ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসীন হবার পর বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে ভয়াবহ বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা দেশকে যেন এক আদিম সমাজে স্থানান্তর করেছে। এখানে আইনের শাসন নেই। আওয়ামী দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব লীগ এসব ব্যানারে এখন যা খুশি তা করতে পারছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি দেশে সকল কিছুই ঘটছে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে। আওয়ামী লীগ যে করে, আদালতে তার মৃত্যুদন্ড হলেও সদাশয় রাষ্ট্রপতি, আহা, জিল্লুর রহমান তার সাজা মওকুফ করে দেন। খুনের আসামীর সাজা মওকুফ, ধর্ষণের আসামীর সাজা মওকুফ, আওয়ামী লীগের পরিচয় থাকলেই হলো। তিনি খুন, ধর্ষণ, ব্যাংক লুট যাই করেন না কেন তার জন্য সাত খুন মাফ। বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে মোট ২৫ জন খুনী ও দাগী অপরাধীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা হয়েছে। মহাপ্রাণ জিল্লুর রহমান তার সাড়ে তিন বছরে ২২ জনের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন অবস্থায় কোনো মামলা দায়ের করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন তো করা যায়।
সে প্রশ্ন করেছিলেন, লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা শাহজাহানের স্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি যদি তার স্বামীর খুনীকে মৃত্যুদন্ড মওকুফ করতে পারেন, তাহলে কোন অধিকারে তিনি তার স্ত্রীকে যারা বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হত্যা করেছিল, তাদের বিচার প্রক্রিয়া ফ্যালফ্যালে চোখে দেখছেন? তার তো উচিত তার স্ত্রীর অভিযুক্ত খুনীদের নিঃশর্তে শাস্তি মওকুফ করে দেয়া। এটি অত্যন্ত সঙ্গত। এ বক্তব্য সম্ভবত এদেশের ১৫ কোটি মানুষের। বস্তুতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পুতুল নাচের সুতো ধরে আছেন। রাষ্ট্রপতিও সেই সূত্রের বাইরে নয়। ফলে পুতুল নাচের খেলা এই সরকারের আমলে চলছেই। আমাদের আফসোস হলো এই যে, কোথায়ও কি কেউ থাকবে না, যে ঘুরে দাঁড়াবে কিংবা রুখে দাঁড়াবে? বলবে এটা সঙ্গত নয়। এটা হবে না। কিন্তু সম্ভবত কোথায়ও কেউ নেই।
না, আমি বাইরের কাউকে আহবান করছি না। আমি সরকারের ভেতরে সম্মানের আসনে যারা অধিষ্ঠিত আছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাষ্ট্রপতি এর অন্যতম। আওয়ামী লীগের হলেও তিনি যখন রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেছেন, তখন সকলের কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা দরকার ছিল। আমরা কোথায়ও দাঁড়াতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে প্রধান বিচারপতি ১০ লাখ টাকা অনুদান নেন, তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অবলুপ্ত হয়। এবং কি আশ্চর্য, তিনি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে এমন এক রায় দিলেন যা তার পদমর্যাদায় প্রশ্ন তুলে বসল। আরও ইতর কাজ তিনি করলেন, অবসর নেয়ার পর সেই বিচারের রায় লিখে। এ নিয়ে হাস্যকর সব খবর বেরিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি প্রথমে একটি রায় তৈরি করেছিলেন। সেটি অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ছিঃ ছিঃ বলে ধুয়া দিলে কিছু অতিরিক্ত বলা হবে না। সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তার লিখিত রায় পরিবর্তন করেছেন। এদিকে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা বলেছেন, তিনি যেহেতু আর বিচারপতি নেই, সে কারণে এই রায় লেখার তার কোনো অধিকার নেই। সংবিধান তা অনুমোদন করে না। কিন্তু নির্লজ্জ অনুদান-খেকো খায়রুল হক এসব পরোয়া করেননি। বেহায়ার মতো কাজ করেই গেছেন। আর সরকার যা চেয়েছে, শেষ পর্যন্ত তিনি তাই করেছেন।
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাধীন, অনুদান-খেকো প্রধান বিচারপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ্ঞাধীন, তাহলে আমরা কোথায় যাই? সাধারণ নাগরিকদের তবে আর কি আশ্রয় থাকে। আশ্রয়ের কোনো স্থল নেই। এ রকম রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকরা কি করবে? কার কাছে আশ্রয় বা বিচার প্রার্থনা করবে? না। কোথায়ও কেউ নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এখন আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর কাছে জিম্মি।
কিন্তু এই অবস্থা কি চিরস্থায়ী হয়? হতে পারে? মানব সভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস বলে, হয় না। শেখ হাসিনা ইতিহাস-অচেতন। এখন তার শিক্ষা-দীক্ষা বিষয়েও সমাজের ভেতরে হাজারো প্রশ্ন। তার পিএইচডি-ফিএইচডি নিয়ে নিতান্ত নিকৃষ্ট চামচা ছাড়া কেউ ভাবে না। বর্তমান শাসনকালে তাকে খুব একটা পিএইচডি শিকারি মনে হয়নি। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসনকালে তিনি বহুত উচ্চ শিক্ষিত এবং তিনি ডজন ডজন পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী, এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি করেননি হেন কোনো নিম্নমানের কাজ নেই। তাতে, অভিযোগ আছে যে, রাষ্ট্রের কোটি কোটি ডলার ড্রেনে গেছে।
মানুষ তাহলে দাঁড়াবে কোথায়? সেটাও কিন্তু সমাজের ভেতরে ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। খুব সাধারণ মানুষও আত্মরক্ষার্থে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে। একদিকে তারা আওয়ামী ডাকাতদের বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে পাহারা বসাচ্ছে, অপরদিকে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেরাই নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। গ্রামের লোকেরা লাঠি-সোটা, সড়কি- বল্লম নিয়ে আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় রাতভর পাহারা দিচ্ছে। এটা এখনও গ্রামে গ্রামে বিস্তৃত। কিন্তু শিগগিরই তা শহরে, নগরে, পাড়া, মহল্লায় বিস্তৃত হবে।
সরকার এই যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার পথও তারা বন্ধ করে দিতে চাইছে। এই সমাজে কেবলই বিবেকহীন মানুষের বসতি নয়। বিবেকবান মানুষও এ সমাজে আছে। কিন্তু তাদের কি কথা বলার শক্তি ও সাহস আছে? অনেকেরই আছে। কখনও কখনও তারা তা বলেও ফেলছেন। কিন্তু বিবেকের দায়ে কথা বলাও এ সরকারের শাসনামলে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পত্রিকায় লিখে কিংবা টেলিভিশনের টক শোতে কেউ যদি বিবেকতাড়িত হয়ে সত্য কথা বলে ফেলেন, তাহলে তার আর নিস্তার নেই। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সমস্বরে তার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলে শেয়ালের মতো রা রা করে ওঠেন। এদিকে আবার নতুন গজিয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতা। এরা নিজ রাজনৈতিক এলাকায় কোনোদিন কল্কি পায়নি। শেখ হাসিনার কচিকাঁচার মেলায় তারা এখন বড় বড় নেতা হয়ে বসেছেন। যার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই অবলীলায় বলে ফেলছেন। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা ভব্যতার কোনো বালাই থাকছে না। অনেক সময় থাকছে না সীমানা জ্ঞানও। অনেক তাদের কথাবার্তা শুনে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ও মুখ ব্যাদান করে স্পষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় প্রধানমন্ত্রী এসব খিস্তি-খেউড় পছন্দ করেন। তা না হলে বহু আগেই তিনি এদের ধমক দিয়ে খামোশ করে দিতেন।
এখন বিবেককে ধমক দিয়ে, ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সেটা শুরু হয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়ায় তাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করে নোবেল কমিটি। এই নোবেল শান্তি পুরস্কার তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। তার জন্য তিনি নাকি দেশী-বিদেশী লবিস্টও নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাকে শান্তি পুরস্কার না দিয়ে ড. ইউনূসকে কেন নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো সে জন্য তার ক্ষোভের অন্ত নেই। নোবেল কমিটির ওপরকার সব ক্ষোভ তিনি ঝাড়লেন ড. ইউনূসের ওপর। তাকে সুদখোর রক্তচোষা বলতেও তিনি কুণ্ঠা বোধ করলেন না। আর তিনি যখন ড. উইনূসের বিরুদ্ধে নিজে আক্রমণ করে বসলেন, তখন তার পারিষদবর্গ ও চামচারা শতমুখে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলতে শুরু করল। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি প্রধানমন্ত্রী, ড. ইউনূসকে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছেন। এখনও তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি অব্যাহত আছে। সরকারের চুরি-বাটপারি ও সকল ব্যর্থতার দায় চাপানো হচ্ছে ড. ইউনূসের ঘাড়ে। এমনকি সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতির দায়ে যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তার দায়ও চাপানো হলো ড. ইউনূসের কাঁধেই। প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী, চামচা নেতা থেকে হাইব্রিড নেতারা একযোগে এখনও বলতে কসুর করছেন না যে, বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পেছনে ড. ইউনূসের হাত রয়েছে।
এরপর মাহমুদুর রহমান। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গ্যাস সংক্রান্ত সরকারের দুর্নীতির খবর ছেপে বিরাগভাজন হন। অথচ সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে তিনি সঠিক কাজটিই করেছিলেন। সংবাদপত্রের কাজই তো জনগণের সামনে সত্য উন্মোচিত করা। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ঐ দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পরিবার সদস্য জড়িত ছিল। সরকারের উচিত, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কেউ যে জড়িত ছিল না, তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তুলে ধরা। তা না করে সরকার মাহমুদুর রহমানকে এক বছর জেলের ভাত খাইয়ে এনেছে। এরপর আবার তিনি হেনস্থা হচ্ছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজামুল হকের স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করে। সে সংলাপে বিচারপতির নিরপেক্ষতা একবারে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। নিজামুল হকও ধরা পড়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমান মাসাধিককাল ধরে নিজ অফিসে অবরুদ্ধ অবস্থায় কালাতিপাত করছেন। বিচারপতি যে বিচারকের আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন, সেটি মুখ্য হলো না। মুখ্য হলো, মাহমুদুর রহমান কেন তা প্রকাশ করলেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর যে দুই সাংবাদিক আড়ি পেতে প্রকাশ করেছিলেন, তারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন। কেউ প্রশ্ন করেনি, তারা কেন আড়ি পেতেছিল। সে কেলেঙ্কারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশে মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বিপদে আছেন স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। হাইব্রিড আওয়ামী নেতারা তাকে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী বলতে ছাড়েনি। এমনকি এক আওয়ামী নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচার পর্যন্ত দাবি করেছেন। শেখ হাসিনা মনে হয় এসব উপভোগই করেন। তা না হলে ঐ হাইব্রিড নেতাকে তিনি শাসন করতেন। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি।
সত্য বলে সর্বশেষ বিপদে পড়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক, শেখ মুজিব আমলে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জনাব এবিএম মূসা। মূসা ভাই একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ। আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতা হানিফ তাকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে একইভাবে গালাগাল করেছেন। একইভাবে তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ সম্মানীয় আরও অনেকেই।
অর্থাৎ এদেশে ধারাবাহিকভাবে বিবেক লাঞ্ছিত হচ্ছে। এই লাঞ্ছনা যে এক সময় বর্তমান শাসকদেরও কুড়ে কুড়ে খাবে, সেটা উপলব্ধি করার মতো কান্ডজ্ঞানও সরকার হারিয়ে ফেলেছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন