শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৩

নবী দিবস হোক নবীজীবনের আদর্শে গড়ে ওঠার সংকল্পের দিন



 বছর পরিক্রমায় আবার বিশ্বমানবতার মুক্তিদিশারী নবী মোস্তফা (সা.)-এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস আমাদের সামনে হাজির। বিশ্বময় শেষ নবী আগমনের এ দিবসটিতে মুসলমানরা তার জীবনের শিক্ষা-আদর্শ অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তোলার নতুন প্রেরণা লাভ করে। বিশেষ করে মহানবীর আবির্ভাবের প্রাক্কালীন মুহূর্তের অন্ধকার যুগ, যে সময় মানব সমাজ চরম এক নিষ্ঠুর পাশবিক অবস্থার যাঁতাকলে নিষিত হচ্ছিল। নবীজীর আদর্শের অনুসরণে তখনকার মানুষ কিভাবে মুক্তি পেয়েছিলেন, এদিনে গোটা মুসলিম উম্মাহ সেই অবস্থার কথা স্মরণ করে এবং চলমান অবস্থায়ও ঐ সকল অশান্তির কার্যকারণ থেকে নিজ দেশ ও সমাজকে রক্ষায় দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে। নিজেদের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনের সকল অশান্তি এর কার্যকারণসমূহ দূর করে মহানবী (সা.) ও ইসলামের জন্য তার নিবেদিত প্রাণ সাহাবীদের জীবনের শিক্ষা-আদর্শের অনুসরণের জন্য নতুন করে শপথ গ্রহণ করে। বলাবাহুল্য, গত দেড় হাজার বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ শত প্রতিকূলতার মাঝেও এভাবেই মুসলিম উম্মাহ ইসলামকে ও জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের ইসলামী পরিচিতিকে ধরে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দও এ উপলক্ষে মিডিয়াতে বিভিন্ন বাণী দিয়ে দিনটির গুরুত্ব উপলব্ধি এবং মহানবী (সা.)-এর জীবনের শিক্ষা আদর্শ অনুসরণে নিজেদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদাত্ত আহবান জানিয়ে থাকেন। তবে শুধু কোনো বিশেষ ইসলামী দিবসই নয়, ইসলামের যে কোনো কাজে তার বাস্তব অনুশীলন ব্যতিরেকে নিছক আনুষ্ঠানিকতার কোনো মূল্য নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের বর্তমান যেই প্রেক্ষাপটে এবার মহান ও পবিত্র নবী দিবসের আগমন ঘটেছে, এই প্রেক্ষাপটের অসংখ্য ঘটনা এটারই প্রমাণ দিচ্ছে যে, জড়বাদী জীবনবোধ কেন্দ্রিক কোনো জীবন ব্যবস্থা ও কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতিই মানবতার কল্যাণ আনয়নে সক্ষম নয়। তাতে বাহ্যিক চাকচিক্য থাকলেও তা নি্রাণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে সমস্ত ঘটনাবলীর খবরাদি নিয়ে প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়, অতীতের কথা যাই হোক, বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল স্তরের শান্তিকামী মানুষ এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত হতাশ ও উদ্বিগ্ন যে কোন্ পথে শান্তি আসবে? কারণ যেই মুসলিম উম্মাহকে খোদায়ী বিধানগ্রন্থ আল-কুরআন দিয়ে মহাস্রষ্টা শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, মুসলিম উম্মাহর যেসব নেতা নিজ দেশকে তার আনীত সেই বিধান ও আইন-কানুন দ্বারা কল্যাণ রাষ্ট্র মদীনার অনুকরণে প্রতিষ্ঠা করে জগতবাসীকে সেদিকে আহবান করবেন। তাদেরও অনেকে এ ব্যাপারে অজ্ঞতা, হীনমন্যতাবশত এ থেকে বিমুখ। ফলে আজ সর্বত্র মানবতা হাহাকার উচ্চারিত। এই পরিস্থিতিরই দাবি হলো, পবিত্র নবী দিবসে গতানুগতিক কোনো দিবস পালন নয় এবং নয় কোনো নিছক আনুষ্ঠানিকতার বাণী প্রেরণ বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে ক্ষতিকর বিষয় ও এর যেসব কার্যকারণ মহানবী (সা.) যেই পদ্ধতিতে দূর করেছেন, সেই নীতিরই অনুসরণ করা। তা না করে- ‘চট্টগ্রামে যাবার কথা বলে উত্তর বঙ্গগামী ট্রেনে বসার' মতো অনুসৃত নীতি অবলম্বন দ্বারা যেমন কিছুতেই মহানবীর আদর্শের অনুসরণ হবে না, তেমনি অপরাধপ্রবণ, শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনও সম্ভব নয়। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আনীত ‘দীন ইসলাম' তথাকথিত কোনো ধর্ম নয়, এটি মহান আল্লাহর ভাষায় ‘দীন' -জীবনব্যবস্থা, যা তিনি সর্বকালের সর্বযুগের উপযোগী করে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন। আবার সাথে সাথে তিনি পবিত্র কুরআনে রাগতস্বরে এই মানসিকতার এক শ্রেণীর মুসলমানকে লক্ষ্য করে বলেছেন যে, আফাতুমিনূনা বি-বা'দিল কিতাবে ওয়া তাক ফুরুনা বিবাদ?- ‘তোমরা কি আমার আইন ও বিধান গ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো? (তা কখনও গ্রাহ্য হবে না)। -উদ্খুলূ ফিস্সিলমি কাফ্ফাহ - ‘ইসলামে পরিপূর্ণরূপে দাখিল হয়ে যাও।' তিনি নিখুঁতভাবে তার বিধান প্রতিষ্ঠায় মানুষের ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্যে শেষ নবীকে ‘সুন্দরতম আদর্শ' উস্ওয়া-এ-হাসানা রূপে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর রাসূলও হাদীস শরীফে বলে গেছেন,- ‘আমার উম্মতে বনি ইসরাইলের মতো এক সময় বহু দল উপ-দলের সৃষ্টি হবে। তবে একমাত্র পবিত্র কুরআন ও আমার সুন্নাতের পরিপূর্ণ ও নিষ্ঠাবান অনুসারী ছাড়া সকলেই জাহান্নামী হবে।' মহানবী (স.) এ জন্যে আরও সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, ‘তোমরা যতক্ষণ কুরআন সুন্নাহর পূর্ণ অনুসারী থাকবে, কখনও বিপথগামী হবে না।' বলাবাহুল্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলিম-। অমুসলিম সকল সমাজেই বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান সমাজে আজ যেসব সমস্যা ও অশান্তি বিদ্যমান তার একমাত্র কারণ হচ্ছে ইসলামের ওপর মুসলমানদের খন্ডিত আমল। এ কারণেই জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারক বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থেকেও ইসলাম সম্পর্কে এই ভ্রান্ত ধারণার ফলে নিজেকে মুসলিম ও পাক্কা মুমিন বলে দাবি করলেও বহু মুসলিম নেতৃত্ব জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে ইসলামের ক্ষতি করে যাচ্ছেন আর তাদের নেতৃত্বাধীন শোষণমুক্ত, অপরাধমুক্ত কোনো ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। আর এই অবস্থার সঙ্গে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবনবোধকেন্দ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রভাবতো আছেই। ফলে আমাদের অনেকেই ইসলামের ওপর খন্ডিতভাবে আমলের দ্বারাই ইসলাম ও নবী জীবনের আদর্শের ওপর পূর্ণ আমল হয়ে যায় ধরে নিয়ে বসে আছেন। এ দ্বারাই জান্নাত লাভের দৃঢ় আশা করছেন। বর্তমান জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থা এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির অবশ্যম্ভাবী অমানুষিক পরিণতি ও ব্যর্থতা লক্ষ্য করেই আজ সকল শ্রেণীর মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে আত্মজিজ্ঞাসায় লিপ্ত হওয়া এবং নিজেদেরকে খন্ডিত ইসলাম ও খন্ডিত নবী অনুসরণে মুক্তির ধারণা থেকে পরিপূর্ণ ইসলাম ও নবীজীবনের পরিপূর্ণ অনুসরণের দিকে নিয়ে আসা। নবী দিবসের এই মোবারক দিনে সকল মুসলমানের কর্তব্য হলো নবীজীবনের উল্লেখিত পূর্ণ আদর্শের অনুসরণের বজ্র কঠোর শপথ গ্রহণ করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads