকারÑ এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে বিচারককে (মুসলিম মহিলাকে মুখ থেকে নেকাব অপসারণ করতে বা না করতে বলতে) সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কানাডায় ইসলামের ব্যাপারে উপলব্ধি (আন্ডারস্ট্যান্ডিং) যে ধীরে ধীরে বাড়ছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটাই প্রকাশ পেয়েছে। এ রায়ের তিন মাস আগে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিদ্ধান্তেও ইসলামের প্রতি উপলব্ধি বৃদ্ধির বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে ইসলামচর্চার জন্য একজন পূর্ণসময়কালীন (ফুলটাইম) ইমামকে নিয়োগ দিয়েছে, যা এ দেশটির জন্য সর্বপ্রথম একটি নজির।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, মুসলমান নারীর নিজ ধর্মের বিধিবিধান পালনের মৌলিক নাগরিক অধিকার রয়েছে, যা কানাডার সংবিধানে বিধিবদ্ধ আছে। এ রায়ের ফলে কানাডার রণশীল সরকার সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে পাইকারিভাবে মুসলমান নারীর মুখ থেকে বাধ্যতামূলক নেকাব অপসারণের যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তা থমকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মুসলমানদের সংগঠন কানাডিয়ান কাউন্সিল অন অ্যামেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স এই রায়কে একজন পর্দানশিন মহিলার তার ধর্মীয় রীতি পালন করার ‘স্বতঃসিদ্ধ অধিকার’কে (প্রিজাম্পটিভ রাইট) স্বীকার করে নেয়া বলে অভিহিত করেছে। কাউন্সিল আরো বলেছে, ‘সে (মুসলিম মহিলা) যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে এই রীতি (মুখে পর্দা রাখা) পালন করা তার ধর্মীয় কর্তব্য, তাহলে সে এটাকে সংবিধান-প্রদত্ত তার অধিকার বলে দাবি করতে পারে।’
এই কাউন্সিলের আইনবিদ ফয়সল ভাবা বলেন, এই রায়ের অর্থ এটাই বুঝায় যে, তার (মুসলিম মহিলার) মুখে পর্দা রাখার অধিকারকে বিবেচনায় আনা বিচার বিভাগের কর্তব্য হয়েছে এবং অপর পকেই এখন প্রমাণ করতে হবে যে (মুসলিম মহিলা) সাী যদি মুখ পর্দায় আবৃত রেখে স্যা দেয় তাতে ‘ন্যায়বিচার না হওয়ার গুরুতর ঝুঁকি রয়েছে’।
এই সংগঠন আরো বলে, আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিকত্ব গ্রহণের শপথ করাকালে মুখের ওপর থেকে নেকাব অপসারণের যে শর্ত ফেডারেল কনজার্ভেটিভ সরকার চালু করেছে, তা এখন অবশ্যই বাতিল করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারকের বেঞ্চে একজন বিচারক রোজালি আবেলা তার রুলিংয়ে বলেন, দুই পরে মতের মধ্যে ভারসাম্য আনাকালে অবশ্যই নেকাব পরিহিতা সাীর পইে রুলিং যেতে হবে এ কারণে যে, নেকাব আবৃতা অভিযোগকারিণী যেন আদালতে এসে বিচার চাইতে উৎসাহিত হয়, তবে অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক েেত্র নেকাব আবৃতা সাীকে শনাক্তকরণ যদি সন্দেহাতীতভাবে করা অপরিহার্য হয়, সেসব ত্রে ব্যতীত।
কানাডার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিভারলি ম্যাকল্যাকলিনের নেতৃত্বে সাত বিচারকের বেঞ্চে সংখ্যাধিক্য বিচারকের দেয়া এই রুলিংয়ে বলা হয় (নেকাব সম্পর্কিত), কেইসে বিচারক সরাসরি (নেকাব পরা) নিষিদ্ধ করবেন না, আবার সব েেত্রই স্বাভাবিকভাবে মুখ আবৃত করা নেকাব পরাকে অনুমোদন দেবেন না।
রুলিংটা এসেছে একটি মামলায় যেখানে তিরিশোর্ধ্ব বয়সের এক মুসলিম মহিলা যিনি ইসলামের বিধান অনুযায়ী সারা শরীর আবৃত করা হিজাব পরেন এবং শুধু চোখ দেখা যায় এমনভাবে মুখ নেকাব দিয়ে আবৃত রাখেন। তিনি কোর্টে মামলা করেন যে বাল্যাবস্থায় তিনি নিকট আত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কোর্টে তার জবানবন্দী দিতে ডাকা হলে তিনি মুখ থেকে নেকাব সরিয়ে জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করেন এই বলে যে, তার ধর্মের বিধানানুযায়ী তার পরিবারের ‘সরাসরি’ সদস্য নন এমন পুরুষের উপস্থিতিতে তার মুখ এবং শরীর অবশ্যই আবৃত রাখতে হবে।
২০০৭ সালে তিনি অভিযোগটি পুলিশের কাছে লিপিবদ্ধ করেন, যার ফলে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। মামলায় মহিলার পুরো নাম উল্লেখ না করে সংেেপ এন এস লেখা হয়। অভিযোগকারিণীর পরে উকিল ডেভিড বাট মুসলিম মহিলা এন এসকে আইনের একজন পাইওনিয়ার (পথ প্রদর্শক) বলে অভিহিত করে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের এই রুলিংয়ে তার মক্কেল ‘রোমাঞ্চিত’ হয়েছেন। আর তিনি মনে করেন যে এখন থেকে চলাফেরা করাকালে তার মুখ নেকাবে আবৃত রাখার অধিকার জোরদার হলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণসময়কালীন ইমাম নিয়োগ
কানাডার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো অক্টোবরে আমজাদ তারসিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণসময়কালীন মুসলিম ইমাম নিযুক্ত করেছে। কানাডার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই হলো সর্বপ্রথম পূর্ণ সময়কালীন কোনো মুসলিম ইমামকে নিয়োগদানের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমামের দায়িত্ব পালনে তারসিন ধর্মীয় আলোচনা চক্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন। তিনি শুক্রবারের জুমার নামাজে ইমামতি করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে আন্তঃধর্মীয় মতবিনিময় করবেন। তিনি ইমানুয়েল কলেজ ক্যাম্পাসে অফিস স্থাপন করেছেন। সেখানে বসে তিনি ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন এবং প্রয়োজনমতো পরামর্শ দেবেন। ক্যাম্পাসের বাইরেও সর্বস্তরের মুসলমান, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলমান এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মুসলমান নারী-পুরুষ তার অফিসে এসে তাদের সমস্যাদি আলোচনা করতে এবং তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিতে পারবেন।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে পাঁচ হাজার মুসলিম ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুকাল থেকে খ্রিষ্টান ছাত্রদের জন্য পূর্ণসময়কালীন পাদরি এবং ইহুদি ছাত্রদের জন্য পূর্ণসময়কালীন ইহুদি ধর্মযাজক রয়েছেন। একইভাবে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য একজন পূর্ণসময়কালীন মুসলিম ইমাম নিয়োগ করতে টরন্টোর মুসলিম সম্প্রদায় ৭০ হাজার ডলারের অধিক তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছে বলে ইমাম নিয়োগের জন্য গঠিত বোর্ডের সভাপতি রুকাইয়া আহদাব প্রকাশ করেন। অতঃপর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় একজন পূর্ণ সময়কালীন মুসলিম ইমাম নিয়োগ দিল। প্রাথমিকভাবে এক বছরের জন্য এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমাম পদের জন্য ২০ জন প্রার্থীÑ পুরুষ ও মহিলা ইন্টারভিউতে উপস্থিত হন। তাদের মধ্যে মহল্লার ইমাম থেকে জেলখানার ইমাম পর্যন্ত ছিলেন। সবাইকে ইন্টারভিউ করে শেষ পর্যন্ত আমজাদ তাসরিনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
মুসলিম ইমাম বলতে সাধারণত  দীর্ঘ দাড়িশোভিত কোনো বয়স্ক ব্যক্তির যে চেহারা মনে ভেসে ওঠে, আমজাদ তারসিন তার ব্যতিক্রম। তারসিনের বয়স মাত্র ২৮ বছর এবং তার থুঁতনিতে স্বল্প দাড়ি আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে যে, তারসিনের কম বয়সের জন্য ধর্মীয় আলোচনাদিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাথে তাসরিনের মতবিনিময় সহজতর এবং অধিকতর ফলদায়ক হবে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী
moyeenulalam@hotmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads