মো: ফজলুল হক
চার বছর সময় একটি সরকারের জন্য ঢের সময়। যখন কোনো সরকার দেশ শাসন করে তখন তার সফলতা ও ব্যর্থতা দুই দিকই জনগণের চোখে ধরা পড়ে। প্রতি বছর শেষেই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও বিরোধী মহল সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্লেষণপূর্বক তাদের কর্ম পরিকল্পনাকে নবায়ন করে নেন। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই বলা যায় না, দিবসটি কেমন যাবে। কিন্তু বিকেল ৩-৪টার দিকে অবশ্যই সারা দিনের চিত্র সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। চার বছরের সফলতা বাকি এক বছরে যেমন ম্নান হয়ে যায় না, তেমনি চার বছর যদি উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে না পারেন তা এক বছরে গুছিয়ে নেয়া অনেক কঠিন। শেষ বছরে সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়ই নির্বাচনী বছর হিসেবে বিচেনা করে থাকে। সরকার যদি মনে করে তাদের বিগত চার বছরের সফলতায় জনগণ তাদের আগামী নির্বাচনে জিতিয়ে দিতে মুখিয়ে আছে, তাহলে তাদের শেষ বছরের কর্মকাণ্ড হয় এক রকম। আবার যদি জনগণের প্রতি সরকারের আস্থা অথবা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হয়, তবে সরকারের আচরণ হয় অন্য রকম। বিরোধীদের ঘায়েল করে দুর্বল করার কৌশলই এ ক্ষেত্রে সরকারের শেষ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। মহাজোট সরকারের চার বছরের সফলতা ও ব্যর্থতার একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা হতেই পারে তবে সরকার ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে সাফল্যগাথা তুলে ধরেছে। সঙ্গত কারণেই ব্যর্থতার বিষয়টিই আলোচিত হতে পারে ।
মহাজোট সরকারের চার বছরের ব্যর্থতার তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। এ ব্যর্থতাগুলো সর্বজন স্বীকৃত এবং বেশি তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ব্যর্থতার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো : (১) ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ার মার্কেটের বিশাল কেলেঙ্কারি। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বালখিল্য বক্তব্য শেয়ারবাজারের অস্থিরতাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির নেয়া সিদ্ধান্ত বাজারের উত্থান-পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। ুদ্র বিনিয়োগকারীরা পথে বসে গেছে, পকেট ভারী হয়েছে সরকারি ও বিরোধী দলের মদদপুষ্ট একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর। তদন্তে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত খলনায়কদের চিহ্নিত করা গেলেও আইনের মুখোমুখি করা যায়নি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। ফলে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশের সর্বত্রই আলোচনার ঝড় বইছে। অব্যাহত দরপতন ও মন্দাভাবের কবলে পড়ে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। শেয়ারবাজারে প্রায় ৩৩ লাখ ুদ্র বিনিয়োগাকারী সর্বহারা হয়েছেন। (২) বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার ১.২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা বলেই চিহ্নিত। বহুল কাক্সিত তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারিতে বেকায়দা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি রেলদুর্নীতি এবং হলমার্ক-ডেসটিনির অর্থ জালিয়াতি সরকারের ভাবমূর্তি ুণœ করেছে। (৩) অর্থনীতিতে ও ব্যবসায় বাণিজ্যে চরম মন্দা। দেশীয় ব্যাংকে রয়েছে ৪০ হাজার কোটি অলস টাকা। কিন্তু বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। চাঁদাবাজি, গ্যাস-বিদ্যুৎসঙ্কট ও নিরাপত্তাহীনতা এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে আছে। (৪) বিডিআর বিদ্রোহের ফলে ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যাসহ দেশের মানুষের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি। মহাজোট সরকারের সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে বিডিআর বিদ্রোহ। বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মৃত্যু সরকারকে নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এই বিদ্রোহের ক্ষত চার বছরেও সারাতে পারেনি সরকার। (৫) আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকার বিষয়ে সরকারের অর্জনের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। ক্রসফায়ার, গুম বা গুপ্তহত্যায় উন্নীত হয়েছে। ক্রসফায়ার হলে লাশ পাওয়া যেত। গুম বা গুপ্তহত্যায় তা-ও পাওয়া যাচ্ছে না। গুম ও গুপ্তহত্যার কারণে সরকার আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচিত হয়েছে। টিভি টকশোতে গিয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী আরেকজন সাবেক মন্ত্রীর চোখ তুলে ফেলার হুমকিও দিয়েছেন। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড ও বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ছিল চরম উদ্বেগের। ইলিয়াস আলীল গুম হওয়া ছিল সরকারের চরম ব্যর্থতা। (৬) সরকারদলীয় ও তাদের অঙ্গসংগঠনের লোকদের সীমাহীন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে অতিষ্ঠ দেশবাসী। জ্বালানি উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন বিদেশী তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়েছেন এ রকম অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। (৭) বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি ছাত্র সংগঠনের এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের অথবা বিরোধী ছাত্রসংগঠনের সাথে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের সদস্যদের টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ছাত্রলীগকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তোলা উচিত। এমন বেসামাল ছাত্রলীগ জীবনেও দেখিনি। ছাত্রলীগের ইতিহাসে এত বাড়াবাড়ি কখনো হয়নি। বেপরোয়া ক্যাডারদের সামলাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। (৮) হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোর চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে চরম সঙ্কটে ফেলা। (৯) ডেসটিনির মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার। (১০) ইউনিপে-টু-এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট। (১১) নতুন শিল্পকারখানা ও অ্যাপার্টমেন্টে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ না দেয়ায় শিল্প উৎপাদনে হ্রাস ও লাখ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। (১২) ব্যাপকভাবে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস। সুপার পাওয়ার আমেরিকার সাথেও বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ইস্যুতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। (১৩) মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে জনশক্তি রফতানি হ্রাস। বাংলাদেশী শ্রমিকদের সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া কমে গেছে এ সরকারের আমলে। সৌদি আরবে আকামা জটিলতায় হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ সমস্যা সমাধানে সরকার কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স কমে গেছে। (১৪) নতুন কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ায় বেকারত্ব বৃদ্ধি; (১৫) চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সারের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারেনি। সারের পেছনে কৃষক নয়, সারই কৃষকের পেছনে ছুটবে কৃষিমন্ত্রীর এ বক্তব্য অসার প্রমাণিত হয়েছে। কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। (১৬) কুইক রেন্টালের মাধ্যমে অনেক গুণ বেশি ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি মেটাতে এক বছরে ছয়-সাতবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, এর ফলে পণ্য উৎপাদন ব্যয়সহ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ফাঁদে পড়ে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। (১৭) সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি। (১৮) কূটনৈতিক অদূরদর্শিতায় ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হলেও তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। প্রটোকল ভেঙে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে গিয়ে সমস্যার সুরাহা করতে পারেননি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, অল্প কথায় সরকারের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণ বেশি। জঙ্গি দমন, শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি সেক্টরে সরকার সাফল্য দেখালেও সংসদ কার্যকর, রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা সৃষ্টি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, সড়ক যোগাযোগ ও পদ্মা সেতু অর্থনীতির গতিশীলতা আনাসহ আরো বেশ কিছু বিষয়ে সফলতা দেখাতে পারেনি।
দিনবদল ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি হয়েছে কমই। সরকারের পাঁচ অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসঙ্কট দূর করা, দারিদ্র্যবিমোচন ও বৈষম্য রোখা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। চার বছরে এই পাঁচ অগ্রাধিকারের কোনো কোনোটাতে আংশিক সফলতা অর্জিত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে। মেয়াদের শেষ বছরে দেশটাকে সরকার কিভাবে পরিচালনা করবে তার ওপরই নির্ভর করছে জনগণের সিদ্ধান্ত। তাই সরকার জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো বিবেচনায় রেখে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ পরিচালনা করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন