বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

সরকারের সফলতা ও বিফলতা একটি পর্যালোচনা



ড. আবদুল হাই তালুকদার

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। মানুষ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা প্রাপ্তিতে এক বুক আশা নিয়ে দিনবদলের প্রকৃতি ও পদ্ধতির দিকে তাকিয়ে ছিল। সবাই আশা করেছিল দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। মোটা ভাত ও মোটা কাপড় পড়ে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার আন্তরিক থাকবে—এ রকম প্রত্যাশা করে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভূমিধস বিজয় উপহার দেয়। কিন্তু পঞ্চম বছরে পা দিলেও মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। রাজনীতি একটি চাতুর্যপূর্ণ কৌশল। নির্বাচনের আগে ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে দেয়। চাপাবাজি করে গালগপ্প করে মানুষকে ভুলিয়ে ভোট আদায় করা হয়। এ প্রসঙ্গে বুড়ি ও উট কোরবানির গল্পটি আমি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বাচ্চা প্রসবে বুড়ির ছাগীর পেরেশান হতে দেখে বুড়ি বলে, ‘আল্লাহ, আমার ছাগীটি ভালোভাবে বাচ্চা প্রসব করলে আমি উট কোরবানি দেব।’ এ কথা শুনে এক দুর্মুখ বলে, ‘ও বুড়ি, উটের দাম জান? একটি উট কিনতে তোমার ৪০টি ছাগী লাগবে।’ বুড়ি উত্তরে বলে, ‘চুপ কর, আগে ছাগীটি বাচ্চা দিক, পরে দেখা যাবে।’ অর্থাত্ ছাগী বাচ্চা দেয়ার পর বুড়ি আর উট কোরবানি দেবে না। আল্লাহ তো আর বুড়িকে ধরতে আসবে না।
আমাদের সরকারের অবস্থা হয়েছে বুড়ির দেয়া ওয়াদার মতো। ১০ টাকা কেজি চাল, ঘরে ঘরে চাকরি, বিনা মূল্যে সার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা। কিন্তু সরকারের মেয়াদ পঞ্চম বছরে পদার্পণ করলেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, জিনিসপত্রের মূল্য কমানো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিদ্যুত্প্রাপ্তির নিশ্চয়তা—এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই সরকার পূরণ করতে পারেনি। বুড়ির মতো কার্যোদ্ধারের প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমে সীমিত রয়েছে। ১০ টাকা কেজিতে চাল, বিনা মূল্যে সার, ঘরে ঘরে চাকরি প্রভৃতি অবাস্তব ও আকাশ-কুসুম প্রতিশ্রুতি মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণ কেবল অবাস্তবই নয়, অসম্ভব ব্যাপার। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ঘরে ঘরে চাকরি দিতে হলে অন্তত তিন কোটি কর্মসংস্থান করতে হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে তিন কোটির বেশি বেকার। এত অধিক সংখ্যক বেকারের কর্মসংস্থান করতে গেলে সরকারের তরফ থেকে বিশাল কর্মসংস্থানের প্রকল্প আবশ্যক, যা সরকার গত চার বছরে কিছুই করতে পারেনি। শত শত কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাখ লাখ শ্রমিক ফেরত আসছে। অবশ্য আশার কথা হলো মালয়েশিয়া পাঁচ লাখ শ্রমিক পাঁচ বছরে নিতে চেয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। নতুন বছরে সরকার ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম পাঁচ-ছয় টাকা লিটারপ্রতি বাড়িয়ে জনগণের ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা চাপিয়ে দিয়েছে।
পরিবহন ভাড়া, শিল্পদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। মানুষের দুর্দশা উপেক্ষা করে চাহিদাকে পদদলিত করে, আকুতিকে অগ্রাহ্য করে সরকার সম্পূর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একগুঁয়েমি করে তেল, গ্যাস, বিদ্যুত্ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে চলেছে, যার অনিবার্য পরিণতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। মানুষ সম্পূর্ণ অসহায় ও নিরুপায় হয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করছে, আর নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। খেটে খাওয়া ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবননির্বাহ দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। নতুন বছরে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল, অকটেনের মূল্য বাড়ার প্রভাব সরাসরি কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের ওপর পড়বে। বাংলাদেশে এখনও শত শত হাজার হাজার গ্রাম বিদ্যুত্বঞ্চিত। গ্রামের মানুষকে কেরোসিনের চেরাগ জ্বালিয়ে রাত কাটাতে হয়। ৬৮ টাকা লিটার তেল কিনে চেরাগ জ্বালানো তাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব হবে না। এতে বহু দরিদ্র, অসহায় ও নিঃসম্বল মানুষকে নিষ্প্রদীপ রাত্রি যাপন করতে হবে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি আগামী সেচ মৌসুমে চাষাবাদকে দারুণভাবে বিঘ্নিত করবে। তিন হাজার টাকা বিঘাপ্রতি পানি সেচে ব্যয় করে কৃষক ফতুর হয়ে পড়বে। এমনিতে তারা লোকসান দিয়ে অনোন্যপায় হয়ে চাষাবাদ করছে। সেচের মূল্যবৃদ্ধি তাদের সত্যিই বিপন্ন করবে। সরকার এ দেশের গরিব মানুষের প্রতি কেন যে এত নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করছে, আমাদের বোধগম্য নয়। সর্বব্যাপী ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, দখলবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, উত্কট দলীয়করণে মানুষ এমনিতে ত্যক্তবিরক্ত, তার ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ একেবারে সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও দেশের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও অসততার চিত্র মানুষকে সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে উত্সাহিত করবে। কত বিলিয়ন রিজার্ভ তা দেখে গরিবের পেট ভরবে না। তাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। পাতে যা পড়ে, তাতেই তাদের আনন্দ।
সরকারের সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মাঝে কৃষিক্ষেত্রে যেটুকু সফলতা বিদ্যমান ছিল, ডিজেল-কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে তাও ম্লান হতে চলেছে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি মানুষ স্বচক্ষে অবলোকন করছে। দিনে-দুপুরে মানুষকে পিটিয়ে মারা, খুন, জখম, গুম, নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা। বড়াইগ্রামে দিনে-দুপুরে নির্বাচিত মেয়র বাবু হত্যা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির নিকৃষ্ট উদাহরণ, ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্তকরণের কথা বলা হলেও পরে নিভে গেছে। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী ইত্যাদি গুমের রহস্য উদঘাটনে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ। বড় বড় রাজনৈতিক নেতা গুম-খুনের রহস্য পাওয়া দুঃসাধ্য। মানুষ অবাক বিস্ময়ে বিরোধীদলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থকের গুম-খুন গত চার বছরে প্রত্যক্ষ করছে। এই চার বছরে বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মী গুম ও খুনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমত দলন-পীড়ন, নগ্ন দলীয়করণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা, হামলা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন সুশাসনকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কত রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহায়ত্বের করুণ চিত্র তুলে ধরছে। এ চার বছরে ১৪ সাংবাদিক খুনের ঘটনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মানুষ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে চরমভাবে হতাশ ও উদ্বিগ্ন। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের কর্মকাণ্ডের চিত্র নিয়মিত প্রকাশ করলেও সরকারের তরফ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। র্যাবের পরিচয়ে ধরা হচ্ছে, পরে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কারও লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬নং ওয়ার্ডের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে র্যাবের পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। গতকাল (০৫.০১.২০১৩) কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অনেকখানি শক্তিশালী। তাদের এ ধরনের করুণ মৃত্যুতে সাধারণ মানুষ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। সভ্য দেশে এ ধরনের করুণ মৃত্যু অকল্পনীয় ও অভাবনীয় বিষয়।
দেশ-বিদেশের সমালোচনার মুখে র্যাবের বিনা বিচারে মানুষ হত্যা কিছুটা কমলেও গুম-খুন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে। গত চার বছরে হাজার হাজার খুন, কয়েকশ’ লোক গুম, গণপিটুনিতে বহু লোকের প্রাণহানি, গণধর্ষণে কয়েক ডজন নারী নিধন সরকারের ব্যর্থতার চরম নিদর্শন।
ফরিদপুরে ধর্ষণের পর চম্পাকে হত্যা, টাঙ্গাইলে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ, সাভারে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ ও ভিডিওচিত্র ধারণ, বাগেরহাটে মা-মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যা, ফুলবাড়ীতে গৃহবধূকে এবং ঢাকায় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষক পাষণ্ড নরপশুদের লালসার শিকার হয়ে অনেকেই এভাবে মৃত্যুবরণ করে। চার দশকে ২৫ আসামিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ মাত্র চার বছরে ২১ জনকে ক্ষমা করে আইনের শাসনকে ব্যঙ্গ করেছে। খুনের আসামিকে ক্ষমা করে সন্ত্রাসীদের উত্সাহ দেয়া হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার রায়কে গোপনে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হলেও সরকার নির্বিকার। দাগি আসামিদের মুক্ত করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী দিয়ে জেলখানায় শূন্যস্থান পূরণ করা হচ্ছে। জেলখানায় ধারণক্ষমতার তিন-চার গুণ বন্দিকে রাখায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপরাধ করে সাজার বদলে পুরস্কৃত হওয়ায় অপরাধীরা দ্বিগুণ উত্সাহে কুকর্ম করবে, এটা স্বাভাবিক। অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। শাস্তি পাওয়ায় সে তার অপরাধের ফল ও পরিণতি ভোগ করে। এতে কৃতকর্মের জন্য তার অনুশোচনা হয় এবং নিজকে শোধরানোর চেষ্টা করে। তাছাড়া অপরাধ করে শাস্তি পেলে অন্যরা নিরুত্সাহিত হয়। বিচারকের বাণী, ‘ভেড়া চুরি করার জন্য নয়, আর যাতে ভেড়া চুরি না হয় সে কারণে শাস্তি দেয়া হয়।’ এক্ষেত্রে অপরাধীকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হলেও অপরাধ নিবারণে শাস্তি বিরাট ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়।
পদ্মা সেতু নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম। এই সেতু নির্মাণের আগে ঠিকাদার নিয়োগে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগে দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশ বিশ্বচোরের উপাধি লাভ করেছে। অনেক ধানাই-পানাই করার পর সাতজনকে আসামি করে যে মামলা হয়েছে, তাতে নাটের গুরু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে বাদ দেয়া হয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করে, এ দুর্নীতির সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মানুষ আরও বিশ্বাস করে, মন্ত্রীকে আসামি করলে অনেক রাঘব-বোয়াল জড়িয়ে যাবে, যে কারণে সরকারের শীর্ষ মহলের ইঙ্গিতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়েছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। স্বপ্নের সেতু বাস্তবায়ন কয়েকজনের দুর্নীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশের মানুষ অত্যন্ত অখুশি। কোনো বড় প্রকল্প না নিয়ে ছোট ছোট প্রকল্পও দুর্নীতির কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চট্টগ্রামের বহদ্দার হাটে ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ না হতে ভেঙে পড়ে ১০-১৫ জন মানুষ মারা গেছে। এতে সারা দেশের নির্মাণকাজের স্থায়িত্ব নিয়ে জনমনে শঙ্কা রয়েছে। এসব টেন্ডারবাজির অশুভ ফল বলে মানুষ বিশ্বাস করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য দেখা গেলেও গভীরভাবে চিন্তা করলে শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য ধরা পড়ে। সময়মত পাঠ্যপুস্তক ছেলেমেয়েদের হাতে পৌঁছানো হয়েছে সত্য, তবে তাতে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না। প্রাথমিক পরীক্ষায় ৩০ লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করলেও জেএসসিতে ১৪ লাখে নেমে আসছে, যা দেশের আর্থসামাজিক দৈন্য দশার ইঙ্গিতবহ। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত অভিভাবকরা প্রাথমিক শিক্ষার পর আর ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারছে না। বলা হয়, মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য দশা কেটে গেছে, যা সর্বৈব মিথ্যা। গ্রামে কর্মসংস্থানের প্রচণ্ড অভাব। অভিভাবকরা বিনা মূল্যে বই পেলেও শিক্ষাকার্যক্রম অভাবের কারণে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান জোগাড় করতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। সন্তানদের লেখাপড়ার বদলে তাদের কর্মসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়া পছন্দ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি ছাত্রসংগঠন ভিন্নমতের ছাত্রদের অনেক আগেই বের করে দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। নিজেদের মধ্যে কোন্দলে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি শিক্ষাক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর বহন করে না। উত্কট দলীয়করণ চলছে অবাধে। উত্কট দলীয়করণ করতে গিয়ে ’৭৩ সালের অধ্যাদেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করে ফ্যাক্টরি বানানো হচ্ছে। মেধাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়ায় শিক্ষার গুণগত মান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে সফলতার নিদর্শন নয়।
সীমান্তে ফেলানীর লাশ দেখে মানুষ হতবাক ও বিস্মিত হলেও কিন্তু ফেলানীনিধন বন্ধ হয়নি। সীমান্তে শত শত লাশ পড়তে দেখেও সরকার কার্যকর উদ্যোগ, এমনকি জোরালো প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজেন ও সেভাবে কথা বলেন, তখন মনে হয় ধরিত্রী দ্বিধা হও। কূটনীতিতে চরমভাবে ব্যর্থ এ সরকার জীবন ও সম্পদের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারেনি। তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধনির্মাণ বন্ধ, সীমান্তে হত্যা বন্ধ ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রে সরকার সফলতা দেখাতে পারেনি। কোনো দেশ নিজের দেশের নদীতে বালির বস্তা ফেলে নদী বন্ধ করে অন্য দেশের যানবাহন চলাচল করতে দিয়েছে, এমন ইতিহাস বিরল। আমরা আশুগঞ্জে নদী বন্ধ করে ভারতকে বিনা শুল্কে ট্রানজিট দিয়েছি। ট্রানজিট, স্থলবন্দর, নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ পেলেও ভারত কিন্তু আমাদের কোনো দাবি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। বন্ধুত্বের কোনো নমুনা ভারত দেখায়নি। নববর্ষের প্রথম চার দিনে চারজনকে সীমান্তে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে বন্ধুত্বের বদলে বৈরিতা প্রদর্শন করে চললেও সরকারি তরফ থেকে প্রতিকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ ১৪-১৫ টাকা নির্ধারণ করে কুইক রেন্টাল স্থাপন করা হয়েছে। চার-পাঁচ টাকা খরচ করে স্থায়ী বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে সরকার চার বছরে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি পুরনো বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো মেরামত না করে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কুইক রেন্টাল স্থাপন করে সরকার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কুইক রেন্টালে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের প্রবল সমালোচনা ও আপত্তি অগ্রাহ্য করে সরকার একগুঁয়েভাবে কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুত্ কিনে দলীয় লোকজনকে লাভবান করছে, ফতুর হচ্ছে সাধারণ ভোক্তারা। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার কারণে দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সরকার জনগণের পকেট কেটে ভর্তুকি মোকাবিলা করছে, যা অত্যন্ত অন্যায্য ও অনৈতিক। সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রেখে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার বদলে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও কষ্টে ফেলেছে।
বড় বড় অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও লুটপাট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে ফেলেছে। আমরা এর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে না পারলেও দীর্ঘ মেয়াদের এসব দুর্নীতি লুটপাটের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া অর্থনীতির ওপর পড়তে বাধ্য। শেয়ারবাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কোনো বিচার বা সুরাহা হয়নি। রাঘব বোয়ালরা সরকারের কাছের লোক বলে তদন্ত কমিটি কাগজে-কলমে হিমঘরে বন্ধ রয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপ, সোনালী ব্যাংক, রেলওয়ে কেলেঙ্কারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৃহত্ বৃহত্ অর্থ কেলেঙ্কারি মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে ও ভাবিয়ে তুলেছে। ডেসটিনি গ্রুপের কর্তাব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেয়ায় অর্থ উদ্ধার নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগে এক হাওয়া ভবন নিয়ে যেসব কল্পকাহিনী ছড়ানো হতো বর্তমানে বহু হাওয়া ভবন দেশে বর্তমান রয়েছে। ৯৭ শতাংশ এমপির দুর্নীতিগ্রস্ততার রিপোর্টই সরকারের চার বছরের কর্মকাণ্ডের দলিল। টাকা ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হয় না। ঘুষ, দুর্নীতি সামাজিক চরিত্রকে কলুষিত করেছে। এসব বড় কেলেঙ্কারির যে কোনো একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকার পতনের জন্য যথেষ্ট। আমরা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেও হজম করছি। টিআইবি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে কেবল সেবা খাতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এটি বন্ধ করতে পারলে প্রবৃদ্ধি ২.৪ শতাংশ বাড়ত। আর বড় বড় দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে প্রবৃদ্ধি বাড়ত তিন শতাংশ। আর তাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতো।
বলা হয়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে সরকার সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। জঙ্গিবাদের উত্পত্তি চারদলীয় জোট সরকারের সময় ঘটলেও সেই সরকারই এসবকে প্রশ্রয় না দিয়ে দমনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। জোট সরকারই শায়েখ আবদুর রহমান, বাংলাভাই প্রমুখ জঙ্গিদের গ্রেফতার করে বিচার করেছে। এদের কাউকে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেননি। রামুর ঘটনা জাতীয় লজ্জা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ব্যর্থতা প্রমাণিত। জাতিসংঘের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বছরে ৩০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে। লুটপাট, পাচারের মহোত্সব চলছে। তবে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে, সরকারের পুলিশ বাহিনী বিরোধী দল দমনে পারদর্শী। হাওয়ায় পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও রিমান্ডে নিয়ে পিটিয়ে জখম করতে সিদ্ধহস্ত। নির্যাতনে এরই মধ্যে অনেক নেতাকর্মী মারা গেছে। গুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদি প্রতিরোধ বা রহস্য উদঘাটনে পুলিশবাহিনী ব্যর্থ হয়েছে।
গত চার বছরে সরকারের সফলতা একবারে নেই তা বলব না। তবে বিশাল বিশাল দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতার ছোট-খাটো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো ঢাকা পড়ছে। সাংবাদিক নির্যাতন, গণমাধ্যমের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া, টকশো নিয়ে কটু মন্তব্য ও টকশোতে অংশগ্রহণকারীকে তেড়ে মারতে যাওয়া ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি, নির্যাতন, রাজপথে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতন, ১৪৪ ধারা দিয়ে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ পণ্ড করা, সীমান্তে মানুষ হত্যা ছিল নিত্যদিনের বিষয়, যার প্রতিবাদ সরকারের তরফ থেকে করা হয়েছে অতি সামান্য। এ সময়ে বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান বাবু ও বিশ্বজিেক দিনে-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখে মানুষ বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে। দুঃশাসন, দুর্নীতি ও লুটপাট সরকারের সাফল্যকে ম্লান করেছে। মানুষ আওয়ামী লীগের শাসনকে বুড়ির ছাগীর বাচ্চা প্রসবের সঙ্গে তুলনা করে।

লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads