আবার একটি হরতাল পালিত হলো দেশব্যাপী। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে প্রকম্পিত হলো মানুষ। দাবি আদায়ের মিছিলের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হলো সহস্র কণ্ঠ। গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার আর জুলুম-নির্যাতনের অবসানই ছিল জনতার দাবি। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাপ্তি কোথায়? পথের শেষ কোথায়? কোথায় সমন্বয়, পরমত সহিষ্ণুতা? কোথায় গণতান্ত্রিক সমানাধিকারে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস? মুক্তির দিশারী মানুষ আজ নানা প্রশ্নে উত্তর জানতে চাচ্ছে।
যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের একমাত্র পরিণতি ও সমাপ্তির নাম বিজয়। আজ কিংবা পরে সেই বিজয় আসবেই। ইতিহাসের এটাই শিক্ষা। বিজয়ের পথ সহজ নয়; কুসুমাস্তীর্ণও নয়। বিজয়ের পথ হলো সংগ্রামের পথ। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস নতুন নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। সংগ্রামের মহাসড়ক পেরিয়েই স্বাধীন হয়েছে। অতএব সংগ্রাম হলো ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজকের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও প্রেক্ষাপট কারও কাছে অজানা নয়। সুশাসন ও সর্বদলীয় গণতন্ত্রের জন্য আজকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সংগ্রাম করতে হচ্ছে হীন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে। মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার ডাকেই মূলত হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। একদলীয় বা বিদ্বেষভরা কলুষিত মনে এই আন্দোলনকে দেখার মাধ্যমে কেউ কেউ এই সংগ্রামের বিরোধিতাও করছে। পক্ষ-বিপক্ষ যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনায় থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক। কিন্তু প্রতিপক্ষকে একতরফাভাবে নিধন করার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়ার তো কোনো কারণ নেই? এমন করা হলে জনক্ষোভ বাড়ে বৈ কমে না।
গণতন্ত্রে শাসন হয় সকলের সম্মতিতে। পুলিশ বা শক্তি দিয়ে যে শাসন, সেটা গণতন্ত্রের বিপরীত। গণতন্ত্রে মতপার্থক্যও দূর করা হয় আলাপ-আলোচনায়, সমঝোতায়। শক্তির খেলায় বা প্রতিপক্ষ নিধনের উৎসবে সমঝোতার ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণেই সকলের মনে প্রশ্নটি জেগেছে যে, সঙ্কটের শেষ কোথায়?
নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা চায়। রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিটি দলই নিজ নিজ বক্তব্য দেয়ার অধিকার চায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। এটাই গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রে একজন মানুষও যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, সেটার প্রতিও সম্মান জানাতে হয়। বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে কি? সমঝোতা হচ্ছে না; ভিন্নমত শোনা হচ্ছে না। তা হলে কী হচ্ছে?
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই আকাশ থেকে পড়েনি। মুসলিম লীগের পেটের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন নির্বাচনে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অংশও নিয়েছে। আজকে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, একদা তারাও বিরোধী দলে ছিল। বিরোধী দল বিএনপি কখনও প্রধান শক্তি হয়েছে; কখনও প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। জামায়াত, জাতীয় পার্টি সময় সময় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে মজার ব্যাপার। যারা কোনো দিন সংসদে যেতে পারেনি; এমনকি জামানত পর্যন্ত রাখতে পারেনি; এরাই বড় বড় কথা বলছে। শুধু বলছে না, সরকারকেও সেটা মানতে বাধ্য করছে। জনগণ ভোট দেয় না, নিজেদের জনশক্তি ও জনপ্রিয়তা নেই, তারা কি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে? কে বা কোন দল রাজনীতি করতে পারবে; কার কি শাস্তি হবে; কাকে নির্মূল করা হবে; মধ্যযুগীয় রাজার মতো তারা সেটা আগে-ভাগেই ঠিক করে দিচ্ছেন? একদল ফতুর বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে তারা যেটা করছেন, সেটা হঠকারিতা, উস্কানি ও বিশৃক্মখলা। এদের কথা শুনলে যে দেশের বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করা হয়, সে খেয়ালও নেই। সবাই জানতে চায়, এদের শক্তির উৎস কি? জনগণ ও জনইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এরা কার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চায়?
বন্ধুবেশী স্তাবকের চেয়ে শত্রু ভালো। বাংলাদেশের ইতিহাসই এ কথা বলে। স্বাধীনতার পর কিভাবে দেবত্বারোপ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে আর গণতান্ত্রিক সিংহ পুরুষকে একদলের নেতা বানানো হয়েছিল, সেটা জ্বলজ্বল করছে। সেসব বন্ধুরা পরে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শ্রমিক হিসাবে খাল কেটেছে। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে লাল-ঝান্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকারের ক্ষমতার বৃত্তে এবং পদ-পদবীতে এরাই এখন এগিয়ে। পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও এদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা। এরাই আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগকে বিচ্যুৎ করছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুরোধা ও বাংলাদেশের প্রধান দলের ঐতিহ্য থেকে অতীতের মতো বিচ্ছিন্ন করছে। আজকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দলের দূরত্ব ও ওয়ার্কিং রিলেশন্স খারাপ করার পেছনে এদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এতে কার কি লাভ হয়েছে কে জানে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের। প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে দলটিকে কাজ করতে হচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাতে সকলকে সঙ্গে রাখলেও কেউ তেমন কিছুই করতে পারতো না। আওয়ামী লীগের সুনাম ও ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হতো।
এখন অবস্থা কি সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। বিদেশী বন্ধুরা পর্যন্ত সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত ও লজ্জিত হয়ে গেছে। যেসব আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বিবেকের কারণে কিছু সত্য কথা ও সদুপদেশ দিচ্ছেন, তারা পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নব্যশক্তিধর নেতাদের দ্বারা। যাকে-তাকে যখন-তখন স্বাধীনতাবিরোধী/মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই যে প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র ঘাপটিমারা মতলববাজরা তৈরি করেছে, সেটা থেকে রাবণের চিতার মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে হিংসার আগুন। সাধারণ মানুষ, শান্তিপ্রিয় নাগরিক এর থেকে বাঁচতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের, আইনের ন্যায়ানুগ প্রয়োগের নিশ্চয়তা চায়। হরতালে, অবরোধে, মিছিলে, মিটিংয়ে জনতা জানতে চায়, পথের শেষ কোথায়? কোথায় মুক্তি? এই প্রশ্নের উত্তর জানা দিনে দিনে জরুরি হয়ে উঠছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন