সৈয়দ আবদাল আহমদ
মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি দেশনায়ক জিয়াউর রহমানের ৭৭তম জন্মবার্ষিকী কাল। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারির এই দিনটিতে বগুড়ার বাগবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী আজ এমন একটি সময়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে, যখন তার প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পার করছে একটি চরম ও কঠিন সময়। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা চলছে। দলটিতে ভাঙন সৃষ্টি করে দুর্বল করে দেয়া যায় কি-না, তার ষড়যন্ত্র চলছে। কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দলটি। বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে দেয়াও হচ্ছে না।
মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপিকে শেষ করে দেয়ার জন্য এর ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের তাণ্ডব চালিয়েছিল। হারিছ চৌধুরী ধরনের কিছু লোকের অপকীর্তিকে পুঁজি করে জরুরি সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতাকে জেলে বন্দী করে; বন্দী করে শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে। তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়। জরুরি সরকারের সেই দুঃসহ আমলের অবসান হয়েছে, কিন্তু অবসান হয়নি নির্যাতনের।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি ধ্বংসে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। জিয়ার গড়া বিএনপি কেন ক্ষমতায় আসে, এ দলটি কেন এত জনপ্রিয়—সেটাই তাদের মাথাব্যথার কারণ।
জরুরি সরকার খালেদা-হাসিনা দু’জনকেই জেলে বন্দী করেছিল। তাদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এবং দেশকে রাজনীতিকশূন্য করার জন্য ‘মাইনাস টু ফরমুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু সেদিন তাদের সে চেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যায়। দু’নেত্রীর মুক্তির পর মানুষ আশা করেছিল, রাজনীতি এখন একটি স্বাভাবিক গতিতে এগোবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে কাজ করবে। একে অপরের শত্রু হবে না। একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না। কিন্তু না। সেটা দুরাশায় পরিণত হলো। বিএনপি যাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে না পারে, সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই মরিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সে লক্ষ্যে তারা কাজ শুরু করে। জাতীয় নির্বাচন যাতে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে না পারে, সেজন্য সংবিধান থেকে তারা সে ব্যবস্থাটি উঠিয়ে দেয়। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু সেই আন্দোলনকে নানাভাবে সরকার বানচাল করে দিচ্ছে। তাদের লক্ষ্য এখন দল হিসেবে বিএনপিকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়া।
জরুরি সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে এমনিতেই বিএনপি ছিল পর্যুদস্ত। ধীরে ধীরে দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএনপি ধ্বংসে তত্পরতা চালিয়েছে। জরুরি সরকারের সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, সেসব মামলা সরকার তুলতে দেয়নি। উপরন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হয়েছে নতুন নতুন অসংখ্য মামলা। মামলা দেয়া হয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে। স্থায়ী কমিটি, সহ-সভাপতি, উপদেষ্টা কমিটি, নির্বাহী কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে। সর্বনিম্ন পাঁচটি থেকে সর্বোচ্চ ১০০টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। বিএনপির কোনো নেতা মাথা তুলে দাঁড়ালেই মামলা দিয়ে হয় তাকে জেলে নেয়া হচ্ছে, না হয় হয়রানি করা হচ্ছে। জিয়া পরিবারের নামে এখন ২৫টি মামলা ঝুলছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার নামে পাঁচটি, তারেক রহমানের নামে ১৪টি, কোকোর নামে পাঁচটি এবং জোবায়দা খানমের নামে একটি মামলা রয়েছে। কোনো নেতা কোনো একটি এলাকায় জনপ্রিয় বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেলেই তার দিকে পড়ছে সরকারের শ্যেন দৃষ্টি। ইলিয়াস আলী সিলেট অঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাকে গুম করে দেয়া হয়েছে। তার গুম হওয়ার প্রায় এক বছর হতে চলল। ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন না গুম-হত্যার শিকার হয়েছেন, কেউ বলতে পারে না। তেমনি চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়েছে। তারেক রহমান যাতে দেশে ফিরতে না পারেন, সেজন্য সব চেষ্টা নেয়া হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব হিসেবে ইতোমধ্যে সুনাম অর্জন করেছেন। তার নামের আগে জনগণ দিয়েছে একজন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকের খ্যাতি। দেশব্যাপী তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিএনপি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। ঠিক এ সময়েই তাকে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হলো। প্রথম গ্রেফতারের পর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় আবার তাকে গ্রেফতার করে একটির পর একটি মামলা দেয়া হচ্ছে। একটি মামলায় জামিন পেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এভাবে তাকে জেলে বন্দী করে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে। এবার তাকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য জরুরি সরকার আমলের করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় চার্জশিট গ্রহণ করা হয়েছে। বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে বাধা দেয়া হচ্ছে। নয়াপল্টনের মধ্যে বিএনপির কর্মসূচিকে সীমিত করে দেয়া হচ্ছে। কোনো হরতাল হলে দেখা যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় শত শত পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। কর্মীরা যাতে পিকেটিংয়ে নামতে না পারেন, সেজন্য মোবাইল কোর্ট দিয়ে হয়রানিমূলক সাজা দেয়া হচ্ছে। দলের অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আজ ৩৪ দিন ধরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এভাবে বিএনপি এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এ রাজনৈতিক দল ৩৪ বছর পার করেছে। এর মধ্যে ক্ষমতায় এসেছে পাঁচবার। দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সিংহভাগ হয়েছে এ দলের হাতে। এবার তৃতীয়বারের মতো দলটি বিরোধী দলে অবস্থান করছে। এরশাদের শাসনামলে বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের আমলে দলটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এখন বিএনপিকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
তবে সরকারি নির্যাতনের পাশাপাশি বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও কম নয়। একটি ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিএনপির অতীত ধারণা রয়েছে। সে ধারণা থেকে যতটা দূরদর্শী হয়ে বিএনপিকে রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা করতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে। পরিকল্পনা করে আন্দোলন-সংগ্রাম যেভাবে করা উচিত ছিল, সেটা করতে পারেনি বিএনপি। অথচ শেখ হাসিনা সরকারের রয়েছে পাহাড়সমান ব্যর্থতা। এতসব কুকীর্তির নজির স্থাপন করেছে সরকার, যার কোনো অতীত উদাহরণ নেই। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এগুলো ক্যাশ করতে পারেনি। দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট, খুন, গুম, গুপ্ত হত্যার বন্যা বইছে। সরকারের জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। এর পুরো বেনিফিট বিএনপির পাওয়ার কথা, কিন্তু বিএনপি কিছুই করতে পারছে না। বিএনপি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করবে, বুঝতে পারছে না। অনেক বিশ্লেষকেরই মন্তব্য, বিএনপি দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারত। তাদের মতে, আন্দোলন বলতে শুধু হরতাল-অবরোধ করাই নয়, নানাভাবে আন্দোলন করা যায়। কখনও হরতাল অবরোধ, আবার কখনও মানবাধিকার কনভেনশন, পেশাজীবী কনভেশন করে অপকীর্তিগুলো তুলে ধরা যায়। নির্যাতনবিরোধী ফটো প্রদর্শনী করা যায়। বড় বড় জালিয়াতি, লুটপাট ও দুর্নীতির ঘটনায় গণতদন্ত কমিশন করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এগুলোর ফলাও প্রচার করা যায়। দল সংগঠিত করার জন্য প্রতিটি অঙ্গদলের সম্মেলন, কাউন্সিল করা যায়; তেমনি গণমিছিল, রোডমার্চ, লংমার্চ, অনশন করা যায়। এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়েও প্রতিবাদ করা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লংমার্চ বর্তমান সময়ে একটি অপরিহার্য বিষয় হতে পারত। এভাবে ধারবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। বিএনপি সেভাবে চিন্তা করেনি।
জরুরি সরকার বিএনপি সম্পর্কে জনমনে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছে। এ অপপ্রচার বর্তমান সরকারও চালাচ্ছে। এ অপপ্রচারের শক্ত জবাব বিএনপি থেকে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। তেমনি বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এলে জনগণের জন্য কী করবে, দেশের জন্য কী করবে, তার একটি রূপরেখা মানুষ জানতে চায়। সেটা এখন পর্যন্ত বিএনপি তুলে ধরতে পারেনি। বিএনপির ভিশন মানুষকে না জানালে তারা দলটি সম্পর্কে আকৃষ্ট হবে কীভাবে? বুঝতে পারবে কীভাবে বিএনপি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি কেন বারবার ক্ষমতায় যায়, এ দলের এত জনপ্রিয়তা কেন—সেটা বুঝতে হবে। আর সেভাবেই বিএনপির নেতৃত্বকে চিন্তা করা উচিত।
একজন জিয়াকে যেভাবে স্মরণ করবে মানুষ
বাংলাদেশের মানুষ আগামীকাল ১৯ জানুয়ারি ৭৮তম জন্মদিনে দেশনায়ক জিয়াউর রহমানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এ নামটি জড়িয়ে আছে এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে। একাত্তরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে মানুষের হৃদয়-মনে যেমন স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, তেমনি একাত্তরের রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং পরে দেশ পরিচালনায় দূরদর্শী ভূমিকা রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন অক্লান্ত কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠন করেন এবং এ দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। সামরিক অফিসার হয়েও গণতন্ত্রের প্রতি তার গভীর আস্থা ছিল এবং তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, জনগণই ক্ষমতার উত্স। তিনি বলতেন, সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। গণতন্ত্রই এ পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট ব্যবস্থা।
বহুদলীয় রাজনীতি চালু করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে তিনি দেশের মানুষকে সুসংগঠিত করেন। বাংলাদেশকে তিনি বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সংহতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আত্মীয়তার বন্ধনের উদ্দেশ্যে তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালান। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনে সার্ক গঠনের স্বপ্ন তিনিই দেখেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার আপ্রাণ চেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে বলিষ্ঠ ও গতিশীল ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ তিনিই দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের মান উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণের জন্য তিনি অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। জিয়াউর রহমান একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এবং এ লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যেমন স্থিতিশীলতা এনেছেন, তেমনি দেশটিকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ৭০ হাজার গ্রামকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যেই ছিল তার গ্রাম মার্চ। তিনি হেঁটে হেঁটে প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে এবং কৃষকের পর্ণকুটিরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দেশনায়ক জিয়াউর রহমান জনগণকে খাদ্য উত্পাদন, জন্মনিয়ন্ত্রণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক হাজারের উপরে খালখননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করে উত্পাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে তিনি দেশব্যাপী একটি শান্তিপূর্ণ বৈপ্লবিক উন্নয়ন কর্মসূচি দেশবাসীর সামনে দেন, যার সুফল মানুষ পেয়েছে। তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম একটি দিক হচ্ছে স্বনির্ভরতা অর্জন। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমাদের সম্পদ সীমিত। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেশটিকে গড়তে হবে।
জিয়াউর রহমান এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি সামরিক জেনারেল হিসেবে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমন আরেকটি দৃষ্টান্ত ছিল ফ্রান্সের জেনারেল দ্য গলের। বাংলাদেশের জন্য তিনি একটি মাল্টি পার্টি সিস্টেম বা বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন অত্যন্ত সত্ একজন মানুষ। তিনি অতি সরল জীবনযাপন করতেন। অতি সাধারণ কাপড়-চোপড় পরতেন। তিনি আজ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশ এক অন্য বাংলাদেশ হিসেবে রূপলাভ করত।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপিকে শেষ করে দেয়ার জন্য এর ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের তাণ্ডব চালিয়েছিল। হারিছ চৌধুরী ধরনের কিছু লোকের অপকীর্তিকে পুঁজি করে জরুরি সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতাকে জেলে বন্দী করে; বন্দী করে শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে। তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়। জরুরি সরকারের সেই দুঃসহ আমলের অবসান হয়েছে, কিন্তু অবসান হয়নি নির্যাতনের।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি ধ্বংসে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। জিয়ার গড়া বিএনপি কেন ক্ষমতায় আসে, এ দলটি কেন এত জনপ্রিয়—সেটাই তাদের মাথাব্যথার কারণ।
জরুরি সরকার খালেদা-হাসিনা দু’জনকেই জেলে বন্দী করেছিল। তাদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এবং দেশকে রাজনীতিকশূন্য করার জন্য ‘মাইনাস টু ফরমুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু সেদিন তাদের সে চেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যায়। দু’নেত্রীর মুক্তির পর মানুষ আশা করেছিল, রাজনীতি এখন একটি স্বাভাবিক গতিতে এগোবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে কাজ করবে। একে অপরের শত্রু হবে না। একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না। কিন্তু না। সেটা দুরাশায় পরিণত হলো। বিএনপি যাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে না পারে, সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই মরিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সে লক্ষ্যে তারা কাজ শুরু করে। জাতীয় নির্বাচন যাতে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে না পারে, সেজন্য সংবিধান থেকে তারা সে ব্যবস্থাটি উঠিয়ে দেয়। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু সেই আন্দোলনকে নানাভাবে সরকার বানচাল করে দিচ্ছে। তাদের লক্ষ্য এখন দল হিসেবে বিএনপিকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়া।
জরুরি সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে এমনিতেই বিএনপি ছিল পর্যুদস্ত। ধীরে ধীরে দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএনপি ধ্বংসে তত্পরতা চালিয়েছে। জরুরি সরকারের সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, সেসব মামলা সরকার তুলতে দেয়নি। উপরন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হয়েছে নতুন নতুন অসংখ্য মামলা। মামলা দেয়া হয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে। স্থায়ী কমিটি, সহ-সভাপতি, উপদেষ্টা কমিটি, নির্বাহী কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে। সর্বনিম্ন পাঁচটি থেকে সর্বোচ্চ ১০০টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। বিএনপির কোনো নেতা মাথা তুলে দাঁড়ালেই মামলা দিয়ে হয় তাকে জেলে নেয়া হচ্ছে, না হয় হয়রানি করা হচ্ছে। জিয়া পরিবারের নামে এখন ২৫টি মামলা ঝুলছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার নামে পাঁচটি, তারেক রহমানের নামে ১৪টি, কোকোর নামে পাঁচটি এবং জোবায়দা খানমের নামে একটি মামলা রয়েছে। কোনো নেতা কোনো একটি এলাকায় জনপ্রিয় বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেলেই তার দিকে পড়ছে সরকারের শ্যেন দৃষ্টি। ইলিয়াস আলী সিলেট অঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাকে গুম করে দেয়া হয়েছে। তার গুম হওয়ার প্রায় এক বছর হতে চলল। ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন না গুম-হত্যার শিকার হয়েছেন, কেউ বলতে পারে না। তেমনি চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়েছে। তারেক রহমান যাতে দেশে ফিরতে না পারেন, সেজন্য সব চেষ্টা নেয়া হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব হিসেবে ইতোমধ্যে সুনাম অর্জন করেছেন। তার নামের আগে জনগণ দিয়েছে একজন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকের খ্যাতি। দেশব্যাপী তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিএনপি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। ঠিক এ সময়েই তাকে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হলো। প্রথম গ্রেফতারের পর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় আবার তাকে গ্রেফতার করে একটির পর একটি মামলা দেয়া হচ্ছে। একটি মামলায় জামিন পেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এভাবে তাকে জেলে বন্দী করে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে। এবার তাকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য জরুরি সরকার আমলের করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় চার্জশিট গ্রহণ করা হয়েছে। বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে বাধা দেয়া হচ্ছে। নয়াপল্টনের মধ্যে বিএনপির কর্মসূচিকে সীমিত করে দেয়া হচ্ছে। কোনো হরতাল হলে দেখা যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় শত শত পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। কর্মীরা যাতে পিকেটিংয়ে নামতে না পারেন, সেজন্য মোবাইল কোর্ট দিয়ে হয়রানিমূলক সাজা দেয়া হচ্ছে। দলের অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আজ ৩৪ দিন ধরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এভাবে বিএনপি এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এ রাজনৈতিক দল ৩৪ বছর পার করেছে। এর মধ্যে ক্ষমতায় এসেছে পাঁচবার। দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সিংহভাগ হয়েছে এ দলের হাতে। এবার তৃতীয়বারের মতো দলটি বিরোধী দলে অবস্থান করছে। এরশাদের শাসনামলে বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের আমলে দলটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এখন বিএনপিকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
তবে সরকারি নির্যাতনের পাশাপাশি বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও কম নয়। একটি ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিএনপির অতীত ধারণা রয়েছে। সে ধারণা থেকে যতটা দূরদর্শী হয়ে বিএনপিকে রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা করতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে। পরিকল্পনা করে আন্দোলন-সংগ্রাম যেভাবে করা উচিত ছিল, সেটা করতে পারেনি বিএনপি। অথচ শেখ হাসিনা সরকারের রয়েছে পাহাড়সমান ব্যর্থতা। এতসব কুকীর্তির নজির স্থাপন করেছে সরকার, যার কোনো অতীত উদাহরণ নেই। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এগুলো ক্যাশ করতে পারেনি। দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট, খুন, গুম, গুপ্ত হত্যার বন্যা বইছে। সরকারের জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। এর পুরো বেনিফিট বিএনপির পাওয়ার কথা, কিন্তু বিএনপি কিছুই করতে পারছে না। বিএনপি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করবে, বুঝতে পারছে না। অনেক বিশ্লেষকেরই মন্তব্য, বিএনপি দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারত। তাদের মতে, আন্দোলন বলতে শুধু হরতাল-অবরোধ করাই নয়, নানাভাবে আন্দোলন করা যায়। কখনও হরতাল অবরোধ, আবার কখনও মানবাধিকার কনভেনশন, পেশাজীবী কনভেশন করে অপকীর্তিগুলো তুলে ধরা যায়। নির্যাতনবিরোধী ফটো প্রদর্শনী করা যায়। বড় বড় জালিয়াতি, লুটপাট ও দুর্নীতির ঘটনায় গণতদন্ত কমিশন করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এগুলোর ফলাও প্রচার করা যায়। দল সংগঠিত করার জন্য প্রতিটি অঙ্গদলের সম্মেলন, কাউন্সিল করা যায়; তেমনি গণমিছিল, রোডমার্চ, লংমার্চ, অনশন করা যায়। এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়েও প্রতিবাদ করা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লংমার্চ বর্তমান সময়ে একটি অপরিহার্য বিষয় হতে পারত। এভাবে ধারবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। বিএনপি সেভাবে চিন্তা করেনি।
জরুরি সরকার বিএনপি সম্পর্কে জনমনে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছে। এ অপপ্রচার বর্তমান সরকারও চালাচ্ছে। এ অপপ্রচারের শক্ত জবাব বিএনপি থেকে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। তেমনি বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এলে জনগণের জন্য কী করবে, দেশের জন্য কী করবে, তার একটি রূপরেখা মানুষ জানতে চায়। সেটা এখন পর্যন্ত বিএনপি তুলে ধরতে পারেনি। বিএনপির ভিশন মানুষকে না জানালে তারা দলটি সম্পর্কে আকৃষ্ট হবে কীভাবে? বুঝতে পারবে কীভাবে বিএনপি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি কেন বারবার ক্ষমতায় যায়, এ দলের এত জনপ্রিয়তা কেন—সেটা বুঝতে হবে। আর সেভাবেই বিএনপির নেতৃত্বকে চিন্তা করা উচিত।
একজন জিয়াকে যেভাবে স্মরণ করবে মানুষ
বাংলাদেশের মানুষ আগামীকাল ১৯ জানুয়ারি ৭৮তম জন্মদিনে দেশনায়ক জিয়াউর রহমানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এ নামটি জড়িয়ে আছে এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে। একাত্তরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে মানুষের হৃদয়-মনে যেমন স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, তেমনি একাত্তরের রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং পরে দেশ পরিচালনায় দূরদর্শী ভূমিকা রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন অক্লান্ত কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠন করেন এবং এ দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। সামরিক অফিসার হয়েও গণতন্ত্রের প্রতি তার গভীর আস্থা ছিল এবং তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, জনগণই ক্ষমতার উত্স। তিনি বলতেন, সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। গণতন্ত্রই এ পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট ব্যবস্থা।
বহুদলীয় রাজনীতি চালু করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে তিনি দেশের মানুষকে সুসংগঠিত করেন। বাংলাদেশকে তিনি বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সংহতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আত্মীয়তার বন্ধনের উদ্দেশ্যে তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালান। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনে সার্ক গঠনের স্বপ্ন তিনিই দেখেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার আপ্রাণ চেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে বলিষ্ঠ ও গতিশীল ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ তিনিই দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের মান উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণের জন্য তিনি অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। জিয়াউর রহমান একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এবং এ লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যেমন স্থিতিশীলতা এনেছেন, তেমনি দেশটিকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ৭০ হাজার গ্রামকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যেই ছিল তার গ্রাম মার্চ। তিনি হেঁটে হেঁটে প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে এবং কৃষকের পর্ণকুটিরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দেশনায়ক জিয়াউর রহমান জনগণকে খাদ্য উত্পাদন, জন্মনিয়ন্ত্রণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক হাজারের উপরে খালখননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করে উত্পাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে তিনি দেশব্যাপী একটি শান্তিপূর্ণ বৈপ্লবিক উন্নয়ন কর্মসূচি দেশবাসীর সামনে দেন, যার সুফল মানুষ পেয়েছে। তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম একটি দিক হচ্ছে স্বনির্ভরতা অর্জন। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমাদের সম্পদ সীমিত। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেশটিকে গড়তে হবে।
জিয়াউর রহমান এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি সামরিক জেনারেল হিসেবে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমন আরেকটি দৃষ্টান্ত ছিল ফ্রান্সের জেনারেল দ্য গলের। বাংলাদেশের জন্য তিনি একটি মাল্টি পার্টি সিস্টেম বা বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন অত্যন্ত সত্ একজন মানুষ। তিনি অতি সরল জীবনযাপন করতেন। অতি সাধারণ কাপড়-চোপড় পরতেন। তিনি আজ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশ এক অন্য বাংলাদেশ হিসেবে রূপলাভ করত।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন