সিরাজুর রহমান
ভোটের বিনিময়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করেছিলেন শেখ হাসিনা। যে প্রতিশ্রুতি দিলে মানুষ খুশি হবে তার কোনোটি উচ্চারণ করতে ভোলেননি তিনি। ১০ টাকা কেজি দরের চালের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ভয়ানক অখুশি হন তিনি। কিন্তু আরো প্রতিশ্রুতিও তো ছিল। ক্ষমতা পেলেই বিদ্যুতের সঙ্কট দূর করবেন, বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশে পরিণত করবেন, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস করবেন, প্রতি পরিবারে একজনকে চাকরি দেবেন, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবেনÑ এসব প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা হরহামেশা দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল যে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদ ও সম্পত্তির বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা হবে। গদি লাভের কিছুকাল পরেই সে বিধান পাল্টে গেল। ঘোষণা হলো যে, মন্ত্রীরা তাদের সম্পদের বিবরণ দেবেন প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রী সেগুলো প্রকাশ করবেন না। সেসব বিবরণ তারা দিয়েছেন কি না এবং দিয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রী সেসব হিসাব দিয়ে কী করেছেন আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি, চার বছর ধরে ডিজিটাল দুর্নীতি চলেছে বাংলাদেশে।
শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, বিনা টেন্ডারে কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার হরিলুট, ডেসটিনি আর হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সমালোচনা এখন আর সরকার গায়ে মাখে না। হয়তো তারা সেগুলো নিজেদের বিজয়ধ্বজা বলেই মনে করে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেসব সম্বন্ধে এখনো ভয়ানক স্পর্শকাতর। আগেও কয়েকবার লিখেছি, কোনো কোনো বাচ্চা মেয়ে গুটি খেলতে গিয়ে প্রতারণা করে অথবা মিথ্যা কথা বলে ধরা পড়ে গেলে পাল্টা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর। আঁচড়ে, খামচে তাকে একাকার করে দেয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান সে জাতের মানুষ। হয়তো কাগজ-কলমে প্রমাণ হাজির করেছে বলেই বিশ্বব্যাংকের ওপর তার এত আক্রোশ।
সেতু তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন এখন আটকে আছে দুর্নীতির দায়ে দুই সাবেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আর আবুল হাসানের (হাসান-হোসেন) বিচার ও শাস্তির প্রশ্নে। বিশ্বব্যাংক বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। বহু দরকষাকষির ওপর ব্যাংক কয়েকজনের একটা তালিকা পাঠিয়েছিল, বলেছিল যে, এদের বিচার হলে ব্যাংক পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১.২ বিলিয়ন (১২০০ কোটি) ডলার ঋণ দেবে। বহু গড়িমসির পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাসান-হোসেনকে বাদ দিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে রাজি হয়। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান অপূর্ব এক উক্তি করেছেন এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক সে সম্বন্ধে তদন্ত করবে। অভিযোগ যদি প্রমাণিতই হলো তাহলে তখন আর তদন্তের কী অবশিষ্ট রইল সহজবোধ্য নয়। জনাব গোলাম রহমান অনেক আগেই প্রমাণ দিয়েছেন যে, গণভবনের ইচ্ছাপূরণ তার প্রথম এবং প্রধান পবিত্র কাজ। সুতরাং ধরে নিতেই হবে যে, গণভবনের নির্দেশেই তিনি আবুল হোসেন সম্বন্ধে তদন্ত করতে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে রাজি নন। বাইনমাছের মতো পিচ্ছিল অঙ্গভঙ্গি করে তিনি পার পাবার চেষ্টা করছেন। আবুল হোসেনের প্রক্সি দুর্নীতির তদন্তে বেশি আপত্তি কার, বাংলাদেশের মানুষের আর বুঝতে বাকি নেই।
শেখ হাসিনার আরেকটা বৈশিষ্ট্য, তিনি মনে করেন খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ‘টিজ’ করতে পারেন তিনি। বিশ্বব্যাংক প্রকৃতই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে চায়। আরো আপস করে তারা শেষ পর্যন্ত বলেছে, আবুল হাসানকে বাদ দিয়ে শুধু আবুল হোসেনের বিচার করলেই তারা সন্তুষ্ট হবে। শেখ হাসিনা তড়াক জবাব দিয়েছেন, সেটা কেন হবে? হোসেনের বিচার করতে হলে হাসানের বিচার করতে হবে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে, বিচার যদি দু’জনেরই করা হয় তাহলে ব্যাংকের আপত্তি হবে না, গোড়ায় ব্যাংক তো সে দাবিই করেছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব গোলাম রহমান অনুগ্রহ করে রাজি হলেই হাসান-হোসেন উভয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং তাদের বিচার হতে পারে।
নিজের সম্পদে পদ্মা সেতু?
সেই সঙ্গে আবারো পাল্টা হুমকি দিয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশ নিজেই পদ্মা সেতু তৈরি করবে, ছয় মাসের মধ্যেই নকশা তৈরি করতে বুয়েটের প্রকৌশলীদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। গত বছরের গ্রীষ্মকালের কথা আশা করি কেউ ভুলে যাননি। এ কথা প্রধানমন্ত্রী তখনো একবার বলেছিলেন। বলেছিলেন, অর্থায়নের জন্য চাঁদা তোলা হবে, সে বাবদ নাকি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছিল। সেতু তহবিলের নাম ভাঙিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তখন চাঁদাবাজির সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও তখন বাইনমাছের মতো বহু কসরৎ করেছিলেন। নিজেদের সম্পদ থেকে সেতু তৈরির হুমকির পরে তিনি বললেন, অর্থায়নের বিকল্প ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ। জাপান, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নামোল্লেখও করা হয়েছিল তখন। কিন্তু সে সম্ভাবনাও ভেস্তে গিয়েছিল এবং আবারো বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রথমে হাসান-হোসেনের এবং পরে শুধু হোসেনের বিচার ও শাস্তির প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আবারো আটকে গেছে মনে হয়। বাংলাদেশের সেরা বাকচাতুর্যে অভ্যস্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বারবার বিশ্বব্যাংককে হুমকি দিচ্ছেন : জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাংককে অর্থায়নে রাজি হতে হবে, নইলে…। নইলে যে কী হবে তিনি খুলে বলছেন না। মুহিত সাহেবের বার্ধক্যজনিত খারাপ রোগ হয়েছে বলেই মনে হয়। তিনি ভাবছেন তার হুমকিতে বিশ্বব্যাংকের হাঁটু ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপবে।
বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠছে না। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বহু সড়ক প্রায়ই চলাচলের অযোগ্য থাকে, মেরামত ও সংরক্ষণের অভাবে এখানে-ওখানে সেতু ধসে পড়ার খবর প্রায়ই পড়ি পত্রিকায়। শোনা যায়, মন্ত্রী দফতর থেকে শুরু করে বিভিন্নপর্যায়ে বখরা দিয়ে দিয়ে বরাদ্দ অর্থের সামান্য অংশই প্রকল্পের জন্য অবশিষ্ট থাকে। যত দূর মনে পড়ে, বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তা ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের একটা বড় অংশই প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ইত্যাদি আমদানি বাবদ বিদেশী মুদ্রায় ব্যয় হবে বলে ধরা হয়েছে। বস্তুত বিশ্বব্যাংক এ বাবদই ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা আর মুহিত সাহেব অন্য সূত্র থেকে ঋণ নিতে গেলে সুদ দেবেন বিশ্বব্যাংকের ১০ থেকে ১২ গুণ। অবশ্যি প্রধানমন্ত্রীর সেটা গায়ে লাগবে না। গরিব দেশের অর্থে বিদেশীদের দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে তিনি ভালোবাসেন। বেহুদা অস্ত্র কিনে রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিনের কাছ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার তিনি ঋণ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেটা গায়ে লাগেনি, টাকাটা শোধ করবে আগামী কয়েকটি বাংলাদেশী প্রজন্ম।
নিজস্ব সম্পদ ও প্রযুক্তি দিয়ে সেতুটি তৈরি হবে বলে শেখ হাসিনা যে দাবি করছেন, সেটা ‘বাঙ্গালকে হাইকোর্ট’ দেখানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। দেশবাসীকে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি পালনেই সরকার ব্যর্থ হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে অন্তত একটা সাফল্যের দাবি করার আশা ছিল সরকারের। কিন্তু যেভাবে বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে তার ওপর দেশে কিংবা বিদেশে বিশেষ কারো আস্থা আছে বলে মনে হয় না। একাত্তরের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ছিনতাই, নির্যাতন ও হত্যার। বিশ্ববাসীর চোখের সামনে ঠিক সেসব অপরাধই অহরহ ঘটছে সরকারের নাকের ডগায় এবং খুব সম্ভবত সরকারের ইচ্ছায়। প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে বিচার নয়, রাজনৈতিক কূটকৌশল আর প্রতিহিংসাই তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারের উদ্দেশ্য।
বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানো
শেষ ভরসা ছিল পদ্মা সেতু। সরকারের আশা ছিল সেতু তৈরি সম্ভব না হলেও শেখ হাসিনার নামাঙ্কিত মার্বেল ফলক বসবে পদ্মার এ-তীর আর ও-তীরে। বিভিন্ন মহলের আশা ছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরে তারা গোঁফে তা দেবে। ওদিকে জনগণকে তারা ভাঁওতা দেবে, বলবে সেতুর কাজ তো শুরু হয়ে গেছে, আরেকটা দফা ভোট দাও, সেতু তৈরি হয়ে যাবেই। পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ বছরে এসে এটা এখন প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বাঁধা গৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট দাও, ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ভোট দিয়ে দাও, ২০১২ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। চার বছরে তারা শুধু লুট করেছে, কিছুই দিতে পারেনি দেশকে। বাকি ১১ মাসেও কিছু দিতে পারবে না। সুতরাং ভাঁওতাবাজি দিয়ে আবার গদি পাবার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে তারা।
বাংলাদেশের মানুষকে কি তারা পাঁঠা পেয়েছে? তারা কি জানে না যে দেশে আরো একটা দল আছে, তারা চারবার ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেত্রী জনসাধারণের ভোটে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন? তারা কি এ কথা জানে না যে, বিশ্বব্যাংক বিএনপির এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ ও প্রমাণ পেশ করেনি এবং বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে পদ্মা সেতু এবং অন্যান্য প্রকল্পের জন্য ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক দ্বিধা করবে না? অর্থাৎ পরিকল্পিত পদ্মা সেতু নির্মাণের বেশি সম্ভাবনা বিএনপি সরকারের আমলে। তা ছাড়া সম্প্রতি বেইজিং সফরকালে খালেদা জিয়া পদ্মার ওপর দ্বিতীয় একটি সেতু তৈরির অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও নিয়ে এসেছেন। মনে রাখতে হবে, যমুনা নদীর ওপর বাংলাদেশের বর্তমান বিশাল সেতুটি তৈরি হয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকারের আমলেই। পরে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তার কপালে পিতার নামের ফলক লাগিয়ে দেন মাত্র।
‘নিজস্ব সম্পদ’ থেকে পদ্মা সেতু তৈরির কথাবার্তা আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র। আর দেশের জনসাধারণকে হাইকোর্ট দেখানোর অপচেষ্টা। এই হাইকোর্ট দেখানো কথাটার উৎপত্তি বুঝিয়ে বললে রস উপভোগে সহায়তা হবে আশা করি। বহুকাল আগে, তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে এক ‘বাঙ্গাল’ কলকাতায় বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। দেশ থেকেই সঙ্কল্প করে গিয়েছিল যে, ওখানে হাইকোর্ট দেখবে সে। বন্ধু নিজেও কখনো হাইকোর্ট দেখেনি, হাইকোর্ট কোথায় জানেও না। এক দিন যেতে যেতে সে দেখল ট্রাম যাচ্ছে, ট্রামের মাথায় গন্তব্য লেখা ‘হাইকোর্ট’। বন্ধুকে বলল, ওই দ্যাখ হাইকোর্ট। বাঙ্গাল বলল, কোথায়? বন্ধু বলল, ওই যে! ওই দ্যাখ, ঠ্যাং উঁচু করে খট্ খট্ করে চলে যাচ্ছে।
লন্ডন, ২৯.০১.১৩
serajurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন