সি রা জু র র হ মা ন
এ সন্দেহ অনেকেরই ছিল। আমি নিজেও কয়েকবার লিখেছি সে সন্দেহের কথা। এক-এগারোর ষড়যন্ত্রে লোক-দেখানো ‘মাইনাস টু’র কথা থাকলেও আসল লক্ষ্য ছিল ‘মাইনাস ওয়ান’। খালেদা জিয়া এবং সম্ভব হলে বিএনপি দলকেও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করে বাকশালী আওয়ামী শাসন চালু করা।
ফখরুদ্দীন-মইন উ বর্ণচোরা সামরিক শাসন অবশ্যই শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফসল ছিল। লগি-লাঠি-বৈঠার হত্যাযজ্ঞ, লাগাতার হরতাল আর সাবোটাজ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি হুমকি না হলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে রাজি হতেন না। মোক্ষম স্বীকারোক্তি করেছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল বিদেশ ভ্রমণে যাত্রার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার তার আন্দোলনেরই ফসল এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন। আসলেও হয়েছে তাই। বহু অপকর্ম-দুষ্কর্ম হয়েছে সে সরকারের দু’বছরে। কিন্তু তার জন্য কারও কি কোনো শাস্তি হয়েছে? ফখরুদ্দীন আর মইন উকে কি জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও এ সরকার আমেরিকা থেকে ফেরত আনতে পেরেছে?
আর সেই যে বিদেশ ভ্রমণের কথা বলছিলাম? মাইনাস-টু অনুযায়ী দুই নেত্রীকেই কিন্তু নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা হয়নি। চেষ্টা হয়েছিল বিএনপি নেত্রীকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর। সৈন্য-সামন্ত, গাড়ি-ঘোড়া তার বাসভবনেই এসেছিল তাকে বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে। সৌদিদের একখানি বিমানও নাকি প্রস্তুত ছিল বিমানবন্দরে। ইচ্ছে করলে খালেদা জিয়া কত শক্ত হতে পারেন তার প্রমাণ আবারও তিনি দেখিয়েছিলেন সে সময়। দুই নেত্রীকেই সংসদ ভবন সংলগ্ন বিশেষ কারাগারে বন্দী করা হলো। কিন্তু ‘দুই’ ব্যাপারটা সেখানেও ছিল লোক-দেখানো। এক নেত্রী বন্দী হয়েই রইলেন, আর অন্যজন গেলেন বিদেশে হাওয়া খেতে।
বলা হয়েছিল যে শেখ হাসিনা চিকিত্সার জন্য আমেরিকা যাবেন। আমেরিকায় গিয়েও ছিলেন তিনি। পুত্র ও তার পরিবার আছে সেখানে। আদরের নাতনি থাকে কানাডায়, সেখানে না গেলেই নয়। আবার বোনের ছেলের বিয়ে হবে লন্ডনে। বড় খালা হাজির না থাকলে কি চলে? হাসিনাকে লন্ডনে আসতেই হলো। বৌমা ফিনল্যান্ডের মেয়ে। অতএব নাইওর যেতে হলো হেলসিঙ্কিতেও। বলাই বাহুল্য, সর্বত্রই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন নেত্রী, দেশের রাজনীতির নোংরা কাঁথা বিদেশে ঝেড়েছেন। সবাই জানেন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিতে ‘বড়ই’ ভালোবাসেন, তার সবচাইতে প্রিয় বস্তু নিজের কণ্ঠস্বর।
বর্ণচোরা সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ নেত্রীর বিশ্ব ভ্রমণে বাধা দেয়নি, ‘বন্দী দশায়’ তার রাজনৈতিক তত্পরতায়ও আপত্তি করেনি। মইন উ আহমেদ জানতেন, হাসিনা তাদের অথবা তারা হাসিনার নিজের লোক। খালেদা জিয়াকে মাইনাস-ওয়ান করা না গেলে হাসিনা সেনাশাসনই মেনে নেবেন। নিজ মুখে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার শাসনের চাইতে সেনা শাসনও মেনে নিতে রাজি তিনি। তার প্রমাণ তিনি অনেক আগেই দিয়েছেন। ১৯৮২ সালে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করার জন্য তিনি লে. জে. এরশাদকে মদত দিয়েছিলেন। অনেকে তো বলেন, সেই ষড়যন্ত্রে তিনিও ছিলেন একজন হোতা। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি জেনারেল নাসিমকে দিয়ে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। সৌভাগ্যবশত আগাম খবর পেয়ে কয়েকজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা সে অভ্যুত্থান ভণ্ডুল করে দিতে পেরেছিলেন।
দেশের কাজ দেশে, বিদেশে নয়
অন্য নেত্রী দেশের মাটিকেই বেশি ভালোবাসেন। এটা তার স্বভাব। ক্ষমতায় থাকুন কিংবা বাইরেই থাকুন, খালেদা জিয়া যখন তখন বিদেশে যেতে ভালোবাসেন না। বিদেশে চটক দেখানোর চাইতে দেশে থেকে কিছু কাজ করার গুরুত্ব অনেক বেশি তার কাছে। তিনি জেলেই বন্দী হয়ে রইলেন।
জেলের বাইরে কিন্তু অনেক ষড়যন্ত্র চলছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নির্বাসনে যাবেন না, অতএব বিকল্প হচ্ছে তার দলটাকেই ভেঙে দেয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা অত্যন্ত ‘নিমক-হালাল’ মানুষ। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালু করলেন। দেশের মানুষ অবাক-বিস্ময়ে দেখল, যে দল আগেও চারবার ক্ষমতায় ছিল, যে নেত্রী দেশের মানুষের ভোটে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাকে এবং তার দলকে বাদ দিয়ে হেঁদি-পেঁচিদের নিয়ে সংলাপ চলছে।
তাতেও কাজ হয়নি। ‘ক্লোক অ্যান্ড ড্যাগার’ ষড়যন্ত্র তৈরি হলো তখন। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ডিজিএফআই বিএনপির স্থায়ী কমিটির চার কিংবা পাঁচজন সদস্যকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যায় গুলশানে, বৃদ্ধ এবং মৃত্যুপথযাত্রী নেতা সাইফুর রহমানের বাড়িতে। মাঝ রাতের পর সাইফুর রহমানকে দিয়ে একটা ঘোষণা প্রচার করানো হয়, যার অর্থ ছিল যে নতুন নেতৃত্বে বিএনপি পুনর্গঠিত হয়েছে। পশ্চিমে হলে হলিউড এই সিনারিও অবলম্বনে ফিল্ম তৈরি করে ফেলত অনেক আগে। তবে বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো। সে দেশের মানুষ হাসিনা-মইন উ’র ফাঁদে পা দেয়নি, নতুন নেতৃত্বের ভাঁওতাবাজিতে তারা প্রতারিত হয়নি।
মইন উ আর ফখরুদ্দীনরা পালিয়ে আমেরিকায় চলে গেছেন। কিন্তু মাইনাস-ওয়ানের বড় তরফ এখনও বাংলাদেশের মাটিতেই আছে। সুতরাং বলা যাবে না যে মাইনাস-ওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। বরং বিগত কিছুদিনের ঘটনাবলীতে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, খালেদা জিয়া এবং বিএনপিকে পাশ কাটিয়েই ‘নির্বাচন’ করার পরিকল্পনা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।
মির্জা ফখরুদ্দিন আলমগীর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে খুবই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তার কাঁধ থেকে ভারটা কিছুতেই নামাতে পারলেন না। কারণ? কারণ এই যে, বিএনপিতে ভয়ানক দলাদলি। বেশকিছু লোক আছেন এ দলে যারা কাজ করতে কিংবা ঝুঁকি নিতে রাজি নন, কিন্তু নেতৃত্ব ও মন্ত্রিত্ব পাওয়ার দারুণ লোভ তাদের। কাকে খুশি করবেন আর কাকে করবেন না, খালেদা জিয়ার সেটা মহা সমস্যা।
আমার ভয় হয় বিএনপির ভেতরে র’য়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভেতর থেকে তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়ার আন্দোলন পণ্ড করে দিতে চান। নানা রকমের উদ্ভট কথা বলে তারা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করছেন। কারও কারও ভাবখানা এই যে, আন্দোলন একটা আম গাছ। ফল পাকলে নিজে থেকেই পড়ে যাবে। এমনকি ডালে ঝাঁকানিও দিতে হবে না। কেউ কেউ তো আরও চরমে। রীতিমত গোঁফ-খেজুরে তারা। তারা খেজুর গাছের তলায় হা-করে শুয়ে আছেন পাকা খেজুর মুখে পড়ার আশায়। তাদের সমস্যা : মুখের লাগোয়া গোঁফটা সরিয়ে দেবে কে।
হাসিনার শক্তি, খালেদার দুর্বলতা
একটা কথা এখানে না বলে পারছি না। বিদেশিরা শেখ হাসিনাকে ভালোবাসে কিংবা পছন্দ করে মনে করলে ভুল হবে। বরং তার ঔদ্ধত্য, গোঁয়ার্তুমি অনবরত তাদের বিরক্তি ও ক্রোধেরই সঞ্চার করে। ড. ইউনূসের ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও বিশ্ববাসী বহু দেনদরবার করেছে হাসিনার সঙ্গে, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে, ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দিতে, বিশ্বব্যাংকের নির্দেশিত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে, সর্বশেষ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে কতই তো অনুরোধ করেছে বিশ্ববাসী। শেখ হাসিনা শুনেছেন সেসব অনুরোধ? কান দিয়েছেন কারও কথায়? তবু তারা হাসিনাকে সহ্য করছে। তারা দেখছে হাসিনার মধ্যে অন্তত একটা গুণ আছে, সেটা তার ‘ডিসাইসিভনেস’। যা তিনি করবেন বলেন, সেটা করেই ছাড়েন। নেতা ও শাসক হতে গেলে সেটারও প্রয়োজন আছে।
খালেদা জিয়া কখনোই হুট করে কিছু করে ফেলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নিলে তাতে অটল থাকেন তিনি। তার মধ্যে এই গুণটা অনেক আগেই চোখে পড়েছিল। আমি তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছি এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরতন্ত্রের সময় থেকে। অন্য নেত্রী বলেছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি অখুশি নন; আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী সামরিক শাসনের সাফল্য কামনা করে মোনাজাত করেছিল সম্পাদকীয় প্রবন্ধে। পদে পদে সমর্থন দিয়ে হাসিনা যে সামরিক শাসনকে নয় বছর টিকে থাকতে সাহায্য করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি আশা করি। কিন্তু খালেদা জিয়া তার লক্ষ্যে অনড় ছিলেন। একটা কাহিনী আপনাদেরও মনে থাকবে। জনৈক লে. কর্নেল এসেছিলেন তাকে গ্রেফতার করতে। খালেদা যেভাবে তাকে ধমক দিয়েছিলেন, কর্নেল সাহেব তাতে কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। ততক্ষণে খালেদা জিয়া অন্য কোথাও চলে গেছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার আর আওয়ামী লীগের চক্ষুশূল, পথের কাঁটা। অত্যন্ত সার্থকভাবে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে সরকারের সুবিধা। কিন্তু সেটাই একমাত্র বিবেচনা নয়। বেছে বেছে বিএনপির যেসব সফল নেতা আছেন, নির্বাচন হলে মানুষ যাদের ভোট দেবেই, তাদের সরিয়ে দেয়াই সরকারের কৌশল। আড়াই বছর আগে রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হয়েছেন। সম্প্রতি আবার সে ওয়ার্ডের জনপ্রিয় বিএনপি সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মজুমদার গুম-খুন হলেন। সিলেট বিএনপির নেতা এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ক্ষত সবার হৃদয়েই এখনও তাজা, দগদগে।
আচমকা নির্বাচনের প্রস্তুতি
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো আরও অনেক নেতাকর্মীকে ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গোড়ায় মামলা হয়েছিল দুটো। তিনি নাকি সচিবালয়ের ভেতর ককটেল বোমা ছুড়েছিলেন, আর একই সময় এয়ারপোর্ট রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকশ’ গজের ভেতর কেউ একজনের গাড়ি ভাংচুর করেছিলেন। কিন্তু উভয় ঘটনারই দায় চাপানো হয়েছে তার ওপর। হাইকোর্টে তিনি জামিন পেলেন, কিন্তু নতুন দুটি মামলা চাপিয়ে দেয়া হয় তার ঘাড়ে। তার পর থেকে আরও কিছু মামলা চাপানো হয়েছে তার ওপর। যেন বাংলাদেশে যা কিছু সরকার-বিরোধী ঘটছে, সবকিছুর জন্যই দায়ী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উদ্দেশ্যটা খুবই পরিষ্কার। একেকটা অভিযোগের শুনানি হতে যদি দু’সপ্তাহ লাগে তাহলে নির্বাচন কেটে যাওয়ার পরে অবধি তাকে জেলে পুরে রাখা যাবে। সরকারের পরিবর্তিত অভিযোগ, তিনি হুকুমের আসামি। এই সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রকাশ্যে সড়কে নেমে জামায়াতের প্রতিবাদ মিছিলের সঙ্গে দাঙ্গা করার হুকুম দিলেন ছাত্রলীগ আর যুবলীগকে। তারা লাঠিপেটা করে আর কুপিয়ে হত্যা করল বিশ্বজিেক। গুম-খুনের ঘটনাগুলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া হতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। কই, তাদের হুকুমের আসামি করে তো কোন মামলা হচ্ছে না?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বহু বিতর্কিত তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে আরও ছয়শ’ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। হরতাল এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন আরও শত শত। বিএনপির গ্রেফতার হয়েছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার। এদিকে খালেদা জিয়া এবং তার ছেলেদের বিরুদ্ধে সাজানো দুর্নীতির মামলাগুলো হঠাত্ করে যেন চাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সরকারের কৌশল কি এর থেকেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে না? তারা চায় বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের জেলে আটক রেখে চটজলদি এপ্রিল কিংবা মে মাসে নির্বাচন দিতে। তাহলে বিরোধী দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো যথেষ্ট প্রার্থী খুঁজে পাবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে দেবে। এ সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে সরকার দ্রুত বিচার আদালত, ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করে ফর্মুলা অনুযায়ী সাজা দিয়ে দেবে বিএনপি ও জামায়াতের বন্দীদের। সে অবস্থাতেও নির্বাচন করা এ দুটি দলের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
খালেদা জিয়া পরিস্থিতির এই বাস্তবতা বুঝতে পারছেন না বলে আমি কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু তিনি নিষ্ক্রিয় কেন? মাঝে মাঝে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনসংযোগ করছেন। জনসংযোগের প্রক্রিয়া কি চার বছরেও সাঙ্গ হয়নি? দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এখন তাকে সমর্থন করে। আর কত সমর্থনের প্রয়োজন তার? প্রয়োজন হচ্ছে সে সমর্থনকে কাজে লাগানো। সৈন্যদের তিনি ডেকে রণাঙ্গনে নিয়ে গেছেন। সেখানে তাদের আর কতদিন বসে বসে ঝিমুতে দেবেন? খালেদা জিয়া কি বুঝতে পারছেন না শহীদ জিয়া যে মহান দলটি গঠন করেছিলেন, তার (খালেদার) নিষ্ক্রিয়তার জন্য সে দল এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে? শুনছি কেউ কেউ তাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, আন্দোলন করে সরকার উত্খাতের চেষ্টা না করলে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে শেখ হাসিনাকে রাজি করাবেন।
খালেদা জিয়া যদি সেসব আশ্বাসে বিশ্বাস করেন তাহলে বলতেই হবে—এক-এগারো, বর্ণচোরা সামরিক সরকার আর তার নিজের জেল খাটা থেকে কিছুই তিনি শিখতে পারেননি।
লন্ডন, ১৯.০১.১৩
serajurrahman34@gmail.com
ফখরুদ্দীন-মইন উ বর্ণচোরা সামরিক শাসন অবশ্যই শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফসল ছিল। লগি-লাঠি-বৈঠার হত্যাযজ্ঞ, লাগাতার হরতাল আর সাবোটাজ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি হুমকি না হলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে রাজি হতেন না। মোক্ষম স্বীকারোক্তি করেছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল বিদেশ ভ্রমণে যাত্রার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার তার আন্দোলনেরই ফসল এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন। আসলেও হয়েছে তাই। বহু অপকর্ম-দুষ্কর্ম হয়েছে সে সরকারের দু’বছরে। কিন্তু তার জন্য কারও কি কোনো শাস্তি হয়েছে? ফখরুদ্দীন আর মইন উকে কি জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও এ সরকার আমেরিকা থেকে ফেরত আনতে পেরেছে?
আর সেই যে বিদেশ ভ্রমণের কথা বলছিলাম? মাইনাস-টু অনুযায়ী দুই নেত্রীকেই কিন্তু নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা হয়নি। চেষ্টা হয়েছিল বিএনপি নেত্রীকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর। সৈন্য-সামন্ত, গাড়ি-ঘোড়া তার বাসভবনেই এসেছিল তাকে বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে। সৌদিদের একখানি বিমানও নাকি প্রস্তুত ছিল বিমানবন্দরে। ইচ্ছে করলে খালেদা জিয়া কত শক্ত হতে পারেন তার প্রমাণ আবারও তিনি দেখিয়েছিলেন সে সময়। দুই নেত্রীকেই সংসদ ভবন সংলগ্ন বিশেষ কারাগারে বন্দী করা হলো। কিন্তু ‘দুই’ ব্যাপারটা সেখানেও ছিল লোক-দেখানো। এক নেত্রী বন্দী হয়েই রইলেন, আর অন্যজন গেলেন বিদেশে হাওয়া খেতে।
বলা হয়েছিল যে শেখ হাসিনা চিকিত্সার জন্য আমেরিকা যাবেন। আমেরিকায় গিয়েও ছিলেন তিনি। পুত্র ও তার পরিবার আছে সেখানে। আদরের নাতনি থাকে কানাডায়, সেখানে না গেলেই নয়। আবার বোনের ছেলের বিয়ে হবে লন্ডনে। বড় খালা হাজির না থাকলে কি চলে? হাসিনাকে লন্ডনে আসতেই হলো। বৌমা ফিনল্যান্ডের মেয়ে। অতএব নাইওর যেতে হলো হেলসিঙ্কিতেও। বলাই বাহুল্য, সর্বত্রই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন নেত্রী, দেশের রাজনীতির নোংরা কাঁথা বিদেশে ঝেড়েছেন। সবাই জানেন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিতে ‘বড়ই’ ভালোবাসেন, তার সবচাইতে প্রিয় বস্তু নিজের কণ্ঠস্বর।
বর্ণচোরা সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ নেত্রীর বিশ্ব ভ্রমণে বাধা দেয়নি, ‘বন্দী দশায়’ তার রাজনৈতিক তত্পরতায়ও আপত্তি করেনি। মইন উ আহমেদ জানতেন, হাসিনা তাদের অথবা তারা হাসিনার নিজের লোক। খালেদা জিয়াকে মাইনাস-ওয়ান করা না গেলে হাসিনা সেনাশাসনই মেনে নেবেন। নিজ মুখে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার শাসনের চাইতে সেনা শাসনও মেনে নিতে রাজি তিনি। তার প্রমাণ তিনি অনেক আগেই দিয়েছেন। ১৯৮২ সালে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করার জন্য তিনি লে. জে. এরশাদকে মদত দিয়েছিলেন। অনেকে তো বলেন, সেই ষড়যন্ত্রে তিনিও ছিলেন একজন হোতা। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি জেনারেল নাসিমকে দিয়ে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। সৌভাগ্যবশত আগাম খবর পেয়ে কয়েকজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা সে অভ্যুত্থান ভণ্ডুল করে দিতে পেরেছিলেন।
দেশের কাজ দেশে, বিদেশে নয়
অন্য নেত্রী দেশের মাটিকেই বেশি ভালোবাসেন। এটা তার স্বভাব। ক্ষমতায় থাকুন কিংবা বাইরেই থাকুন, খালেদা জিয়া যখন তখন বিদেশে যেতে ভালোবাসেন না। বিদেশে চটক দেখানোর চাইতে দেশে থেকে কিছু কাজ করার গুরুত্ব অনেক বেশি তার কাছে। তিনি জেলেই বন্দী হয়ে রইলেন।
জেলের বাইরে কিন্তু অনেক ষড়যন্ত্র চলছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নির্বাসনে যাবেন না, অতএব বিকল্প হচ্ছে তার দলটাকেই ভেঙে দেয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা অত্যন্ত ‘নিমক-হালাল’ মানুষ। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালু করলেন। দেশের মানুষ অবাক-বিস্ময়ে দেখল, যে দল আগেও চারবার ক্ষমতায় ছিল, যে নেত্রী দেশের মানুষের ভোটে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাকে এবং তার দলকে বাদ দিয়ে হেঁদি-পেঁচিদের নিয়ে সংলাপ চলছে।
তাতেও কাজ হয়নি। ‘ক্লোক অ্যান্ড ড্যাগার’ ষড়যন্ত্র তৈরি হলো তখন। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ডিজিএফআই বিএনপির স্থায়ী কমিটির চার কিংবা পাঁচজন সদস্যকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যায় গুলশানে, বৃদ্ধ এবং মৃত্যুপথযাত্রী নেতা সাইফুর রহমানের বাড়িতে। মাঝ রাতের পর সাইফুর রহমানকে দিয়ে একটা ঘোষণা প্রচার করানো হয়, যার অর্থ ছিল যে নতুন নেতৃত্বে বিএনপি পুনর্গঠিত হয়েছে। পশ্চিমে হলে হলিউড এই সিনারিও অবলম্বনে ফিল্ম তৈরি করে ফেলত অনেক আগে। তবে বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো। সে দেশের মানুষ হাসিনা-মইন উ’র ফাঁদে পা দেয়নি, নতুন নেতৃত্বের ভাঁওতাবাজিতে তারা প্রতারিত হয়নি।
মইন উ আর ফখরুদ্দীনরা পালিয়ে আমেরিকায় চলে গেছেন। কিন্তু মাইনাস-ওয়ানের বড় তরফ এখনও বাংলাদেশের মাটিতেই আছে। সুতরাং বলা যাবে না যে মাইনাস-ওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। বরং বিগত কিছুদিনের ঘটনাবলীতে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, খালেদা জিয়া এবং বিএনপিকে পাশ কাটিয়েই ‘নির্বাচন’ করার পরিকল্পনা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।
মির্জা ফখরুদ্দিন আলমগীর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে খুবই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তার কাঁধ থেকে ভারটা কিছুতেই নামাতে পারলেন না। কারণ? কারণ এই যে, বিএনপিতে ভয়ানক দলাদলি। বেশকিছু লোক আছেন এ দলে যারা কাজ করতে কিংবা ঝুঁকি নিতে রাজি নন, কিন্তু নেতৃত্ব ও মন্ত্রিত্ব পাওয়ার দারুণ লোভ তাদের। কাকে খুশি করবেন আর কাকে করবেন না, খালেদা জিয়ার সেটা মহা সমস্যা।
আমার ভয় হয় বিএনপির ভেতরে র’য়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভেতর থেকে তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়ার আন্দোলন পণ্ড করে দিতে চান। নানা রকমের উদ্ভট কথা বলে তারা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করছেন। কারও কারও ভাবখানা এই যে, আন্দোলন একটা আম গাছ। ফল পাকলে নিজে থেকেই পড়ে যাবে। এমনকি ডালে ঝাঁকানিও দিতে হবে না। কেউ কেউ তো আরও চরমে। রীতিমত গোঁফ-খেজুরে তারা। তারা খেজুর গাছের তলায় হা-করে শুয়ে আছেন পাকা খেজুর মুখে পড়ার আশায়। তাদের সমস্যা : মুখের লাগোয়া গোঁফটা সরিয়ে দেবে কে।
হাসিনার শক্তি, খালেদার দুর্বলতা
একটা কথা এখানে না বলে পারছি না। বিদেশিরা শেখ হাসিনাকে ভালোবাসে কিংবা পছন্দ করে মনে করলে ভুল হবে। বরং তার ঔদ্ধত্য, গোঁয়ার্তুমি অনবরত তাদের বিরক্তি ও ক্রোধেরই সঞ্চার করে। ড. ইউনূসের ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও বিশ্ববাসী বহু দেনদরবার করেছে হাসিনার সঙ্গে, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে, ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দিতে, বিশ্বব্যাংকের নির্দেশিত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে, সর্বশেষ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে কতই তো অনুরোধ করেছে বিশ্ববাসী। শেখ হাসিনা শুনেছেন সেসব অনুরোধ? কান দিয়েছেন কারও কথায়? তবু তারা হাসিনাকে সহ্য করছে। তারা দেখছে হাসিনার মধ্যে অন্তত একটা গুণ আছে, সেটা তার ‘ডিসাইসিভনেস’। যা তিনি করবেন বলেন, সেটা করেই ছাড়েন। নেতা ও শাসক হতে গেলে সেটারও প্রয়োজন আছে।
খালেদা জিয়া কখনোই হুট করে কিছু করে ফেলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নিলে তাতে অটল থাকেন তিনি। তার মধ্যে এই গুণটা অনেক আগেই চোখে পড়েছিল। আমি তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছি এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরতন্ত্রের সময় থেকে। অন্য নেত্রী বলেছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি অখুশি নন; আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী সামরিক শাসনের সাফল্য কামনা করে মোনাজাত করেছিল সম্পাদকীয় প্রবন্ধে। পদে পদে সমর্থন দিয়ে হাসিনা যে সামরিক শাসনকে নয় বছর টিকে থাকতে সাহায্য করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি আশা করি। কিন্তু খালেদা জিয়া তার লক্ষ্যে অনড় ছিলেন। একটা কাহিনী আপনাদেরও মনে থাকবে। জনৈক লে. কর্নেল এসেছিলেন তাকে গ্রেফতার করতে। খালেদা যেভাবে তাকে ধমক দিয়েছিলেন, কর্নেল সাহেব তাতে কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। ততক্ষণে খালেদা জিয়া অন্য কোথাও চলে গেছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার আর আওয়ামী লীগের চক্ষুশূল, পথের কাঁটা। অত্যন্ত সার্থকভাবে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে সরকারের সুবিধা। কিন্তু সেটাই একমাত্র বিবেচনা নয়। বেছে বেছে বিএনপির যেসব সফল নেতা আছেন, নির্বাচন হলে মানুষ যাদের ভোট দেবেই, তাদের সরিয়ে দেয়াই সরকারের কৌশল। আড়াই বছর আগে রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হয়েছেন। সম্প্রতি আবার সে ওয়ার্ডের জনপ্রিয় বিএনপি সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মজুমদার গুম-খুন হলেন। সিলেট বিএনপির নেতা এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ক্ষত সবার হৃদয়েই এখনও তাজা, দগদগে।
আচমকা নির্বাচনের প্রস্তুতি
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো আরও অনেক নেতাকর্মীকে ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গোড়ায় মামলা হয়েছিল দুটো। তিনি নাকি সচিবালয়ের ভেতর ককটেল বোমা ছুড়েছিলেন, আর একই সময় এয়ারপোর্ট রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকশ’ গজের ভেতর কেউ একজনের গাড়ি ভাংচুর করেছিলেন। কিন্তু উভয় ঘটনারই দায় চাপানো হয়েছে তার ওপর। হাইকোর্টে তিনি জামিন পেলেন, কিন্তু নতুন দুটি মামলা চাপিয়ে দেয়া হয় তার ঘাড়ে। তার পর থেকে আরও কিছু মামলা চাপানো হয়েছে তার ওপর। যেন বাংলাদেশে যা কিছু সরকার-বিরোধী ঘটছে, সবকিছুর জন্যই দায়ী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উদ্দেশ্যটা খুবই পরিষ্কার। একেকটা অভিযোগের শুনানি হতে যদি দু’সপ্তাহ লাগে তাহলে নির্বাচন কেটে যাওয়ার পরে অবধি তাকে জেলে পুরে রাখা যাবে। সরকারের পরিবর্তিত অভিযোগ, তিনি হুকুমের আসামি। এই সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রকাশ্যে সড়কে নেমে জামায়াতের প্রতিবাদ মিছিলের সঙ্গে দাঙ্গা করার হুকুম দিলেন ছাত্রলীগ আর যুবলীগকে। তারা লাঠিপেটা করে আর কুপিয়ে হত্যা করল বিশ্বজিেক। গুম-খুনের ঘটনাগুলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া হতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। কই, তাদের হুকুমের আসামি করে তো কোন মামলা হচ্ছে না?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বহু বিতর্কিত তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে আরও ছয়শ’ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। হরতাল এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন আরও শত শত। বিএনপির গ্রেফতার হয়েছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার। এদিকে খালেদা জিয়া এবং তার ছেলেদের বিরুদ্ধে সাজানো দুর্নীতির মামলাগুলো হঠাত্ করে যেন চাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সরকারের কৌশল কি এর থেকেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে না? তারা চায় বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের জেলে আটক রেখে চটজলদি এপ্রিল কিংবা মে মাসে নির্বাচন দিতে। তাহলে বিরোধী দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো যথেষ্ট প্রার্থী খুঁজে পাবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে দেবে। এ সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে সরকার দ্রুত বিচার আদালত, ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করে ফর্মুলা অনুযায়ী সাজা দিয়ে দেবে বিএনপি ও জামায়াতের বন্দীদের। সে অবস্থাতেও নির্বাচন করা এ দুটি দলের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
খালেদা জিয়া পরিস্থিতির এই বাস্তবতা বুঝতে পারছেন না বলে আমি কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু তিনি নিষ্ক্রিয় কেন? মাঝে মাঝে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনসংযোগ করছেন। জনসংযোগের প্রক্রিয়া কি চার বছরেও সাঙ্গ হয়নি? দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এখন তাকে সমর্থন করে। আর কত সমর্থনের প্রয়োজন তার? প্রয়োজন হচ্ছে সে সমর্থনকে কাজে লাগানো। সৈন্যদের তিনি ডেকে রণাঙ্গনে নিয়ে গেছেন। সেখানে তাদের আর কতদিন বসে বসে ঝিমুতে দেবেন? খালেদা জিয়া কি বুঝতে পারছেন না শহীদ জিয়া যে মহান দলটি গঠন করেছিলেন, তার (খালেদার) নিষ্ক্রিয়তার জন্য সে দল এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে? শুনছি কেউ কেউ তাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, আন্দোলন করে সরকার উত্খাতের চেষ্টা না করলে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে শেখ হাসিনাকে রাজি করাবেন।
খালেদা জিয়া যদি সেসব আশ্বাসে বিশ্বাস করেন তাহলে বলতেই হবে—এক-এগারো, বর্ণচোরা সামরিক সরকার আর তার নিজের জেল খাটা থেকে কিছুই তিনি শিখতে পারেননি।
লন্ডন, ১৯.০১.১৩
serajurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন