ড. কে. এ. এম. শাহাদত হোসেন মণ্ডল
মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশে একটি আলোড়িত ও আলোকিত নাম। সংবাদপত্র জগতের কিংবদন্তি। বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক অকুতোভয় নির্ভীক সিপাহসালার। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক কলমসৈনিক। তিনি আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। গত ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২ তার বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তিনি আদালতে অগ্রিম জামিনের আবেদনও করেছেন। তার অপরাধ, গত ৮ থেকে ১২ ডিসেম্বর, ২০১২ পর্যন্ত দৈনিক আমার দেশ-এ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও বেলজিয়াম প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে, যা নাকি কঠিন রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অপরাধ। এ মামলার আগে গত ১২ ডিসেম্বর, ২০১২ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন প্রকাশের ওপর জারি করে নিষেধাজ্ঞা। একইসঙ্গে এই সংলাপ প্রকাশের দায়ে আমার দেশ সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে গ্রেফতারের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানাতে বলেন। মাহমুদুর রহমান এখন পত্রিকা অফিসে অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তার কথা হলো, তাকে গ্রেফতার করতে হলে পত্রিকা অফিস থেকেই গ্রেফতার করতে হবে।
উল্লেখ্য, বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে প্রবাসী আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল সব ধরনের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের আদেশে বলা হয়েছে, ‘কারো ইন্টারনেট বা ই-মেইল হ্যাক করা বা ব্যক্তিগত কথোপকথন অবৈধ উপায়ে রেকর্ড করা অন্যায়, এটা জেনেও তা প্রচার করা আরো বড় অপরাধ। এটি ট্রাইব্যুনালের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল।’ (সূত্র : সম্পাদকীয় দৈনিক দিনকাল, তাং-১৫-১২-২০১২)
এই স্কাইপ কথোপকথন সংবাদপত্রে প্রচার করাটা যুদ্ধাপরাধের মামলাকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত অভিহিত করে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, এ মামলাকে বিলম্বিত করার চেষ্টা যারা করেছে, তারা সফলকাম হয়নি। যতরকম কৌশল আছে, সবরকম কৌশল আসামিপক্ষের আইনজীবীরা করেছেন। বিচারক নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে আহমেদ জিয়াউদ্দিনের অভিজ্ঞতার বিনিময় হয়েছে বা পরামর্শ হয়েছে—সেটি সত্যি। যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং এই ট্রায়াল আমাদের বিচারক, আইনজীবী ও আসামিদের জন্য একেবারে নতুন। তাই নাসিম সাহেব একজন বিচারক হিসেবে আহমেদ জিয়াউদ্দিন যেহেতু সে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তার সঙ্গে শেয়ার করতেই পারেন বা তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেই পারেন। এটি দোষের কিছুই নয়। তবে প্রথম থেকে আমরা অনুসন্ধান করছি দীর্ঘদিন ধরে তারা কথা বলে যাচ্ছেন আর আমার দেশ পত্রিকা বা ইকোনমিস্ট পত্রিকা এই তথ্য ধারাবাহিকভাবে সংগ্রহ করছে—এ বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, তাং ১৫-১২-২০১২, পৃ. ৩)
দৈনিক আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক। অনেকের মতে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। আদালত কেন এ বিষয়টি নিয়ে এত বেশি উত্সাহ দেখাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২)
উল্লেখ্য, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশের পর সারাদেশে বিচারকের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং সংশ্লিষ্ট বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে বিতর্কের মুখে স্কাইপ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১১-১২-২০১২ তারিখে পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আসিফ নজরুলের ভাষায়, ‘যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইন্টারনেট স্কাইপে তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সংলাপ বিচারকের আচরণবিধির লঙ্ঘন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে একজন বিচারপতি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে পারেন না। কিন্তু তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে যেসব কথা বলেছেন, তাতে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার কাজ প্রভাবিত করার বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিচার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে যে কেসের ব্যাপারে তারা কথা বলেছেন—সেটি চ্যালেঞ্জে পড়েছে এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এছাড়া তিনি ট্রাইব্যুনালের অন্য একজন বিচারপতিকে ‘করাপ্টেড’ বলেছেন, যা ওই বিচারকের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন তুলেছে।’ (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, তাং ১১-১২-২০১২, পৃ.৩)
ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড লন্ডনে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার কাছে রয়েছে। ওই কথোপকথন ইউটিউবে ছাড়া হয় এবং দ্য ইকোনমিস্ট-এর অনলাইনেও ছাপা হয়। একজন বিচারপতি যখন শপথ ভঙ্গ করে বিচার চলাকালীন মামলা ও মামলার রায় কী হতে পারে—তা নিয়ে অন্যের সঙ্গে স্কাইপ করেন, তখন বলা যায়—বিচারের আসনে বসে এটা বিচারের সঙ্গেই অসদাচরণ করা। আর সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে সাংবাদিকদের কাজ। তাছাড়া কোনো সংবাদ যখন জনসম্পৃক্ত থাকে, কেউ যদি সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করে থাকেন, কেউ যদি আইনকে ব্যবহার করতে চান অন্যকে শায়েস্তা করার কাজে, তখন এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ তথ্য অধিকার আইন ও ২০১১ সালের ৭ নং আইনের শিরোনাম হচ্ছে ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষার আইন’। এ আইনে তথ্য প্রকাশকারীর যাবতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ হাইকোর্ট রুল জারি করে তথ্য অধিকার আইনকে অবজ্ঞা করেছে। এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। এই বিশ্বায়নের যুগে মিডিয়া অনেক শক্তিশালী। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও এখন মিডিয়াকে গুরুত্ব দেয়। অথচ বাংলাদেশে মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২, পৃ.৪)
বেলজিয়াম প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপে উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারপতির নামও এসেছে। এর মধ্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের নামও আছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হলো—বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে দেশের আইনজীবী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন মহলে, এমনকি জাতীয় সংসদে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দৈনিক আমার দেশ এর আগে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বিচারপতি তথ্য গোপন করে লন্ডনে বাড়ি ক্রয়সহ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। পরে মাহমুদুর রহমান বিচারপতির বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ১৯টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তাকে অভিশংসনের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন জানান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। গত ৮ নভেম্বর, ২০১২ বঙ্গভবন থেকে চিঠি দিয়ে এই উদ্যোগের কথা মাহমুদুর রহমানকে জানানো হয়। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি চলাকালেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ থেকে আমার দেশ পত্রিকার বিষয়ে রুল জারি করা হলো। অর্থাত্ অভিযুক্ত ব্যক্তিই হয়ে গেলেন বিচারক। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ভাষায়, ‘একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির যদি আগেই অভিযোগ থাকে, তাহলে ওই বিচারপতি অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা শুনতে পারেন না।’ এছাড়া এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য, ‘আজ স্বাধীনতার ৪১ বছর পর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সত্য কথা বলার অপরাধে বাংলাদেশের একজন সাহসী বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে সংবাদপত্রের একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের মাসে ব্যবস্থা গ্রহণ (মামলা দায়ের) জাতীয় পর্যায়ে অত্যন্ত একটি লজ্জাকর ব্যাপার। মানুষ এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের অর্থ গণতন্ত্রের আয়ু ফুরিয়ে আসা। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের পদক্ষেপ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ এছাড়া বিশিষ্ট সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদের ভাষায়, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও সংবাদপত্র তার সূত্র জানাতে বাধ্য না হলেও এখানে সূত্র জানানো বাধ্য করতে চেষ্টা হয়েছে। বিশিষ্ট চিকিত্সক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এজেডএম জাহিদ হোসেনের ভাষায়, মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার মানুষকে সত্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২)
বিচারপতি নিজামুল হক ও প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের শাসনামলে—যা ইতিহাসে ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে খ্যাত। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয় নিক্সনকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই তথ্য ফাঁস করে দেয়ার (অপরাধে!) জন্য সংশ্লিষ্ট ২ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো বিচার বা মামলা হয়নি। বন্ধ হয়নি পত্রিকাটিও। উপরন্তু এই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা আবিষ্কার এবং তা দেশবাসীর সামনে সাহসের সঙ্গে উপস্থাপনের জন্য সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ড রাতারাতি আমেরিকার জাতীয় বীরে পরিণত হন এবং সে বছর সাংবাদিকতায় নোবেল বলে পরিচিত বিখ্যাত ‘পুলিত্সার’ পুরস্কারে ভূষিত হন (সূত্র : আমার দেশ, তাং ১৬-১২-২০১২)। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, একইরকম ঘটনার প্রেক্ষিতে পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমার দেশ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি নিজে আজ জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটি জাতি ও সাংবাদিক জগতের জন্য চরম লজ্জাজনক এবং গণতন্ত্রের চরম পরিপন্থী।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের ভাষায়, ‘...আমার দেশ এরকম একটি অভাবনীয় কাজ করে একটা জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। সাংবাদিকতার জগতে একটি নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এজন্য সম্পাদক মাহমুদুর রহমান শ্রেষ্ঠ সাহসী সম্পাদকের খেতাব পেতে পারেন। স্কাইপে ন্যক্কারজনক কথোপকথন জনসম্মুখে প্রকাশ করে মাহমুদুর রহমান জাতির শ্রেষ্ঠ সেবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই আমরা তাকে নোবেল না দিতে পারলেও স্বাধীনতা পুরস্কার অবশ্যই দিতে পারি।’ (সূত্র : আমার দেশ, তাং ২৪-১২-২০১২)
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি নিজামুল হকের ওপর অর্পিত হয়েছিল জাতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব। ট্রাইব্যুনালের বিচার স্বচ্ছ, ন্যায্য, নিরপেক্ষ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সবার কাছে গ্রহণীয় হোক—এটি সবার দাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান হিসেবে তার দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি (সূত্র : সম্পাদকীয়, দৈনিক ইনকিলাব, তাং ১৩-১২-২০১২)। এতে উচ্চ আদালতের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। একইসঙ্গে আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় ও রায় প্রদানে স্বচ্ছতা নিয়ে দেশবাসীর মনে প্রশ্ন ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে মাহমুদুর রহমান একজন কিংবদন্তি। তিনি সত্, সাহসী ও নির্ভীক কলমসৈনিক। সময়ের সাহসী সন্তান। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। বলিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক দেশপ্রেমিক শ্রেষ্ঠ সাহসী সম্পাদক। দেশপ্রেম ও সততার প্রতীক মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের অহঙ্কার। তার কাছে সবার ওপরে দেশের স্বাধীনতা, দেশের মানুষ ও নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এছাড়া সব সরকারের দুঃশাসন ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার। তিনি বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক নির্ভীক প্রতিবাদী কণ্ঠ। তিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে, এমনকি হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। তার ভাষায়, প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন, তবুও সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে সরে আসবেন না। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সত্য প্রকাশ থেকে তিনি পিছপা বা বিরত হবেন না। মহান আল্লার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, ‘মামলা দিয়ে আমার দেশ পত্রিকার কণ্ঠরোধ করা যাবে না। ২৪টি মামলা হয়েছে। তাতে কি হয়েছে? ২৪ হাজার মামলা হলেও দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ সত্য থেকে পিছপা হবার পাত্র আমার দেশ নয়। (সূত্র : আমার দেশ, তাং ০৫-০২-২০১০)
তাই তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়—‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
দেশের মানুষ যে মুহূর্তে একদলীয় শাসনের নাগপাশ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ ও ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন কর’ আন্দোলনে শরিক, তখন বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। দেশবাসী তাই আজ এই মামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও ক্ষুব্ধ।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের পদত্যাগ প্রমাণ করে যে, ট্রাইব্যুনালের বিষয় নিয়ে স্কাইপ সংলাপ বা কথোপকথনের যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে—তা সঠিক এবং এটি একজন বিচারকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট বিচারপতির স্কাইপ কথোপকথনের বিষয়ে কোনো তদন্ত না করে উল্টো আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করাটা জনগণ ভালো চোখে দেখছে না এবং এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে একদিকে আদালতের ওপর মানুষের আস্থা কমে আসবে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। পাশাপাশি এই মামলা রুজুর কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদাও দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা সরকারের জন্যও মঙ্গলজনক নয়। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের পদক্ষেপ (মামলা) কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ (মামলা) গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে এবং দেশে গণতন্ত্রের ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mondalsh52@yahoo.co
m
উল্লেখ্য, বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে প্রবাসী আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল সব ধরনের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের আদেশে বলা হয়েছে, ‘কারো ইন্টারনেট বা ই-মেইল হ্যাক করা বা ব্যক্তিগত কথোপকথন অবৈধ উপায়ে রেকর্ড করা অন্যায়, এটা জেনেও তা প্রচার করা আরো বড় অপরাধ। এটি ট্রাইব্যুনালের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল।’ (সূত্র : সম্পাদকীয় দৈনিক দিনকাল, তাং-১৫-১২-২০১২)
এই স্কাইপ কথোপকথন সংবাদপত্রে প্রচার করাটা যুদ্ধাপরাধের মামলাকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত অভিহিত করে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, এ মামলাকে বিলম্বিত করার চেষ্টা যারা করেছে, তারা সফলকাম হয়নি। যতরকম কৌশল আছে, সবরকম কৌশল আসামিপক্ষের আইনজীবীরা করেছেন। বিচারক নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে আহমেদ জিয়াউদ্দিনের অভিজ্ঞতার বিনিময় হয়েছে বা পরামর্শ হয়েছে—সেটি সত্যি। যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং এই ট্রায়াল আমাদের বিচারক, আইনজীবী ও আসামিদের জন্য একেবারে নতুন। তাই নাসিম সাহেব একজন বিচারক হিসেবে আহমেদ জিয়াউদ্দিন যেহেতু সে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তার সঙ্গে শেয়ার করতেই পারেন বা তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেই পারেন। এটি দোষের কিছুই নয়। তবে প্রথম থেকে আমরা অনুসন্ধান করছি দীর্ঘদিন ধরে তারা কথা বলে যাচ্ছেন আর আমার দেশ পত্রিকা বা ইকোনমিস্ট পত্রিকা এই তথ্য ধারাবাহিকভাবে সংগ্রহ করছে—এ বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, তাং ১৫-১২-২০১২, পৃ. ৩)
দৈনিক আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক। অনেকের মতে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। আদালত কেন এ বিষয়টি নিয়ে এত বেশি উত্সাহ দেখাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২)
উল্লেখ্য, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশের পর সারাদেশে বিচারকের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং সংশ্লিষ্ট বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে বিতর্কের মুখে স্কাইপ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১১-১২-২০১২ তারিখে পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আসিফ নজরুলের ভাষায়, ‘যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইন্টারনেট স্কাইপে তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সংলাপ বিচারকের আচরণবিধির লঙ্ঘন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে একজন বিচারপতি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে পারেন না। কিন্তু তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে যেসব কথা বলেছেন, তাতে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার কাজ প্রভাবিত করার বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিচার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে যে কেসের ব্যাপারে তারা কথা বলেছেন—সেটি চ্যালেঞ্জে পড়েছে এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এছাড়া তিনি ট্রাইব্যুনালের অন্য একজন বিচারপতিকে ‘করাপ্টেড’ বলেছেন, যা ওই বিচারকের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন তুলেছে।’ (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, তাং ১১-১২-২০১২, পৃ.৩)
ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড লন্ডনে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার কাছে রয়েছে। ওই কথোপকথন ইউটিউবে ছাড়া হয় এবং দ্য ইকোনমিস্ট-এর অনলাইনেও ছাপা হয়। একজন বিচারপতি যখন শপথ ভঙ্গ করে বিচার চলাকালীন মামলা ও মামলার রায় কী হতে পারে—তা নিয়ে অন্যের সঙ্গে স্কাইপ করেন, তখন বলা যায়—বিচারের আসনে বসে এটা বিচারের সঙ্গেই অসদাচরণ করা। আর সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে সাংবাদিকদের কাজ। তাছাড়া কোনো সংবাদ যখন জনসম্পৃক্ত থাকে, কেউ যদি সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করে থাকেন, কেউ যদি আইনকে ব্যবহার করতে চান অন্যকে শায়েস্তা করার কাজে, তখন এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ তথ্য অধিকার আইন ও ২০১১ সালের ৭ নং আইনের শিরোনাম হচ্ছে ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষার আইন’। এ আইনে তথ্য প্রকাশকারীর যাবতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ হাইকোর্ট রুল জারি করে তথ্য অধিকার আইনকে অবজ্ঞা করেছে। এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। এই বিশ্বায়নের যুগে মিডিয়া অনেক শক্তিশালী। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও এখন মিডিয়াকে গুরুত্ব দেয়। অথচ বাংলাদেশে মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২, পৃ.৪)
বেলজিয়াম প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপে উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারপতির নামও এসেছে। এর মধ্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের নামও আছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হলো—বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে দেশের আইনজীবী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন মহলে, এমনকি জাতীয় সংসদে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দৈনিক আমার দেশ এর আগে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বিচারপতি তথ্য গোপন করে লন্ডনে বাড়ি ক্রয়সহ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। পরে মাহমুদুর রহমান বিচারপতির বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ১৯টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তাকে অভিশংসনের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন জানান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। গত ৮ নভেম্বর, ২০১২ বঙ্গভবন থেকে চিঠি দিয়ে এই উদ্যোগের কথা মাহমুদুর রহমানকে জানানো হয়। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি চলাকালেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ থেকে আমার দেশ পত্রিকার বিষয়ে রুল জারি করা হলো। অর্থাত্ অভিযুক্ত ব্যক্তিই হয়ে গেলেন বিচারক। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ভাষায়, ‘একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির যদি আগেই অভিযোগ থাকে, তাহলে ওই বিচারপতি অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা শুনতে পারেন না।’ এছাড়া এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য, ‘আজ স্বাধীনতার ৪১ বছর পর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সত্য কথা বলার অপরাধে বাংলাদেশের একজন সাহসী বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে সংবাদপত্রের একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের মাসে ব্যবস্থা গ্রহণ (মামলা দায়ের) জাতীয় পর্যায়ে অত্যন্ত একটি লজ্জাকর ব্যাপার। মানুষ এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের অর্থ গণতন্ত্রের আয়ু ফুরিয়ে আসা। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের পদক্ষেপ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ এছাড়া বিশিষ্ট সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদের ভাষায়, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও সংবাদপত্র তার সূত্র জানাতে বাধ্য না হলেও এখানে সূত্র জানানো বাধ্য করতে চেষ্টা হয়েছে। বিশিষ্ট চিকিত্সক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এজেডএম জাহিদ হোসেনের ভাষায়, মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার মানুষকে সত্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং ১৫-১২-২০১২)
বিচারপতি নিজামুল হক ও প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের শাসনামলে—যা ইতিহাসে ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে খ্যাত। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয় নিক্সনকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই তথ্য ফাঁস করে দেয়ার (অপরাধে!) জন্য সংশ্লিষ্ট ২ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো বিচার বা মামলা হয়নি। বন্ধ হয়নি পত্রিকাটিও। উপরন্তু এই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা আবিষ্কার এবং তা দেশবাসীর সামনে সাহসের সঙ্গে উপস্থাপনের জন্য সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ড রাতারাতি আমেরিকার জাতীয় বীরে পরিণত হন এবং সে বছর সাংবাদিকতায় নোবেল বলে পরিচিত বিখ্যাত ‘পুলিত্সার’ পুরস্কারে ভূষিত হন (সূত্র : আমার দেশ, তাং ১৬-১২-২০১২)। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, একইরকম ঘটনার প্রেক্ষিতে পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমার দেশ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি নিজে আজ জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটি জাতি ও সাংবাদিক জগতের জন্য চরম লজ্জাজনক এবং গণতন্ত্রের চরম পরিপন্থী।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের ভাষায়, ‘...আমার দেশ এরকম একটি অভাবনীয় কাজ করে একটা জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। সাংবাদিকতার জগতে একটি নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এজন্য সম্পাদক মাহমুদুর রহমান শ্রেষ্ঠ সাহসী সম্পাদকের খেতাব পেতে পারেন। স্কাইপে ন্যক্কারজনক কথোপকথন জনসম্মুখে প্রকাশ করে মাহমুদুর রহমান জাতির শ্রেষ্ঠ সেবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই আমরা তাকে নোবেল না দিতে পারলেও স্বাধীনতা পুরস্কার অবশ্যই দিতে পারি।’ (সূত্র : আমার দেশ, তাং ২৪-১২-২০১২)
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি নিজামুল হকের ওপর অর্পিত হয়েছিল জাতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব। ট্রাইব্যুনালের বিচার স্বচ্ছ, ন্যায্য, নিরপেক্ষ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সবার কাছে গ্রহণীয় হোক—এটি সবার দাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান হিসেবে তার দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি (সূত্র : সম্পাদকীয়, দৈনিক ইনকিলাব, তাং ১৩-১২-২০১২)। এতে উচ্চ আদালতের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। একইসঙ্গে আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় ও রায় প্রদানে স্বচ্ছতা নিয়ে দেশবাসীর মনে প্রশ্ন ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে মাহমুদুর রহমান একজন কিংবদন্তি। তিনি সত্, সাহসী ও নির্ভীক কলমসৈনিক। সময়ের সাহসী সন্তান। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। বলিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক দেশপ্রেমিক শ্রেষ্ঠ সাহসী সম্পাদক। দেশপ্রেম ও সততার প্রতীক মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের অহঙ্কার। তার কাছে সবার ওপরে দেশের স্বাধীনতা, দেশের মানুষ ও নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এছাড়া সব সরকারের দুঃশাসন ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার। তিনি বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক নির্ভীক প্রতিবাদী কণ্ঠ। তিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে, এমনকি হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। তার ভাষায়, প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন, তবুও সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে সরে আসবেন না। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সত্য প্রকাশ থেকে তিনি পিছপা বা বিরত হবেন না। মহান আল্লার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, ‘মামলা দিয়ে আমার দেশ পত্রিকার কণ্ঠরোধ করা যাবে না। ২৪টি মামলা হয়েছে। তাতে কি হয়েছে? ২৪ হাজার মামলা হলেও দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ সত্য থেকে পিছপা হবার পাত্র আমার দেশ নয়। (সূত্র : আমার দেশ, তাং ০৫-০২-২০১০)
তাই তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়—‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
দেশের মানুষ যে মুহূর্তে একদলীয় শাসনের নাগপাশ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ ও ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন কর’ আন্দোলনে শরিক, তখন বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। দেশবাসী তাই আজ এই মামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও ক্ষুব্ধ।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের পদত্যাগ প্রমাণ করে যে, ট্রাইব্যুনালের বিষয় নিয়ে স্কাইপ সংলাপ বা কথোপকথনের যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে—তা সঠিক এবং এটি একজন বিচারকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট বিচারপতির স্কাইপ কথোপকথনের বিষয়ে কোনো তদন্ত না করে উল্টো আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করাটা জনগণ ভালো চোখে দেখছে না এবং এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে একদিকে আদালতের ওপর মানুষের আস্থা কমে আসবে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। পাশাপাশি এই মামলা রুজুর কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদাও দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা সরকারের জন্যও মঙ্গলজনক নয়। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের পদক্ষেপ (মামলা) কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ (মামলা) গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে এবং দেশে গণতন্ত্রের ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mondalsh52@yahoo.co
m
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন