মাসুদ মজুমদার
বিচার বিভাগ নিয়ে জনগণ কখনো ভরসার ওপর দাঁড়াতে পারছেন না। একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন বিচারপতি। স্বচ্ছতার সাথে একটি ট্রাইব্যুনাল চালানোর ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগ হতাশ করল। এখন চোর অভিযুক্ত হচ্ছে না, কে চুরি করা দেখে ফেলল তাকে দোষী করার তোড়জোড় লক্ষ করছি। প্রযুক্তির জালে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও সরকারের অভিলাষ শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হলো না, ধরা পড়ে গেল অনেক অনাকাক্সিত বিষয়-আশয়। জনগণের কাছে প্রতিহিংসার রাজনীতির বর্ধিত সংস্করণের মতোই বিচার বিভাগও দায়মুক্ত থাকল না। তাই একটি-দু’টি ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের রায় কিভাবে গ্লানিমুক্তির বিষয় হয় বোঝা কঠিন। এক দিকে অযোগ্যতা, অন্য দিকে আজ্ঞাবহের ভূমিকাÑ এখন দুদক একটি গোঁজামিল দেয়ার প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছুই নয়। দুর্নীতি পদ্মা সেতুকে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবিয়েছে। আর দুদকের ইমেজ ডুবেছে ভূমধ্য সাগরে। নির্বাচন কমিশন কয়েকটা স্থানীয় নির্বাচন করে বেশ ফুরফুরে মেজাজ দেখালেও ইতোমধ্যে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটিও নির্বাহী বিভাগের কাছে যে জিম্মি, তার স্বাক্ষর রেখেছে। তা ছাড়া এই মেরুদণ্ডহীন কমিশন এখনো গরিষ্ঠ দলের কাছে স্বীকৃতি পায়নি। কিছু সন্ত্রাসীর ফাঁসি মওকুফ করে রাষ্ট্রপতির প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তার ওপর সংসদে বিতর্কিত ভাষণ। এ যেন অভিভাবকত্বের জায়গাটিকেও অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভাসিয়ে দেয়া হলো।
তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। সম্পর্কের টানাপড়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির খেসারত নিয়ে জনগণ এখন কম বিব্রত নয়। সেই অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য এখন পররাষ্ট্রনীতিতে ইউটার্ন নিতে হচ্ছে, যা বাকশালীয় ধারায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনেরই আলামত স্পষ্ট করেছে। ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার সপক্ষ-বিপক্ষ শক্তির মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিচ্ছেন এই ইউটার্নকে সহজ করতে; একই লক্ষ্যে দুরভিসন্ধিমূলক উসকানি দিচ্ছেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এর সহজ সারমর্ম দাঁড়ায়Ñ ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির দিকে ভারত শুধু ইঙ্গিতই দিচ্ছে না; বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটা সস্তা রাজনীতির মুলোও ঝুলিয়ে রাখতে চাচ্ছে। এটাও বাকশালী ধারায় নিয়ে যাওয়ার কূটনৈতিক ফন্দি। হয়তো ঝুলানো মুলা চেখে দেখতে কেউ দিল্লি যাবেন, দিল্লি থেকে কেউ আসবেন ঢাকায়।
হালে নতুন করে বিশ্বব্যাংকের সাথে টানাপড়েন বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সরকার দ্বারা শুধু বিড়ম্বিত হয়নি, অবিবেচনাসুলভ আচরণও পেয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বকে পাশ কাটানো কিংবা ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য এ সরকার বাকশাল আমলের মতো রুশ-ভারত অক্ষশক্তির চরণে নিজেকে সোপর্দ করেছে। ধসে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ছিল না। বন্ধু ছিল তাদের, যারা মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা খুলে আনুগত্য দেখাত। তবে মুক্তিযুদ্ধে তারা ভারতের সাথে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে বাকশাল চাপানো ও গণতন্ত্র হত্যার দায় সেই সোভিয়েত রাশিয়ারও রয়েছে। রুশপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে সওয়ার হয়েছিল সেদিন, ঠিক আজকের মতোই।
একাত্তরই শুধু আমাদের শত্রু-বন্ধু চেনায়নি, ১৭৫৭, ১৮৫৭ ও ১৯০৫-এর পথ ধরে ১৯৪৭ হয়ে আমরা ১৯৭১-এ পৌঁছেছি। সব সময় রাশিয়া আমাদের মিত্র ছিল না, বরং জোটবদ্ধ বিশ্বে তারা ছিল প্রতিপক্ষ। এই পথচলা ও সিঁড়ি ভাঙতে আমরা ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি মাত্র একবার। প্রতিপক্ষে পেয়েছি সাতবার। এই জনপদের স্বাধীনতার পাটাতনটি এক দিনে তৈরি হয়নি। সেটা পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা আজকের রাশিয়া-ভারত সৃষ্টি করে দেয়নি, বরং প্রতিটি পর্বে রুশ-ভারতের ভূমিকা জনগণ জানেন। বঙ্গভঙ্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপট এখনো তাজা ইতিহাস। শিক্ষামন্ত্রী সিলেবাস পাল্টে ভাসানীকে আড়াল করতে পারেন। পূর্ব বাংলাকে আড়াল করাই ছিল যাদের অভিলাষ, আমাদের জাতীয় নেতাদের নাম উচ্চারণে যারা নাক সিটকাত, তারাই বন্ধু সেজেছেÑ এ সত্য ক’দিন আড়াল করে রাখবেন। একাত্তরে ভারত যা করেছে তার যোগফল ভারতের স্বার্থানুকূলে ছিল বলেই ভারত এগিয়েছে। এত টনটনে দরদ ও স্বাধীনতার ফেরিওয়ালা হলে কাশ্মির, সেভেন সিস্টারসহ মাওবাদীদের কান্না থামে না কেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মদদ দিয়েছে পরাশক্তির অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলে ঢুকতে না দেয়ার শর্তে। তাই বলে এ দেশের মানুষের মাথা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও চীন কেউ কিনে নেয়নি। অসংখ্য মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশের মানুষের আলাদা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানীর মতো জাতীয় নেতারা কাঁধ পেতে দিয়েছিলেন বলেই একটি পরিণত সময়ে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন দাবির পথ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিতে পেরেছিলেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ কাউকে বড় করার জন্য অনেককে ছোট করা হয়। অনেককে অপাঙ্ক্তেয় করার জন্য কারো কারো পে মিথ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সভাপতি, যাকে তিনি পা ছুঁয়ে কদমবুচি করতেন, সেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে যান। কারণ তিনি ছিলেন বাংলাদেশপন্থী, ভারত ও রুশপন্থী নন। অথচ কিংবদন্তিতুল্য জাতীয় নেতাদের পথ মাড়িয়ে তিতুমীর, শরীয়ত উল্লাহ, মুনশী মেহেরুল্লাহর মতো সাহসী মানুষের পথচলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আজকের এই বদ্বীপ বাংলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ নজরুল, জসীমউদ্দীন, ফররুখ, আব্বাসউদ্দীনদের রাজনীতির আড়ালে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সামনে আনা হচ্ছে এমন এক ইতিহাস যার সাথে এ জাতি পরিচিত নয়।
বর্তমান সরকার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অনেক খারাপ বা মন্দ উপমা রেখে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছেন এ সরকার শেষ সরকার নয়। এসব মন্দ কাজ তাদের ওপর প্রয়োগ করা যে হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে। প্রতিপক্ষ ও জনগণ যখন প্রতিশোধ নেবে, তখন রুশ-ভারত সাথে থাকবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য রাজনীতির একটি নিজস্ব ভাষা আছে। সেটা সংবিধান সংশোধন করে, প্রশাসন দলীয় মেজাজে সাজিয়ে, এমনকি নিজেদের অধীনে নির্বাচন করেও পছন্দমতো পরিবর্তন আনা যায় না। সব সময় দুয়ে দুয়ে চারের মতো মিলিয়ে দেয়া যায় না। তা ছাড়া এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব যে, ইতিহাসকে আড়াল করে রাজনীতি বেশি দূর এগোয় না। বর্তমান শাসকেরা ইতিহাসকে আড়ালে রেখে হাজার বছরের অর্জনকে ভুলে তাৎক্ষণিক পাওনা বুঝে নিতে ব্যস্ত। সে কারণে শাসনে-শোষণে জাতি এখন জর্জরিত। দুর্নীতি আর অপশাসনে ক্ষতবিক্ষত। সাধারণভাবে জনগণ কখনো দুর্বিনীত হয় না। হঠকারী হয় না। একটি ভালো সময়ের জন্য নাক উঁচু করে অপেক্ষা করে। প্রথম সুযোগেই সরকার পাল্টে দেয়। বিগড়ে যাওয়া জনমতও অনেকটা আশাবাদী করে; যদিও মরিচের গুঁড়া ও মারণঘাতী পিপার গ্যাস ছিটিয়ে জনগণের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নিপীড়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট পদক পাইয়ে দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আস্ফালন ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালছে। তার পরও আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ, শাসকেরা জনগণের কাছে আবার ভোটভিক্ষার সুরে কথা বলছেন। প্রতিপক্ষকে নিন্দাবাদ করে সমালোচনার তীর ছুড়ে জনগণকে কাছে পেতে চাইছেন। এখন জনগণ পরখ করার সুযোগ নেবেন। যদিও সরকারের সামনে বহুদিন ক্ষমতায় থাকার আলাদা রূপকল্প রয়েছে। বর্তমান সরকার স্বচ্ছ নির্বাচনে যে নিজেদের অবস্থান ভালো হবে না এই সত্যটুকু জেনে গেছে। তাই নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য যা যা করার প্রয়োজন করবে। তার পরও অনিশ্চয়তা না কাটলে নির্বাচন করার সব প্রক্রিয়া যে ভণ্ডুল করে দেবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তাদের সামনে পথ খোলা থাকবে- নিরাপদ অবতরণের জন্য একটা ন্যূনতম নিশ্চয়তা নিয়ে তৃতীয় পক্ষকে আমন্ত্রণ করে ডেকে নিয়ে আসা। সে জন্য যেকোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে এ সরকার প্রস্তুত থাকার ঐতিহ্য রয়েছে। সেই সক্ষমতা তারা এখনো হারায়নি। সে কারণেই রাজনীতির ভাগ্য সম্ভবত পদ্মা সেতুর ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে।
সরকার মনে করে, পদ্মা সেতু না হলে একটা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায় জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিয়ে পার পাওয়া যাবে। কিন্তু দুর্নীতি হাতেনাতে প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে ধোঁয়াশা অবস্থায় রেখে দিলে পদ্মা সেতু হবে না। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে রাজি হবে না। তাতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের, সরকার হিসেবে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জনগণ পদ্মা সেতু করতে না পারার বিষয়টি শুধু ব্যর্থতার দৃষ্টিতে দেখবে। তখনো দুর্নীতির দায় আলো-আঁধারির অন্ধকারে থেকে যাবে। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা মতো তদন্ত না করলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এগিয়ে আসবে না, এটা বোকাও বোঝে। তার পরও সরকার ভাবছে, জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দ, বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী আবাসিক প্রতিনিধিকে রাজনীতি শুরু করার নসিহত ও ড. ইউনূসকে দায়ী করে জনগণকে বোকা বানানো সম্ভব হবে। কিন্তু সঠিক তদন্ত হলে সরকার বিশ্বচোরের খ্যাতি থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পাবে না। এ দায় নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাওয়া সহজ হবে না। তাই বিশ্বব্যাংক না আসুক, পদ্মা সেতু না হোক, দুর্নীতিও চাপা পড়ে থাকÑ যুক্তরাষ্ট্রও কাছে না ঘেঁষুক, পোশাক ও অন্যান্য খাত ডুবে যাক, তাতে দেশের ক্ষতি হলেও এটা সরকারের নগদ চাওয়া পূরণ হবে, কারণ ক্ষমতা আবার তাদের পেতেই হবে। ইতোমধ্যে রুশ-ভারতের দিকে কেবলা পরিবর্তন করে সরকার ভাবছে সব মুশকিল আসান হলো। দুর্ভাগ্য, রাশিয়া এখন শুধু পশ্চিমা ভাঁড় নয়, অন্যতম দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যও। অবস্থানও বাংলাদেশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিকভাবেও ধরাশায়ী। পরমাণুর কারণে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেও বিশ্বে তাদের প্রভাবের ধস আগেই নেমে গেছে।
যেকোনোভাবে জিতে আসার নিশ্চয়তা না পেলে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টিও পদ্মা সেতুর ধারায় এগোবে। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার দাবি মেনে নির্বাচন করে জেতা সম্ভব নয়Ñ এটি এখন স্পষ্ট, যা আগেও উল্লেখ করেছি। তাই নির্বাচন করে হেরে অতীত অপকর্মের দায় নেয়ার চেয়ে ক্ষমতা তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দেয়া অধিকতর নিরাপদ ভাবা অনেকেরই অভিজ্ঞতার ফসল। সরকার যে জবরদস্তির পথ ধরে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও আইন-আদালত অপব্যবহার করে আবার ক্ষমতা কব্জা করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠবে, তা তারা গোপন রাখছে না। সরকার ধারণা করছে, আবার যেভাবেই হোক ক্ষমতা কব্জা করা সম্ভব হলে কম করে আরো আড়াই-তিন বছর পার করে দেয়া সম্ভব। দেশটাকে কারাগারে রূপান্তÍর করে হলেও সেই চেষ্টা এখন শাসক ও তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের মগজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবে মানুষ ভাবে এক, বিধাতা ভাবেন অন্যটা। তা ছাড়া পরিবর্তনকামী জনগণকে আর বোধ করি দাবিয়ে রাখা সহজ হবে না।
সত্যাশ্রয়ী ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে জনগণই শেষ ভরসা ও সব পরিবর্তনের নিয়ামক। তাই রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নির্বাচন পদ্মা সেতুর ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে ধরে নিলেও কিছু কথা থেকে যায়। জনগণকে যে পরিমাণ বোকা ভেবে সরকার মাঠ সাজাচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেতাকে মামলায় ফাঁসানোসহ বিরোধী জোটকে ছত্রখান করে দেয়ার ফন্দি আঁটছে, জনগণ কি অতটা বোকা? সম্ভবত নয়। ক্ষমতার জোরে রেলের ও পদ্মা সেতুর কালো বিড়াল আড়াল করা হয়তো সম্ভব, বিডিআর ট্র্যাজেডি ভুলিয়ে দেয়াও সহজ, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারিও চাপা দেয়া তেমন অসম্ভব কী। শেয়ারবাজার ধসও ভুলিয়ে দেয়া অসম্ভব নয়। ইলিয়াস আলী, সাগর-রুনিসহ অনেক ক্ষতই কথার প্রলেপে ঢাকা পড়ে যেতে পারে। তাই বলে দিনবদলের নামে পুকুরচুরি ভুলিয়ে দেয়া যাবে কি! দেশের সবাইকে একসাথে বোকা সাজিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।
এ ধরনের একটি মূল্যায়নের পরও রাজনীতির শেষ ভাষা ফুরিয়ে যায় না। তা ছাড়া সরকারি দল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে, জোটকে সাথে নিয়ে আক্রমণভাগে খেলে ১৮ দলীয় জোটকে রক্ষণভাগে ঠেলে দিতে চাইছে। অংশত সক্ষমও হয়েছে। তাদের এই কৌশল অপশাসন ও দুর্নীতি চাপা দেয়ার একটি বড়সড় পরিকল্পনার অংশ। তাদের ধারণা, বিরোধী দলকে প্রচণ্ড চাপে রাখলেই পরিস্থিতি পাল্টে না গেলেও বাড়তি সুবিধা, সুযোগ ও সময় পাবে সরকারি দল। সম্ভবত সরকারি দলের এমন পরিকল্পনাও বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। ফলে বিরোধী দলের ঐক্য ছাড়া এখন আর হারানোর কিছুই নেই। ইসলামপন্থীদেরও আর ‘বিসর্জন’ দেয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেউ কেউ মনে করছেন, বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে হলেও কিছু পূর্বশর্তের প্রশ্ন উঠবে। গ্রেফতার, মামলা প্রভৃতি হবে চাপ সৃষ্টি করে আলোচনায় বসানোর ইস্যু। সম্ভবত এই সনাতনী রাজনীতি চর্চাও সরকার করতে চায়।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের ভেতর একটি উপদল যাদের দুর্নীতি গিলে খায়নি, তারা রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি খেলায় থাকতে চান। তারা মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপÑ বিশেষত জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের সাথে আর দূরত্ব সৃষ্টি না করাই ভালো। রুশ-ভারতকে দিয়ে এই চাপ মোকাবেলা সম্ভব নয়, বরং আন্তর্জাতিক তদারকি মেনে নিয়ে অবয়ব পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণা মেনে নেয়াই কল্যাণকর হবে। তাতে তারা এবার ক্ষমতায় না আসতে পারলেও বিরোধীদলীয় অবস্থান থেকে ভালোভাবে লড়ে যেতে পারবে। জনমতকে তাদের দিকে আবার টানার সুযোগও সৃষ্টি হবে। তাদের বাড়তি মূল্যায়ন হচ্ছে, বিগত চার বছরে সরকার যত ইস্যু দিয়েছে তার দু-একটি দিয়েই রাজপথের রাজা আওয়ামী লীগ সরকারকে কোণঠাসা করতে সক্ষম; যা বিএনপি-জামায়াত জোট পারেনি। এই মতের প্রভাব আরো বাড়লে শেষ মুহূর্তে সরকার ছাড় দিয়ে বিরোধী দলকে বাগে আনতে সচেষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হামলা, মামলা ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির শর্তও অংশত মেনে নেয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
মতলবি জরিপগুলো সরকারকে আশ্বস্ত করেনি, আত্মবিশ্বাসীও করেনি। গোয়েন্দা সূত্রে সরকার জনমত বিগড়ে যাওয়ার খবর রাখে। একটা পর্যায়ে গিয়ে কীর্তন যে থামাতে বাধ্য হবে তা-ও জানে। তবে শেষ চেষ্টায় তারা ত্রুটি করবে না। খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের পর আওয়ামী লীগ ভড়কে গিয়েছিল। ভেবেছিল এজেন্সি বোধকরি হাতছাড়া হয়ে গেল। তারা সম্ভবত ভারতীয় ভূমিকার ব্যাপারে হতাশও হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সতর্ক মানুষ। দিল্লি সফরের বাড়তি ডুগডুগি বাজাননি। ‘তেল মারার’ মতো শ্লাঘাও বোধ করেননি। তাতে দিল্লি হয়তো ভেবেছে চিঁড়া ভেজেনি। তাই পরীক্ষিত বন্ধুবিলাস তাদেরকে আবার পেয়ে বসেছে। আওয়ামী লীগ ও ঢাকায় ভারতীয় দূতের ঋজু মন্তব্যকে অনেকেই অনেকটা সরলীকরণ করে দেখছেন এবং উপভোগ করছেন। তাই আশাবাদীও। তবে ভারত যে সর্বত্র জাল ফেলে দিল্লি বসে টানে, তা কেউ ভুলে থাকতে চায় না। রাশিয়াও যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যহীন ও ক্ষয়িষ্ণু শক্তি তাও তারা জানে। সে ক্ষেত্রে কিছু প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের অতীত বিব্রতকর পরিস্থিতিও সামনে রাখার পক্ষে। তাতে আশাবাদ ফিকে হয়ে যায় কি না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। তা ছাড়া মস্কোপন্থীরা যে আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে প্রধানমন্ত্রীকে মস্কো পর্যন্ত ঠেলে নিয়েছেন, সেটাও সামনে রাখার পক্ষেই রয়েছেন নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগাররা।
এখন বিরোধী দল, পেশাজীবী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর যে পুলিশি তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা ব্রিটিশ যুগ এবং পাকিস্তানি যুগকেও হার মানিয়েছে। অতিউৎসাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য হয় ভারতীয় মন্ত্রীর মতো, নয়তো ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের দাম্ভিক আস্ফালনের মতো শোনায়। এ দায়ও মূলধারার আওয়ামী লীগ নিতে চাচ্ছে না। তাই সবাই কান পেতে আছে, কখন কিভাবে পরিবর্তনের দামামা বেজে ওঠে, সেটা শোনার জন্য। কারণ, সামগ্রিক আলামত যে ভালো নয়, সেটা সব মানুষের বিবেককে স্পর্শ করছে। কোন নেত্রী কার সাথে বৈঠক করছেন, কোথায় জল পড়ছে আর পাতা নড়ছে সবাই ঔৎসুক্যের সতর্ক চোখ দিয়ে দেখছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনগণ ফিস ফিস করে অনেক কথাই বলে, তার দু-একটি যে অতীতে ফলে যায়নি তা তো নয়।
এক-এগারোর ছদ্মবেশী সামরিক সরকার এতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল যে, অবতরণের মইটাও সরিয়ে ফেলেছিল। যার ফলে দুই নেত্রীর একজনের সাথে চুক্তি করে, বিদেশী সাহায্য নিয়ে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বর্তমান সরকারও বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন ১৮ দলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়ার শঙ্কায় এতটা উৎকণ্ঠিত যে, দেশের ও গণতন্ত্রের নাক কেটে হলেও ১৮ দলীয় জোটের যাত্রাভঙ্গের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। সেটা সম্ভব না হলে আরেকটি গণতন্ত্র বধ কাব্য লেখার ক্ষেত্র যে প্রস্তুত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
digantaeditorial@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন