মানুষ শুধু খেয়ে-পরেই বাঁচতে চায় না, সম্মান নিয়েও বাঁচতে চায়। স্বদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষ যেমন অসম্মানিত হয়, তেমনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীরা যদি স্বদেশের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যায় কিংবা অহরহ গুলী করে হত্যা করে তাতেও মানুষ অসম্মান ও গ্লানির ভারে বিপর্যস্ত হয়। বর্তমান সময়ে সম্মান নিয়ে বাঁচা বা টিকে থাকা বেশ দুরূহ বিষয় হয়ে উঠেছে। অথচ সম্মান নিয়ে বাঁচতে না পারলে মানুষের বেঁচে থাকাটা অর্থবহ হয় না। তখন মানুষকে প্রাণীর মত বাঁচতে হয়। এমন বাঁচা কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের কিংবা কোন মানুষের কাম্য হতে পারে না। অথচ আলো ঝলমলে এই সভ্যতায় সম্মানের সাথে বসবাস করার বিষয়টি মানুষের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই বিবেকবান মানুষরা বলছেন, আলো ঝলমলে জাহেলিয়াতে এখন আমাদের বসবাস।
নতুন বছরের শুরুতে বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, প্রগতি ও মিলনের নানা বার্তা আমরা দেশে-বিদেশে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত নববর্ষের শুরুতেই আমাদের সৌহার্দ্যের এ কেমন বার্তা উপহার দিল? বছরের প্রথম দিনেই ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) দু'জন বাংলাদেশী নাগরিককে গুলী করে হত্যা করলো। না, এ কোন ভুল নয়: এর পরদিনও তারা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আর গত রোববার সকালে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শ্রীনাথপুর ও শ্যামকুড় সীমান্ত থেকে চার বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। এসব কি বন্ধুর কিংবা সৌহার্দ্যের উদাহরণ? ৭ জানুয়ারিতে আমি যখন এ লেখাটি লিখছি তখন পত্রিকায় একটি শিরোনাম হয়েছে, ‘‘বিএসএফের বর্বরতার শিকার ফেলানী হত্যার দু'বছর আজ’’। বিশ্ব বিবেকের কাছে কলঙ্কিত একটি দিন ৭ জানুয়ারি। দুই বছর আগে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারিতে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি সীমান্তে কিশোরী ফেলানীকে নির্মমভাবে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ৫ ঘণ্টা ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে বিএসএফ সদস্যরা ফেলানীর দুই হাত ও পায়ের ফাঁকে বাঁশ ঢুকিয়ে তাকে বহন করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবাসীরা এই নির্মম দৃশ্য দেখে চোখের পানি ফেলেছেন। ফেলানীর সেই লাশ ছিল অরক্ষিত, বিপন্ন ও রক্তাক্ত একটি সীমান্তের কলঙ্কজনক উদাহরণ। এমন দৃশ্যকেও কি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে? জানি না এসব হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা বীরত্বের কি উপাদান খুঁজে পান! অথচ বিশ্ববাসী জানে যে, নিরস্ত্র ও অসহায় সাধারণ মানুষকে হত্যার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই। আরো পরিতাপের বিষয় হলো, সীমান্তে অহরহ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রাখার নিষ্ঠুর বাতাবরণের মধ্যেই ভারত ও বাংলাদেশের শাসক-প্রশাসকরা বন্ধুত্বের জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন। প্রহসনের এমন মেলোড্রামা পৃথিবীর আর কোথাও লক্ষ্য করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মবিদ্বেষী নয়। পৃথিবীর সব দেশের সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের কাম্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব আরো বিশেষভাবে কাম্য। বাংলাদেশী নাগরিকরা ভারতীয় জনগণের সাথে মৈত্রীর বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে চায় কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভারতের শাসক-প্রশাসকদের আগ্রাসী ও অহঙ্কারী মনোভাব। সীমান্তে বিএসএফ-এর অব্যাহত হত্যাকান্ড তার বড় প্রমাণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর মাধ্যমে ভারতীয় শাসকরা কি অর্জন করতে চায়? ভারতীয় শাসকরা যদি নিজেদের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চায়, তাহলে তার মাধ্যম তো আগ্রাসন ও হত্যাকান্ড হতে পারে না। বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে প্রয়োজন হয় মহৎ ও ন্যায্য আচরণ। দুর্বলের ওপর জুলুম নির্যাতন ও আগ্রাসনে হীনমন্যতা ও কাপুরুষতার পরিচয়ই পাওয়া যায়। আর ইতিহাসের বার্তা হলো, জালিমের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তবে এক্ষেত্রে মজলুমের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মত দৃঢ়তা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রামের নৈতিক চেতনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শাসক-প্রশাসকদের মধ্যে এমন নৈতিক চেতনার অভাব প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা আমাদের জাতীয় লজ্জার বিষয়। নতুন বছরে আমরা শান্তি, মৈত্রী ও প্রগতির বিশ্বব্যবস্থা চাই। এমন বিশ্বের জন্য প্রয়োজন উন্নত মানবতাবোধ ও আত্মসম্মানের চেতনা। বিগত বছরগুলোতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সবল রাষ্ট্রগুলো। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আত্মসম্মানের কাঙ্ক্ষিত রোড-ম্যাপে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশা করবো নতুন বছরে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে বিবেকের বার্তা শুনবেন ভারতের শাসকবর্গ এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা রক্ষা এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে যৌক্তিক ভূমিকা পালনে সচেতন থাকবেন বাংলাদেশের শাসক-প্রশাসকরাও। কারণ সবল ও দুর্বল নির্বিশেষে সঙ্গত ভূমিকা পালনের মধ্যেই রয়েছে স্বদেশের ও বিদেশের কল্যাণ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন