চার বছরে ১৭ সাংবাদিক খুন, ৯০০ হামলা
বর্তমান সরকারের আমলে গত চার বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানিÑ এমনকি হত্যার ঘটনা বেড়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। হামলার শিকার হলেন রেকর্ডসংখ্যক ৯০০ জন। গ্রেফতার, নির্যাতিত, হুমকির মুখোমুখি ও লাঞ্ছিত হয়েছেন আরো অনেকে। কারাবন্দী করে নির্যাতন চালানো হয়েছে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের মতো সম্মানিত ব্যক্তিকে, যা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যানগুলো উঠে এসেছে। সোমবারের নয়া দিগন্তে এ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। একই সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারের বর্তমান শাসনকালে দায়িত্ব পালনরত ৬২ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা, আটজনকে গ্রেফতার, তিনজনকে অপহরণ এবং ৬৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, গত চার বছরে বাংলাদেশে যতজন সাংবাদিক শিকার হয়েছেন হত্যা-নির্যাতনের, অতীতে কোনো সরকারের সময় এমনটি ঘটেনি। আরো উদ্বেগের কারণ হলোÑ দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো প্রতিবাদ ওঠার পরও এখানে সাংবাদিক নিপীড়ন কমেনি। অথচ এই সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসে ‘সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা’র আশ্বাস দিয়েছিল। ২০০৯ থেকে প্রতি বছরই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং ২০১২ সালে এটা বেড়েছে।
এ দেশে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতের সর্বাধিক আলোচিত সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। এমন ভয়াবহ ও বীভৎস হত্যার ঘটনা খুব কম। গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে সংঘটিত এই হত্যাযজ্ঞের রহস্য উদঘাটন দূরের কথা, পুলিশ মূল সন্দেহভাজন আসামিকেও ছেড়ে দিয়েছে।
গত কয়েক বছরে দেশে প্রায় সব ধরনের সন্ত্রাস ও অপরাধ বেড়েছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ ও আতঙ্ক। এই সময়ে সাংবাদিক ও শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মানুষও নির্যাতন-নিগ্রহ, হামলা-মামলা, গুম-গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। সমাজে সন্ত্রাসী ও অপরাধী সব সময়েই ছিল, আছে। তবে রাষ্ট্রনিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দমন ও নিয়ন্ত্রণে যথাসাধ্য তৎপর থাকে। এতে দেশের নাগরিকেরা অনেকটা স্বস্তি ও নিরাপত্তা বোধ করেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, সমর্থন ও অনুমোদন বেপরোয়া সন্ত্রাসের বড় কারণ। সর্বোপরি অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সরকারের স্বেচ্ছাচার ও গণতন্ত্রের বিপন্নতা নির্দেশ করছে।
আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দিকের একজন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার কিংবা সরকারবিহীন সংবাদপত্র, এই দুয়ের মাঝে একটি বেছে নিতে বলা হয়, আমি শেষেরটাই পছন্দ করব।’ গণতন্ত্রের চর্চা, প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কত বড়, সেটাই এই বক্তব্যে পরিস্ফুট। সেই সাংবাদিকেরাই আজ আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত বিপন্ন। কায়দা-কৌশলে সংবাদপত্রসহ মিডিয়ার মাথা নত ও কণ্ঠ ক্ষীণ করার অপপ্রয়াস চলছে। এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা সচেতন দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এখনকার ক্ষমতাসীন দলটির অতীত শাসনামলে ১৯৭৫ সালে চারটি দৈনিক পত্রিকা বাদে আর সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এই ক’টি পত্রিকা পরিণত হয়েছিল একদলীয় সরকারের প্রচারযন্ত্রে। এ সব কিছুই গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখন দেখা যাচ্ছে, নানান উপায়ে ও অজুহাতে মিডিয়ার কণ্ঠরোধের প্রয়াস। তা ছাড়া সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের চরিত্রহননে অপপ্রচার চলছে ক্ষমতাসীন দল ও প্রভাবশালীদের উদ্যোগে। কোনো কোনো সময় মন্ত্রীদের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিও এতে অংশ নিয়েছেন। আগে সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকে কিছুটা হলেও সমীহ করত। এখন বিশেষ করে রাজনৈতিক মদদে তারা প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের ‘দেখে নেয়া’র ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছে এবং ‘পরিণতি ভালো না হওয়া’র হুমকি দিচ্ছে।
এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় অন্যায়-অসঙ্গতি, স্বেচ্ছাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জনসম্পদের অপচয়, মানবাধিকার দলনের বিরুদ্ধে এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরাই সর্বাধিক সোচ্চার। এ প্রেক্ষাপটে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ও গণতন্ত্রের পরিচর্যার লক্ষ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিক সমাজের নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তা জরুরি। আশা করি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ জনগণের যাবতীয় মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন