শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৩

রাজনৈতিক নিপীড়নের মাত্রা ও তার পরিণতি



রাজনৈতিক নিপীড়নে সরকারি ভূমিকা পাশবিকতার চূড়ান্ত মাত্রাকেও যেন স্পর্শ করেছে। ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলায়  বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আসামী করতেও তাদের বিবেকে বাধেনি। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সাধারণ মানবিকতাও দেখাতে তারা প্রস্তুত নয়। দলীয় কার্যালয়তো দূরের কথা- নিরিবিলি নির্জনে দলীয় কার্যক্রম বা সাংগঠনিক কর্মকান্ডও পুলিশী বাধায় কিম্বা গ্রেফতারের জন্য তারা সম্পন্ন করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র কিংবা জঙ্গিপনার দোহাই তুলে। কিছুদিন পূর্বে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার বেশ কয়েকজন পর্দানশীন ছাত্রীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর কর্মকান্ডের পরিকল্পনার অজুহাতে। কুরআন-হাদিস ও ইসলামী সাহিত্যকে দেখানো হয়েছে জঙ্গি পুস্তক হিসেবে। গ্রেফতারকৃত মহিলাদের মধ্যে একজন গর্ভবতী মহিলাও ছিলেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, সরকারি রোষানলে পড়ে গর্ভবতী মহিলা বাদে সকলকেই রিমান্ড নামক চরম নিবর্তনমূলক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আদালতের আদেশে। এখনও পর্যন্ত সবার জামিন হয়নি। শিবির-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সরকারি রোষানলে পড়ে তাদের পারিবারিক জীবনযাপন করতে পারছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের জামায়াত-শিবিরের কাউকে দেখলেই পুলিশে ধরিয়ে দিতে বলেছে। সভ্য দেশের কোন সভ্য সরকার এরকম ঘোষণা দিতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। জামায়াতকে ধ্বংস করতে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিভিন্নভাবে মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে, অথচ এর প্রতিবাদে ন্যূনতম প্রতিবাদও করা যাবে না। প্রতিবাদ মিছিল নামানো হলে মুহূর্তেই হামলে পড়ছে সরকারের পুলিশ ও র‌্যাব বাহিনীর চৌকস সদস্যবৃন্দ। সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে: পুলিশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ন্যূনতম সহনশীলতা দেখাচ্ছে না। মিছিল দেখলেই টিয়ারশেল ও গুলীবর্ষণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত ২ জানুয়ারিতে মালিবাগ রেল ক্রসিংয়ে এমনই এক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গ্রেনেড, গুলী, রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস মেরে জামায়াতের এক প্রতিবাদ মিছিল বানচাল করে দিয়েছে। গুলীতে জামায়াতের মহানগর সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুলসহ ৫০ জন গুরুতর আহত হয়েছে। পুলিশ প্রাক্তন এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহেরসহ ২০ জনকে আটক করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এভাবে ক্ষমতাসীনদের অসুরিক জুলুমে বাধাগ্রস্ত হলে সামনে ভয়ংকর দিনসমূহের আলামত আশঙ্কা করছেন চিন্তাশীলমহল। সরকার মানবাধিকার সংস্থা ও বিদেশী সরকারসমূহের কোন উদ্বেগই আমলে নেবে না বলে ইদানীং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মণি ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের পরিভাষায় ‘যুদ্ধাপরাধী বিচার বানচাল'-এর এই ষড়যন্ত্রে সরকার পা দেবে না। জনগণের যে কোন দাবি দাওয়া, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-এর দাম কমানো, আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাকস্বাধীনতা রক্ষাসহ যে কোন দাবি দাওয়াকেই তারা ‘যুদ্ধাপরাধী বিচার বানচাল'-এর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। মিডিয়ার এক টকশোতে এক বুদ্ধিজীবী সেদিন বলেছেন, দেশে ভূকম্পন মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হওয়াটাকেও সরকার যুদ্ধাপরাধী বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন কি না কে জানে? অর্থাৎ দেশ পরিচালনার ব্যর্থতাকে এখন উদোরপিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। সরকারি উক্তি আচরণে মনে হচ্ছে : পুরো জাতি তাদের ওপর আপতিত দুঃশাসনের পাহাড়সম সমস্যাগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে, তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম ভুলে গিয়ে যেন ইসলামী আন্দোলনের বৃহত্তম দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সরকারি নির্মূল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তথাকথিত মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল-এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাই সরকারি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে কোন দাবি দাওয়াভিত্তিক আন্দোলন পরিচালনা করলেই তারা যুদ্ধাপরাধ বানচালের দুঃস্বপ্ন দেখে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। এটা হচ্ছে সরকারি নীতি নির্ধারকদের জনদাবি নির্মম দলনের একটি গৃহীত কৌশল মাত্র। সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে অতি প্রগতিবাদী সুশীল সমাজ এখন চোখ বুজে আছেন। মনে হয় শাহরিয়ার কবির- খুশি কবির- নির্মলেন্দু গুন' বাবুরা এখন মহাআনন্দে বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন। দেশে বহমান টেন্ডারবাজি, ফ্রাঙ্কেইন স্টাইলে অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, শেয়ারবাজার লুটপাট, সীমান্তে বাংলাদেশীদের বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে হত্যা, রাহাজানি ধর্ষণসহ রাজনৈতিক নিপীড়ন, ষড়যন্ত্রের নামে ২০ জন নারী তন্মধ্যে একজন গর্ভবতী মহিলার গ্রেফতার-রিমান্ডসহ নির্মম কারাবাস-ইত্যাকার কোন কিছুই তাদের পাষাণ হৃদয়কে শোকাহত করছে না। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন এখন কুম্ভকর্ণের ঘুমে বিভোর। কমিশন প্রধান ড. মিজানুর রহমানকে লজ্জাজনকভাবে বাংলাদেশের এক পেশে ও একপক্ষীয় রাজনৈতিক দলসমূহের সভা-সেমিনারে উপস্থিত থেকে তাদের শোভা বর্ধনকারীর ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কিংবা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভায় প্রায়ই উপস্থিত থাকেন। যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার তিনি দাবি করেন। অথচ তার দাবি থাকা উচিত ছিল যেন বিচার ন্যায়সঙ্গত ও আন্তর্জাতিকমানের হয়। আসামীপক্ষের মানবাধিকার যেন কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয়- সে ব্যাপারে তার কোন উৎকণ্ঠাই পরিলক্ষিত হয়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে স্পষ্ট দিবালোকে সরকারি পুলিশ তুলে নিয়ে গুম করে ফেললো, এ ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশন অবগত হওয়া সত্ত্বেও মুখে ঠুলি মেরে চুপ হয়ে আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন ছাত্রকে গুম করা হলে কমিশন দফতরে শোকাকুল পিতা-মাতারা কমিশন প্রধান ড. মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎকার না দিয়ে ন্যক্কারজনক অধ্যায় রচনা করলেন। দুঃশাসনের কড়াল গ্রাসে মানবতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা যেন নির্বাসনে যাচ্ছে। সরকারি নিপীড়ন এখন যুদ্ধংদেহী মাত্রা পাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশী নির্যাতন মানবাধিকারের ন্যূনতম মাত্রাকেও স্পর্শ করছে না। জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোন প্রতিবাদ সভা কিংবা মিছিল দেখা মাত্রই তারা মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গত ৩ জানুয়ারি সংগঠনটি রাজনৈতিক দাবি দাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল করলে নির্মম পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয় সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। দৈনিক আমার দেশ গত ৪ জানুয়ারি ‘জামায়াত শিবির দমনে পুলিশের গ্রেনেড ব্যবহার' এবং ‘ঢাকা ও রাজশাহীতে শিবিরের মিছিলে পুলিশের টিয়ারশেল ও গ্রেনেড' শীর্ষক দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে পুলিশের গ্রেনেড হামলা এই প্রথম। সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে র‌্যাব পরিচয়ে ঢাকার ৫৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিকুল ইসলামকে বাসা থেকে কিছু দিন পূর্বে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর কোথাও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। র‌্যাব কর্তৃপক্ষ যথারীতি তাদের কোন টিম গ্রেফতার করেনি বলে বক্তব্য দিয়েছে। অথচ গত ৬ জানুয়ারি প্রতিটি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ এবং সংবাদে উক্ত রফিকুল ইসলামের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় গুলীবিদ্ধ লাশ কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে উদ্ধার অবস্থায় দেখানো হয়েছে। জননিরাপত্তা এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত আছেন, তারা মেহেরবানী করে বলবেন কি? দেশ এভাবে চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা একমাত্র মহান আল্লাহপাকই জানেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads