বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৩

গত ৪ বছরের অর্থনীতির খতিয়ান


হারুন-আর-রশিদ

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের চার বছর শেষ হলো। এ সময়ে দেশের অর্থনীতির চালচিত্র কেমন ছিল, অগ্রগতি বা অবনতি কোন খাতে কতটুকু, তা বিশ্লেষণ করার জন্য এই লেখা।
মধ্যম আয়ের দেশ গড়া এবং জিডিপির ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু জিডিপি এখন পর্যন্ত ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের বয়স এখন ৪২ বছর। এই চার দশকে এশিয়ার দেশগুলোর সাথে স্বদেশের তুলনা করে লজ্জাবোধ করি। আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় মাত্র ৮০০ মার্কিন ডলার। অন্য দিকে মালদ্বীপ ও ভুটান চার অঙ্কের মাথাপিছু গড় আয় নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। যে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু গড় আয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর চেয়েও কম, তাদের অহঙ্কার শোভা পায় না। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিগত ১০ বছরে এটাই সর্বোচ্চ। ক্যাপিটাল মার্কেটে ুদ্র বিনিয়োগকারীরা ২০১০-এর শুরু থেকে ২০১২-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঁজি হারিয়েছেন প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এটাও আমাদের শেয়ারবাজারে দৈন্যদশার সবচেয়ে নজিরবিহীন ঘটনা। এ রকম বিপর্যয় একবার ১৯৯৬-২০০১  সালে (আওয়ামী লীগ সরকারই তখন ক্ষমতায় ছিল) ঘটেছিল।
বর্তমান শাসনামলে মুদ্রার মান কমেছে প্রতি ডলারের বিপরীতে ২৫ থেকে ২৬ টাকা। ২০০৮ সালে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে এক ডলারের বিনিময়ে ৫৬-৫৭ টাকা পাওয়া যেত। এখন এক ডলার পেতে চাইলে দিতে হয় ৮২ থেকে ৮৩ টাকা। এটাও বিগত ৪২ বছরে মুদ্রার মান কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় রেকর্ড। ২০১১ সালে এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৭৭ টাকা। স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে এক ডলার সমান ছিল ৪ দশমিক ৭৬ টাকা। ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান আর কোনো দেশে এত দ্রুত কমেনি। প্রতিবেশী ভারতেও ডলারের বিপরীতে রুপির মান এতটা কমেনি, বরং আন্তর্জাতিক মুদ্রার মানে বেড়েছে।
আমাদের দেশে টাকার মান যত কমছে, স্বর্ণের দাম তত বাড়ছে। বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি প্রায় ৬২ হাজার টাকা। স্বাধীনতার আগে স্বর্ণের ভরি ছিল ১২০ টাকা। আমরা মূল্যস্ফীতির টুঁটি চেপে ধরতে পারিনি ৪২ বছরেও। বাজার নিয়ন্ত্রণের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা না নেয়াই টাকার মান কমে যাওয়ার মূল কারণ। স্বর্ণের এবং খাদ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার নেপথ্য কারণ, অনিয়ন্ত্রিত বাজার। এই বাজারব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল না করে সিন্ডিকেট গড়ে সরকারি দলের লোকজনই রাতারাতি ধনী হচ্ছে। মুদ্রার মান কমিয়ে দিচ্ছেন সরকারি দলের ব্যবসায়ীরা। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তারাই পকেট ভর্তি করতে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশে সরবরাহ আর চাহিদার মধ্যে জটিল সমস্যা নেই। সমস্যাটা তৈরি করছেন ব্যবসায়ী নামধারীরা। বর্তমানে একটি লাউয়ের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা। বছর দুয়েক আগে দাম ছিল ২৫-৩০ টাকা। বিগত চার বছরে একমাত্র চাল ছাড়া কোনো পণ্যের দাম সহনশীল পর্যায়ে নেই। শাক আর মাছের দেশে এখন চড়ামূল্য দিয়ে কিনতে হয় পণ্য দুটো। দেশী মসুরডাল ১৫০ টাকা প্রতি কেজি। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ১১০ টাকা দরে মসুুরডাল বিক্রি হয়েছিল। মানে এক বছরে দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা। এ রকম মূল্যবৃদ্ধি কোনো দেশে হয়েছে বলে জানা নেই। এসব কারণে  টকশোতে বর্তমান সরকারকে হীরক রাজার সাথে তুলনা করছেন সুধীজন। সরকারের কথার সাথে কাজের মিল নেই। এ দিকে স্পিকার বললেন, দেশে যে অর্থনৈতিক দুর্নীতি হয় তা দিয়ে প্রতি বছর একটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। চরম দুর্নীতির কথা শুধু টিআইবি নয়, খোদ সরকারি দলের লোকজনও বলছেন। সবাই যখন এটা বলছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমার শাসনামলে দেশে কোনো দুর্নীতি হয়নি।’ খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। হলমার্কের এমডিকে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা যারা দিয়েছিলেন, তারা সরকারনিয়ন্ত্রিত সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট দুর্নীতির জ্বলন্ত প্রমাণ। ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান আছে ৩২টি। কার্যকর আছে মাত্র তিনটি।
১৭ ডিসেম্বর পত্রিকায় উঠেছে খোদ সরকারি ব্যাংক সোনালীর দুই শাখায় ২৫ কোটি টাকা লোপাটের খবর। ৮ ডিসেম্বর পত্রিকায় উঠেছে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি। এই ঘাটতি ৪০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতির কথা স্বীকার করেছেন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি। বলেছেন, ভারতীয় বিনিয়োগেরও বড় ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে।’ ২০০৭ সালে ভারতের বিনিয়োগ ছিল শূন্য দশমিক ১৬ কোটি ডলার। ২০০৮ সালে বিনিয়োগ এক দশমিক ১২ কোটি ডলার। ২০০৯ সালে বিনিয়োগ ছিল শূন্য দশমিক ৮ কোটি ডলার। ২০১০ সালে চার দশমিক ৩১ কোটি ডলার এবং ২০১১ সালে দশমিক ৫৭ কোটি ডলার। একমাত্র ২০১০ সালেই ভারত বাংলাদেশে বেশি বিনিয়োগ করেছিল, স্থানীয় মুদ্রায় যার অঙ্ক দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটি টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। বর্তমানে সিএনজি গ্যাস প্রতি লিটারের দাম ৩০ টাকা। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গ্যাসের প্রতি লিটার ছিল ৮ দশমিক ৫০ টাকা। বর্তমানে অকটেনের দাম লিটার ৯৪ টাকা এবং প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬১ টাকা। চার বছর আগে উল্লিখিত দু’টি জ্বালানির মূল্য এখনকার চেয়ে অর্ধেকেরও কম ছিল। বর্তমান সরকার আরো এক দফা জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে। পণ্যমূল্যের ওপর তা সরাসরি আঘাত হানবে। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি পেলে পণ্যের দাম বাড়বে, অর্থাৎ সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগের জন্য মূলত সরকারই যে দায়ী, এ কথা অস্বীকার করা যায় কিভাবে?
১৯ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের লিড নিউজ ছিলÑ দেশে দু’টি গণতান্ত্রিক সরকারের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) আমলে বিগত ১০ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে সোয়া লাখ কোটি টাকা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে, এরপর ২০১০ সালে। এতে স্পষ্ট, আলোচ্য সময়কালে গড়ে প্রতি বছর ১৪০ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুর্নীতি করে অর্জিত টাকা, কর ফাঁকি দিয়ে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা বলেছে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে সরকার ও মালিকপক্ষের গোপন আঁতাতে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। একই কথা বলেছে প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওয়ালমার্ট একাই বাংলাদেশ থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাকসামগ্রী ক্রয় করে থাকে। সামান্য কয়েক পেনিতে যে পোশাক বাংলাদেশ থেকে ওয়ালমার্ট কিনে নেয় তা আমেরিকায় বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ ডলার (টাকার অঙ্ক ৮১০-১২১৫ টাকা)। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের তুলনায় বাংলাদেশের গেঞ্জি ও সোয়েটারের মূল্য অর্ধেক। পোশাক শিল্পে আমাদের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। তাদের তুলনায় আমাদের দেশের উৎপাদিত পশমি কাপড়ের দাম বিশ্ববাজারে ১৭ শতাংশ কম। কম দামে পাওয়া যায় বিধায় বিদেশীরা বাংলাদেশে ভিড় জমায়। দুঃখজনক যে, কম দামে পণ্য বিক্রি হয় বলেই আমাদের দেশের পোশাকশ্রমিকদের নিম্ন বেতন দেয়া হয়। খুবই কম বেতনে চাকরি করেন এই শ্রমিকেরা। তাদের গড় বেতন মাত্র ৩৭ ডলার, অর্থাৎ মাত্র তিন হাজার টাকা। কর্মক্ষেত্রে তাদের ন্যূনতম নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও মালিকেরা ব্যর্থ। এ জন্য দায়ী বিদেশী বণিকেরা এবং দেশীয় পোশাক শিল্পের মালিকেরা।
একটি জাতীয় দৈনিকে ২৪ ডিসেম্বর উঠেছে, সরকারের ২২টি মন্ত্রণালয়ের ৪১টি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে চার হাজার ৮১১ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। বেশি দুর্নীতির আপত্তি রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। প্রতিবেদনে এ মন্ত্রণালয়ে এক হাজার ২৯২ কোটি ৭৭ লাখ টাকার অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ৮০২ কোটি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ৬৫১ কোটি ৮৮ লাখ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ৪০১ কোটি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৫৯৪ কোটি ৭৬ লাখ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ৪২৬ কোটি ৩২ লাখ, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ১১৬ কোটি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ১১২ কোটি, শিল্প মন্ত্রণালয়ে ৭৬ কোটি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ২২ কোটি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ২১ কোটি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ১৪ কোটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ কোটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ছয় কোটি ৯১ লাখ টাকার আপত্তি তোলা হয়েছে অডিট রিপোর্টে। এ ছাড়া ছয়টি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ১১টি মন্ত্রণালয়ের যুক্তভাবে ২৫৯ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। অডিট রিপোর্টের মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৯টি এবং ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ১১টি করে ২২টি রয়েছে। চার অর্থবছরে ৪১টি হিসাব প্রতিবেদনও তৈরি করে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (সিএজি) কার্যালয়। এসব প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০১৩ সালে এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়, সেটা দেখার প্রতীক্ষায় জনগণ।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলাম লেখক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads