আলফাজ আনাম
সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন সন্ত্রাসীদের অভায়রণ্য পরিণত করা হয়েছে। ছাত্র নামের সন্ত্রাসীদের এই আখড়ার অধিপতি বানানো হয়েছে ভাইস চ্যান্সেলর নামের একেকজন গডফাদারকে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও এমন একজন গডফাদার। তিনি এই শিশু নিহত হওয়ার পর বলেছেন, ছাত্রলীগের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রদলের কর্মীরা নাকি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। টেলিভিশনে তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি যেন ছাত্রলীগের মনোনীত ভিসি। দেশের রাষ্ট্রপতি তাকে ভিসি পদে নিয়োগ দেননি, দিয়েছেন ছাত্রলীগের কোনো নেতা। তিনি যেন ভুলে গেছেন ছাত্রদল হোক বা ছাত্রলীগ হোক, অনুপ্রবেশকারী হোক বা জন্মসূত্রে মুজিববাদী হোক, তারা সবাই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামধারী ব্যক্তি। এদের কর্মকাণ্ডের দায় তার ওপরও বর্তায়। ছাত্রলীগ যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তা এই ভিসি যেমন জানেন, তেমনি শিক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জানেন। কিন্তু প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য এই সন্ত্রাসীদের লালন করতে গিয়ে এখন টাকা ভাগাভাগিতে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছেন। সংবাদপত্রে এই সংঘর্ষের কারণ হিসেবে বলা হয়েছেÑ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজের জন্য কয়েকটি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একই সাথে চলছে বেশ কিছু নিয়োগপ্রক্রিয়া। টেন্ডারবাজি আর নিয়োগবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে এই শিশুটি নিহত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজ ও নিয়োগপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হচ্ছেন ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব প্রশাসনিক কাজে ছাত্রলীগ কিভাবে সম্পৃক্ত হয়? নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্পৃক্ত না করলে এরা সম্পৃক্ত হতে পারত না। এর আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগবাণিজ্য নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরপর শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু তার কোনো বিচার হয়নি। এরপর প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের মিছিলে হামলা চালানোর সময় পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি চালানো হয়। কিন্তু এই ঘটনার জন্য কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দল দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর বিরোধী দলের ডাকা অবরোধে ছাত্রলীগ মাঠে নেমে পুলিশের সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের মিছিলে হামলার জন্য পুলিশের অস্ত্র নিয়ে গুলি চালানো হয়েছে। ছাত্রলীগ প্রকৃতপক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে কাজ করছে। কিন্তু এর ফল হচ্ছে পুলিশের সক্ষমতা বলে আর কিছু থাকছে না। ছাত্রলীগ আর পুলিশের মধ্যেও থাকছে না কোনো পার্থক্য। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে পুলিশের যেমন গুলি ছোড়ার অধিকার আছে তেমনি ছাত্রলীগেরও গুলি ছোড়ার অধিকার দেয়া হয়েছে।
কিছু দিন আগে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা বেতনভাতার দাবিতে রাজধানীতে মিছিল-সমাবেশ করতে এসেছিলেন। এই শিক্ষকদের ওপর মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পিপার স্প্রে করা হয়েছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেনÑ অবৈধ সমাবেশ দমন করতে পুলিশ ফুলের মালা নিয়ে যাবে না। দমনের উপকরণ নিয়ে যাবে। স্কুলের এই শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের মতো গডফাদার নন। এই শিক্ষকেরা ছাত্রলীগের সুপারিশে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি। খেয়ে না খেয়ে বা আধবেলা খেয়ে গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলো দিচ্ছেন। তাদের নায্য দাবির সমাবেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অবৈধ সমাবেশ এবং তা দমন করার জন্য তিনি কঠোর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রিয় শব্দ দমন। এর সাথে যোগ হয়েছে পীড়ন। এর আগে মার্কিন দূতাবাস থেকে বিরোধী দলের সাথে আলোচনার জন্য বিবৃতি দেয়া হলে তিনি বলেছিলেন, আগে দমন করে নিই তারপর আলোচনার প্রশ্ন। এই দমন-পীড়নের কাজটি তিনি করছেন বিরোধী দলের ওপর। নায্য অধিকারের জন্য যারা কথা বলছেন তাদের ওপর। কিন্তু অবৈধ অস্ত্রধারীদের তিনি দমন করছেন না। তাদের লালন করছেন। তাদের অস্ত্রবাজির সমাবেশ বা মিছিলে পিপার স্প্রে করা হচ্ছে না। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত তখনো পুলিশ ছিল কিন্তু তাদের দমন করা হয়নি। শিক্ষকদের যখন জুতাপেটা করা হয় বা হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয় বা তাদের ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয় তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এর কোনো প্রতিকার নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে শিষ্টের দমন আর দুষ্টের লালন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ সংগঠনের কর্মী খুনের মামলার আসামি ছাত্রলীগ ক্যাডার আখেরুজ্জামান তাকিম সন্ত্রাসীদের হাতে গুরুতর আহত হলে তাকে হাসপাতালে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দল বেঁধে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ওপর শিবির হামলা করেছে এই অভিযোগ এনে ঢাকায় সব ধরনের দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছিল। একজন সন্ত্রাসীর পাশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাঁড়াতে পারেন আর শিক্ষকদের দমনের জন্য সব উপকরণ ব্যবহারের ঘোষণা দেন। সরকারের এ ধরনের নীতি ছাত্রলীগের অপরাধপ্রবণতাকে আরো উসকে দিচ্ছে।
ছাত্রলীগের তাণ্ডবে শিক্ষামন্ত্রী নীরব। তার ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলছে না। অথবা ছাত্রলীগের সাথে ক্ষমতাসীন দলের কোনো সম্পর্ক নেই। পতিত এই বামনেতা মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের দায় নিতে চান না। দেশের বাম প্রভাবিত গণমাধ্যম তাকে একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যম খুব পরিকল্পিতভাবে তার কোনো বক্তব্য নিচ্ছে না। নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা যখন আন্দোলন করছেন তখন তিনি বলেন, সরকারের অর্র্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এক সময় সেনাবাহিনীর বাজেট কমিয়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর জন্য খুবই সোচ্চার ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। এখন রাশিয়া থেকে আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনা হচ্ছে। অথচ বছরে ২০ কোটি টাকা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ দিলেও শিক্ষকেরা অন্তত পেটের ভাত নিশ্চিত করতে পারত। এখন আর তিনি সেনাবাহিনীর জন্য এই অস্ত্র কেনার বিরোধিতা করেন না। হয়তো এখনো তিনি মনে করেন মস্কোর ছাতার নিচে আছেন। এখনকার মস্কো লেনিনের সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া নয়, পুতিনের মাফিয়া রাষ্ট্র। ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির রাজনীতিতে শিক্ষামন্ত্রীর নিজ জেলা সিলেটের এমসি কলেজ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী নিজে এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। এ জন্য তিনি কলেজে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন কিন্তু ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মিডিয়ায় সমর্থন থাকলে কিভাবে নিজের ব্যর্থতা আড়াল করে সফল মন্ত্রী হওয়া যায় তার উদাহরণ হয়ে থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
ক্ষমতাসীন দলের খুদকুঁড়ো খাওয়া একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বারবার এ কথা বলার চেষ্টা করছেনÑ ছাত্রলীগ এক মহাগৌরবময় সংগঠন। সম্প্রতি এরা খারাপ হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবকে কাজে লাগানোর জন্য সন্ত্রাসীরা এই ছাত্রসংগঠনে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ গৌরবের কী কাজ দেখেছে দেশবাসী? প্রত্যেকটি অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি ও নারী নিপীড়নের ঘটনার সাথে ছাত্রসংগঠনটির বিভিন্ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা জড়িত। ছাত্রলীগের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন? এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে ছাত্রলীগের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ছায়া এখন ছাত্রলীগের ওপর ভর করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই সংগঠনের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব ছাত্রলীগের ওপর পড়েনি। এর কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এই নেতাদের পাশে থাকা ছাত্রলীগ নেতারা দেখছেন কিভাবে তারা টাকা কামাচ্ছেন। কিভাবে হলমার্ক ও ডেসটিনির টাকা নেতাদের পকেটে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ৪ শতাংশ ঘুষের টাকা কার পকেটে যেত, তারা কতটা প্রভাবশালী তা সচেতন মানুষ যেমন জানেন তেমনি ছাত্রলীগের নেতারাও জানেন। তারা দেখছেন বড় ভাইরা ব্যাংক জালিয়াতির টাকা নিয়ে কিভাবে বিদেশে সুখে জীবন যাপন করার আয়োজন করছেন। বাড়ি করছেন, গাড়ি করছেন। ছেলেমেয়েকে বিদেশে লেখাপড়া করাচ্ছেন। হাইব্রিড নেতারা দামি স্যুট-টাই পরে গাড়িতে চড়ে জনসভায় আসছেন। এই নেতাদের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা টেন্ডারবাজি এবং নিয়োগবাণিজ্যে লিপ্ত হচ্ছেন। ফলে ছাত্রলীগের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা।
আজকে এসব নেতা যখন ছাত্রলীগকে ভালো হওয়ার বা সুপথে চলার পরামর্শ দেন তখন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমোদ পান। এসব বক্তব্য যে মূল্যহীন তা তারা ভালোভাবেই জানেন। এ কারণে সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ যতই কমে আসছে ছাত্রলীগ ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের এখন একটাই ভাবনাÑ কিভাবে, কোন উপায়ে টেন্ডার ও নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক টাকার মালিক হবেন। এই প্রতিযোগিতা সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে ব্যবহার হয়েছে চাপাতি বা দেশীয় অস্ত্র। আবার কখনো অস্ত্র না পাওয়ায় হাত-পা ভেঙে দেয়া বা ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। ইতোমধ্যে তারা এসব অস্ত্র কেনার টাকা জোগাড় করে ফেলেছেন। এখন এসব অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। আর এতে নিহত হচ্ছে রাব্বী, বিশ্বজিৎ আর আবু বকরের মতো নিরীহ সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রীয় সমর্থনে এখন ছাত্রলীগ নামের এক দানব দেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।
alfazanambd@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন