সরকারের হাল আমলের শেষ বছরে পদার্পণ করে ১১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সব সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি সঠিক পথে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির যে উজ্জ্বল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। একমাত্র আপনারাই আমাদেরকে সে সুযোগ দিতে পারেন।’
ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় লণীয়, সেদিন যারা মাইনাস টু ফর্মুলা প্রবর্তন করতে চেয়েছিল তারা এখনো সক্রিয়। মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। (সে চেষ্টা সফল হবে না) জনগণ যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত করে মতায় বসাবে।’ এক কথায়, পুনরায় তার দলকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানালেন তিনি। সংসদীয় বিরোধী দল সম্পর্কে বললেন, ‘বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মাঠে নেমেছে। নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। জামায়াত ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সাথে বিএনপির ঐক্য নতুন কিছু নয়। তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালে অবৈধ মার্শাল ল সরকার গঠন করে। তারপর যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন শুরু করে। তাদেরকে জেল থেকে মুক্ত করে। অনেককে দেশে ফিরিয়ে আনে। নাগরিকত্ব দেয়। রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও মন্ত্রী বানায়।’
‘মতায় থাকাকালে তারা কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি। তারা ঢাকার মিরপুর ও মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও সন্ত্রাস করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারচুপি করে এবং জাতির পিতার হত্যাকারী খুনি কর্নেল রশিদ ও মেজর হুদাকে সংসদ সদস্য করে আনে। সেই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করে। জনগণ সেই নির্বাচন মেনে নেয়নি।’
‘বিরোধী দলের প্রতি আমার আহ্বান, সংঘাতের পথ পরিহার করুন। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না। তাহলে জাতি আপনাদের কখনোই মা করবে না।’
আগের দিন পাকিস্তানে কারারুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলে ১০ জানুয়ারি দলীয় আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের আন্দোলন জনস্বার্থে নয়, আবার ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে আসার জন্যই তারা আন্দোলন করছে। যুদ্ধাপরাধীদের রা ও গণতন্ত্র নস্যাৎ করাই তাদের ল্য।’ স্পষ্টত ওয়ান-ইলেভেনের জুজুর ভয় প্রধানমন্ত্রীকে পেয়ে বসেছে এবং সেটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার যুক্তি হিসেবে খাড়া করে বিরোধী দলকেও মাইনাস টু ফর্মুলার উকিল-মক্কেলদের ভয় দেখিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই ওয়ান-ইলেভেন নয়, রাজনৈতিক বিবর্তনের চলমান সঙ্কট উত্তরণে জোরগলায় এ কথা বলেছেন একটা সুশীল গোষ্ঠীর তরফে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ‘সম্মতি’র ইঙ্গিত করে তুড়ি মেরে ‘খালু’ ব্যারিস্টার রফিকের মামাবাড়ির আবদারকে আগেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
ক’দিন আগে তার সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কিছু কিছু মহল আছে যাদের মতায় যাওয়ার অনেক খায়েশ। তারা জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারেন না, জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস ও দতা কোনোটাই তাদের নেই। তাই তারা অন্ধকার অলিগলি আর চোরাপথে মতায় যেতে চায়। তারাই বারবার মতায় এসে দেশে মানুষের অধিকার খর্ব করেছে। জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’
অনেকটা যেন প্রধানমন্ত্রীর এমন কটারেই জবাব দিতে ২৯ ডিসেম্বর একই দিনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলে এক আলোচনা সভায় ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দিনবদলের কথা বলে ভোট নিয়ে যারা জনগণের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে তারা প্রতারক। জনগণ জানেন এদের বিরুদ্ধে কী করতে হয়। সেদিন সরল বিশ্বাসে দিনবদল করতে আমাদের মতো ব্যক্তিদের কথায় ভোট দিয়েছিলেন তারা। জনগণ এখন আসল গণতন্ত্র চায়; প্রতারকদের গণতন্ত্র চায় না। যারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে অন্যরকম আচরণ করে, তাদের কাছে গণতন্ত্র শিখতে চায় না জাতি। এ দেশের তেল-গ্যাসসম্পদ হাতছাড়া হয়ে যেত যদি জনগণ প্রতিরোধ গড়ে না তুলত। কারা জনগণের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল তারা চিহ্নিত হয়ে আছে, তাদের সময়মতো ধরা হবে।’
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেন, ‘যাদের চৌদ্দগোষ্ঠী দুর্নীতিতে ভরা তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। আওয়ামী লীগ এখন বঙ্গবন্ধু, ভাসানী আদর্শের দল নয়; এটি বড়লোকদের দল। দলের আদর্শ এমনভাবে বদলে যাওয়ায় আমরা আওয়ামী লীগ ছেড়েছি। তিনি বলেন, বিশ্বজিতের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড দেখার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। জনগণ গণতন্ত্রের মালিক, তারা সময়মতো সিদ্ধান্ত নেবে কী করতে হবে।’
ওই দিন সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তির দাবি ও দলের যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদে রাজধানীতে স্বেচ্ছাসেবক দলের বিােভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘এই সরকার মনে করেছে বিরোধীদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে মতায় টিকে থাকা যাবে। এ জন্য তারা বিরোধী নেতাদের কণ্ঠ রোধ করতে নির্যাতন, গুম, খুনের পথ বেছে নিয়েছে। এম ইলিয়াস আলীসহ বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে। অত্যাচার ও গুমের জন্য গণতন্ত্র আজ রক্তাক্ত। রাজনৈতিক দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করে। আওয়ামী লীগও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। এই সরকার বিএনপির ২৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন ও হয়রানি করছে। আমরা এক বিচিত্র অদ্ভুত দেশে বাস করছি। যেখানে মির্জা ফখরুলের মতো নেতাকে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলায় গ্রেফতার করে রাখা হয়। মাহমুদুর রহমান ও রিজভীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়, বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু বিকাশের মতো অপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয়।’
দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে মুক্তিদান প্রসঙ্গে সরকারের ব্যাখ্যাÑ সব মামলায় জামিন পাওয়ার পরও ‘ঝামেলার আশঙ্কায়’ শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস গত তিন বছর কারাগারে অবস্থান করছিল। এর জন্য সে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট বা হাজতি পরোয়ানা (কারাগার থেকে মামলায় হাজিরা দেয়ার অনুমতি) নামে একটি আইনি সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। বিকাশ গত ১৫ বছর বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিল। এই সময়ে কারাগারের বাইরে থাকা বড় সন্ত্রাসীদের অনেকেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। এ অবস্থায় ২০০৯ সালে সব মামলায় জামিন পেলেও বিকাশ কারাগার থেকে বের হয়নি। সর্বশেষ তেজগাঁও থানার একটি মামলায় হাজতি পরোয়ানা প্রত্যাহার হলে ১৪ ডিসেম্বর সে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। গত বছরও একবার সে এই মামলায় হাজতি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে কারাগার ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু পরে পিছিয়ে যায় এবং নতুন হাজতি পরোয়ানা নিয়ে কারাগারে থেকে যায়।
কিন্তু কারা প্রশাসন সূত্রেই প্রকাশ, বড় ধরনের অপরাধীদের কারাগার থেকে ছাড়ার আগে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে জানানোর নির্দেশনা রয়েছে। কারা প্রশাসন সেভাবেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদেেপর কথা লিখে জানিয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের ইচ্ছামতে কঠোর গোপনীয়তায় বিকাশকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বিকাশের মতো একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে মুক্তি দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশকে অবহিত করার রীতি থাকলেও এ েেত্র তা মানা হয়নি। গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন ওই দিনই বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নলেজে নেই।’
ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মনিরুল ইসলামও বলেছেন, বিকাশের মুক্তি কিংবা তার বর্তমান অবস্থান কিছুই মহানগর পুলিশের জানা নেই।
১৯৯৭ সালে মিরপুরের পাইকপাড়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। বিকাশের বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যান্য মামলাসহ ছাত্রলীগ নেতা জরিপ হত্যা, আগারগাঁওয়ে জোড়া খুন এবং তেজগাঁওয়ে ব্যবসায়ী তাজু হত্যাসহ পাঁচটি হত্যার গুরুতর অভিযোগ ছিল। তার সাথে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংযোগ রয়েছে বলেও কানাঘুষা আছে।
বিকাশের বিরুদ্ধে যে ১২টি মামলা বহাল ছিল, তার মধ্যে একটি খুনের মামলাসহ সাতটিতে সে অব্যাহতি ও খালাস পায়। বাকি পাঁচটি বিচারাধীন মামলার মধ্যে চারটি হত্যার। বিকাশের বড় ভাই প্রকাশও ঢাকার শীর্ষসন্ত্রাসী। সে ১০ বছর ধরে ভারতে পালিয়ে আছে বলে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে।
নিয়মিতভাবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের কারামুক্তির ব্যবস্থা বর্তমান সরকারের ভেতরে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কমিশন-বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে বলে জনশ্র“তি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, শেখ হাসিনা সরকারের হাল আমলে মোট সাত হাজার ১০১টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত ‘জাতীয় কমিটি’। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির েেত্র সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) সুপারিশ করতে অপারগতা জানিয়েছেন। খুনি, সন্ত্রাসী, ধর্ষকসহ প্রায় এক লাখ আসামি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছে বা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এই কমিটির কাজ পরিচালনা করেন।
এ সম্পর্কে সরকারপরেই কোনো কোনো আইনজীবী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেনÑ রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার নয়, সরকারের উচিত ছিল এ ধরনের মামলা করার পথ বন্ধ করা। আর রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় এত মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় লাভে উৎসাহী হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের জন্য আলাদা একটি স্বাধীন সংস্থা থাকে। আর আমাদের দেশে এই কমিটির প্রধান আইন প্রতিমন্ত্রী নিজেই। এটা ন্যায়নীতিসম্মত নয়।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, সরকারের সুপারিশ করা যেকোনো মামলা প্রত্যাহারের জন্য রাষ্ট্রপরে আইনজীবী আদালতে আবেদন করতে পারেন। তবে আদালতে করা নালিশি মামলা বা ব্যক্তির করা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার এখতিয়ার সরকারের নেই। অথচ সর্বশেষ যে দশটি খুন ও ধর্ষণের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধে অভিযুক্ত দাগি আসামিদের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে ‘ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৪৯৪ ধারার মতাবলে মামলা দায়ের বা আসামির বিরুদ্ধে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত’ চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুর রউফ হত্যা। এ মামলার আসামিরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান এবং তার ভাই পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান ও জাহিদুর রহমান খান। তাদের বাবা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতাউর রহমান খানের নামও ছিল আসামির তালিকায়। শরীয়তপুরে রাজনৈতিক বিবেচনায় দু’টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি। এর একটি ধর্ষণের মামলা। অপরটি হচ্ছে শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে করা মামলা।
ফলে স্বভাবতই গুজব রটছে, ঘৃণ্য অপরাধীদের ‘রাজনৈতিক কর্মী’র লেবাস পরিয়ে মোটা সেলামি নিয়ে কিংবা অপরাধবৃত্তের যোগসাজশে গুম-খুন, দখলবাণিজ্য না হয় নিদেনপে হুমকি-ধমকির অপকর্ম হাসিলের জন্য মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ফলে এক দিকে যেমন র্যাব তৎপরতার বদৌলতে ২০০৬ সাল থেকেই জিহাদি জঙ্গি হামলা বন্ধ হয়ে গেছে, অন্য দিকে তেমনি ২০০৯ সাল থেকে বেড়েই চলেছে ‘রাজনৈতিক’ হত্যাকাণ্ড আর সামাজিক সন্ত্রাস, দুর্বৃত্তের উৎপাত। অপরাধসংক্রান্ত বিগত দুই বছরের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও এসংক্রান্ত মৃত্যু, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতা, ধর্ষণের ঘটনা, বিএসএফ কর্তৃক হত্যা, জেল হেফাজতে মৃত্যু, সাংবাদিক নির্যাতন এবং গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্য দিকে ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে কমেছে ডাকাতি, এসিড সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরো’ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত বছর (২৪ ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত) সারা দেশে এক হাজার ৮৫৫ জন খুন হন; এর আগের বছর যা ছিল দুই হাজার ১০ জন। গত বছর ৫৩৮টি ডাকাতির ঘটনায় মারা যান ১৩ জন। এর আগের বছর ৭৭০টি ডাকাতির ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ৫৩ জন। ২০১২ সালে চাঁদাবাজির ঘটনা ছিল ২১৮টি, এর পূর্ববর্তী বছরে ছিল ২৫৫টি। অপহরণের ঘটনা ২০১২ সালে ছিল ৬৯৯টি। অপহরণের ঘটনায় গত বছর মারা যান ৪৪ জন। এর আগের বছর এক হাজার ৫১টি অপহরণের ঘটনায় মারা যান ৪২ জন। গত বছর এক হাজার ৭৯টি সন্ত্রাসী ঘটনায় মারা যান ৫৩০ জন। ২০১১ সালে ৯২৩টি সন্ত্রাসী ঘটনায় মারা যান ৪৪৩ জন।
অন্য দিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে (নভেম্বর ২০১২ পর্যন্ত) জানা যায়, রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছর ১৫২ জন মারা যান। ২০১১ সালে মারা যান ১৩৫ জন। ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে গত বছর ৩৪ জন বাংলাদেশী নিহত হন। ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩১ জন। এ বছর জেল হেফাজতে মৃত্যু হয় ৫৮ জনের; এর আগের বছর যা ছিল ৪৬ জন। এ বছর (নভেম্বর পর্যন্ত) গুমের ঘটনা ঘটে ২৪টি। ২০১১ সালে ঘটেছিল ৩০টি। ২০১২ সালে ৬৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ৫১ জন, নির্যাতনে ছয়জন, গুলিতে আটজন ও পিটিয়ে দু’জনকে হত্যা করা হয়। ২০১১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৮৪টি, ২০১২ সালে পাঁচজন সাংবাদিক নিহত হন। বিভিন্ন ঘটনায় আহন হন ১৫৬ জন, হুমকির সম্মুখীন হন ৬১ জন এবং লাঞ্ছিত হন ৪৯ জন সাংবাদিক। ২০১১ সালে সাংবাদিকদের ওপর ২০৬টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১২ সালে যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটে ৭৭১টি; ২০১১ সালে ঘটেছিল ৫১৬টি। ধর্ষণের ঘটনা ২০১২ সালে ঘটে ৭৬০টি; অন্য দিকে ২০১১ সালে ঘটেছিল ৭১১টি। গণপিটুনিতে গত বছর মারা যায় ১২০ জন। ২০১১ সালে মারা যায় ১৬১ জন। ২০১২ সালে এসিডসংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৭টি, এর আগের বছর ছিল ১০১টি।
সর্বশেষ খবর : সাংবাদিক টিপু সুলতানের বহুল আলোচিত নির্যাতন মামলাটিও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মামলার প্রধান আসামি ফেনীর গডফাদার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা জয়নাল হাজারী দীর্ঘ আট বছর ভারতে পালিয়ে থেকে বর্তমান সরকার মতায় আসার পর দেশে ফেরেন। জানা গেছে, ২০০৯ সালে ফেনী জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক হিসেবে প্রত্যাহারের আবেদন করেন তিনি।
প্রতিবাদে ফেনী প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক বখতেয়ার ইসলাম জানান, ফেনীর সাংবাদিকেরা আন্দোলনে নামবেন। উল্লেখ্য, সৎ সাহসের জন্য নির্যাতিত সাংবাদিক হিসেবে ২০০২ সালে টিপু সুলতান ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। এসবের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হবে, জনসমাজের সর্বস্তরে চরম নিরাপত্তাহীনতা।
নতুন বছরে এসে একজন সাহসী সাংবাদিক ও সমাজনেতা নির্মল সেনকে আমরা হারিয়েছি। কিশোর বয়সে ১৯৪২ সালের ব্রিটিশবিরোধী কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন থেকে শুরু করে হৃদরোগে পাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায়ও সত্তর বছর ধরে বাক্যালাপে কিংবা লেখনীর মাধ্যমে যার প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার ছিল, সেই নির্মল সেন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিরে সময় অনেক ঝাঁঝালো কলাম লিখেছিলেন। নির্মল সেনের সেই সময়কার বক্তব্য উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ফের সব কিছু ওলটপালট করে দিয়েছেন। আর তার ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডারেরা সব লুটেপুটে খাচ্ছে।’
এক-এগারোর বার্ষিকীতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে সংসদীয় বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করেছেন, তার জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেছেন : ‘প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের যেকোনো কর্মকাণ্ড দেখলেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের কথা বলেন। তীব্র শীতে দেশের মানুষ কাবু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কখন না জানি বলে বসেন, এই শীতও বিএনপি এনেছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করার জন্য। এক-এগারো সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। আজকের প্রধানমন্ত্রী এক-এগারোর পর বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন সাহেবদের সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি (শেখ হাসিনা) উপস্থিত ছিলেন। ফখরুদ্দীনকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল লন্ডনে এক সাাৎকারে বলেছিলেন, বর্তমান মহাজোটের সরকার আঁতাত ও সমঝোতার সরকার। তাই আজ প্রশ্ন ওঠে, তারা (আওয়ামী লীগ) কি সত্যিকারভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় এসেছিল।’
সর্বশেষ ফাঁস হওয়া উইকিলিকসের তথ্যের আলোকে বিএনপির সমন্বয়ক আরো বলেন : ‘দেশ-বিদেশের অনেক কূটনীতিক সেই সময়ে ষড়যন্ত্র করেছে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমরা চাই না আরেকটি এক-এগারোর সৃষ্টি হোক। সে জন্য ওই দিনটির স্মরণে ঘৃণা প্রকাশের জন্য আমরা আজ কালো পতাকা মিছিল করছি।’
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন