রবিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩

কবে ঘটবে সরকারের বোধোদয়?


আওয়ামী লীগ। এ দলের নেতানেত্রীদের বারবার উচ্চারণ করতে দেখা যায় : ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল’। কিন্তু আওয়ামী লীগের আচার-আচরণে বারবার আমরা দেখছি জনগণকেই এ দলটি সবচেয়ে বেশি ভয় করে। এই জনভীতি থেকেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করেন। এর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে কায়েম করেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা। সংসদীয় ব্যবস্থার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা। এই সংশোধনী পাসের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থেকে হন রাষ্ট্রপতি। জনমতকে উপেক্ষা করে মাত্র ১১ মিনিটে এই সংশোধনী বিলটি পাস করে দল গঠন করা, রাজনীতি করা, মত প্রকাশের সব অধিকারকেই কার্যত হরণ করা হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আওযামী লীগ জনগণের দল হলে কী করে এ কাজ করতে পারে?

দলটি আবার যখন ক্ষমতায়, তখন তাদের যেন সেই আগের জনভীতি রোগে পেয়ে বসেছে। ফলে আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কী করে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে রাখা যায় চিরদিনের জন্য এবং কী করে বিরোধী দল-মত নিঃশেষ করে দেয়া যায়, সে চেষ্টায়ই  পাগলপারা দলের নেতানেত্রীরা। এরই অংশ হিসেবে দলটি আদালতের রায়ের অজুহাতে সংবিধান সংশোধন করেছে ইচ্ছেমতো। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা না করেই আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে। জনভীতির কারণে গণতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা গণভোটের সুযোগ সংবিধান থেকে রহিত করেছে। সংবিধানের বিপজ্জনক নানা অনুচ্ছেদ সংযোজন করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র কিংবা সংবিধানের কোনো কোনো বিধান সম্পর্কে নাগরিকের মনে অনাস্থা সৃষ্টি হলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বলে গণ্য হবে বলে সংবিধানে বিধান রাখা হয়েছে। সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। সংবিধান এক দিকে নাগরিকের বাকস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে, অন্য দিকে এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কার্যত সে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা ৭(ক) অনুচ্ছেদকে বিপজ্জনক ও মৌলিক অধিকারপরিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে তা আপনা-আপনি বাতিলযোগ্য বলে মনে করছেন।
জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিধিবিধান অনুসরণ করে নির্বাচিত দল ক্ষমতায় গিয়ে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সংবিধান সংশোধন করবেÑ এটাই সংসদীয় রীতিনীতি। কিন্তু এর তোয়াক্কা না করে বর্তমান সরকার সংশোধিত সংবিধানে ৫০টির মতো অনুচ্ছেদকে অমরত্ব দিয়েছে। সংশোধিত সংবিধানের বিধান মতে, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম শুধু নয়, এ দু’টি বিষয় ছাড়াও কোনোভাবেই সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা বাতিল করা যাবে না সংবিধানের অর্ধশত অনুচ্ছেদ। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এসব অনুচ্ছেদকে ‘অমরত্ব’ দেয়া হয়েছে।
যা-ই হোক, তত্ত্বাবধায় সরকারব্যবস্থা কায়েমে আওয়ামী লীগের ভয়াবহ জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন দলই অতীতে দেশবাসী দেখেছে। আজ সেই আদালতের একটি রায়কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক। তাহলে কি আওয়ামী লীগ নেতারা এর আগে জানতেন না যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক? অবস্থা দেখে মনে হয়, নতুন করে এসব নেতাদের আক্কেল গজিয়েছে। আর সে আক্কেলের জোরে এখন এরা বুঝতে পারছেন, তত্ত্বাবধায়ক  সরকারব্যবস্থা ‘অগণতান্ত্রিক’। আর বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক। আসলে এসবের নিহিতার্থ হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে করে ক্ষমতায় টিকে থাকার পাঁয়তারা। এ সরকারের নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া  সাধারণ মানুষের কাছেও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। তা ধরা পড়ছে প্রথমত, সরকারের বিরোধী দল-মত দমন-পীড়ন দিয়ে। দ্বিতীয়ত, সরকারের সবখানে দলীয়করণের তীব্রতার মধ্য দিয়ে বিশেষ করে প্রশাসনে দলীয়করণ এবং দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন আয়োজনের অনড় অবস্থানের মাধ্যমে। এসব দেখে মনে হয়, সরকার কিছুতেই যেন জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। সরকারের যাবতীয় আস্থা কূটকৌশলের ওপর। সব কিছু দেখেই হয়তো সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আয়োজিত এক গোলটেবিলে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের আচরণের মধ্যে গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই। বর্তমান সরকার দেশে অঘোষিত বাকশাল কায়েম করে রেখেছে। বরং আজকের বাকশাল অতীতের বাকশালের চেয়েও ভয়াবহ। বাস্তবে দেশে সংবাদপত্র ও জনগণের বাকস্বাধীনতা নেই।
গত ১৫ জানুয়ারির ইত্তেফাকের শীর্ষ শিরোনাম ছিল : ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে সাজানো হচ্ছে প্রশাসন’। ২৪ জানুয়ারি দৈনিক কালের কণ্ঠের শীর্ষ শিরোনাম ছিল : ‘নির্বাচনকালীন জেলা প্রশাসক : দুই স্তর প্রস্তুত, তৃতীয় বিকল্পও আসছে’। পরদিন ২৫ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশের শীর্ষ শিরোনাম ছিল : ‘পুলিশ নিয়োগে জেলাকরণের রেকর্ড, ৩২ হাজারের মধ্যে গোপালগঞ্জের ৮ হাজার, কিশোরগঞ্জের ৭ হাজার’। অন্যান্য পত্রিকায়ও এসব বিষয়ে এ ধরনের উদ্বেগজনক খবর প্রকাশ পাচ্ছে। খবরগুলো পড়লে আঁচ করতে অসুবিধা হয় না, বর্তমান সরকার দলীয় সরকারের অধীনে কী ধরনের নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগিয়ে যেতে পাচ্ছে। এসব আলামত এ সরকার শুরু থেকেই নানাভাবে প্রদর্শন করে আসছে। ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তো বটেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারেরও কোনো কোনো দল এবং সেই সাথে দেশের সুশীলসমাজও বলে আসছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মতো পরিবেশ  এ দেশে সৃষ্টি হয়নি। কারণ, দেশে চলছে চরম অসহিষ্ণু রাজনীতির চর্চা। সরকার নানা অজুহাতে বিরোধী মতের যাকে যেখানে পাচ্ছে, সেখানেই ধরছে আর কারাগারে পাঠাচ্ছে। মামলা-হামলা চলছে সমানে। এসব ঘটছে দেশবাসীর চোখের সামনে। তাই এসব অস্বীকার করার অবকাশ নেই। এসব কী প্রতিক্রিয়ায় কতটা তীব্রতা নিয়ে ঘটছে, দেশবাসী তা ভালো করেই জানেন। সে জন্যই  হয়তো জনমত ও গণভোটে আস্থা নেই আওয়ামী লীগের।
কালের কণ্ঠের  উল্লিখিত শীর্ষ খবরটিতে বলা হয়েছেÑ ‘নির্বাচনের সময় জেলা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক বা ডিসিদের তালিকা চূড়ান্ত করেছে সরকার। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্টদের নিয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। একই সাথে কোনো কারণে এই তালিকা বাস্তবায়ন না হলে যাতে পছন্দের ব্যক্তিরাই ডিসি হতে পারেন, সে জন্য আগে থেকেই পদোন্নতি দিয়ে দ্বিতীয় স্তরে ‘যোগ্য’ করে রাখা হয়েছে আরো কমপক্ষে ৫০ জনকে। এতেও যদিও কাজ না হয়, সে ক্ষেত্রেÑ সরকারের সমর্থক কর্মকর্তাদের আরেক দফা পদোন্নতি দিয়ে তৃতীয় স্তরটিও প্রস্তুত রাখা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। ডিসিরা নির্বাচনের সময় জেলা রিটার্নিং অফিসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যেকোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিল করার ক্ষমতা ডিসির হাতে ন্যস্ত থাকে। সেনাসহ সব বাহিনী ডিসির নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে পুলিশবাহিনী জেলায় স্বাধীনভাবে কাজ করলেও নির্বাচনের সময় তারা ডিসির কর্তৃত্ব মেনে চলে। ডিসিরা নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করেন। এসব কারণে সব সরকার তাদের নিজস্ব ছক অনুযায়ী নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাজিয়ে থাকে।’
সব কিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সবচেয়ে তৎপর আরো জানা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি ডিসি ফিটলিস্টের মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষায় নবম থেকে ত্রয়োদশ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের ৩১৪ জন উপসচিবকে ডাকা হয়েছিল। তাদের মধ্যে খসড়া তালিকায় স্থান পেয়েছেন ১০০ জন। প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই এ তালিকার অনুমোদন দেবেন। এর পরপরই নতুন তালিকা থেকে ১০ জনকে ডিসি হিসেবে অনুমোদন দেয়া হবে। অবশিষ্টদের রাখা হবে স্ট্যান্ডবাই। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি নতুন সরকার (তত্ত্বাবধায়ক) আসে, তাহলে রাজনৈতিক চাপে বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেয়া ডিসিদের প্রত্যাহার করা হতে পারে!
তখন প্রত্যাহার করা হলেও এই সরকারের তালিকার অবশিষ্টদের নিয়োগ দিতে হবে। নতুন সরকার যদি পুরো তালিকা বাদ দিয়ে নতুন করে তালিকা তৈরি করে, তাহলেও যেন এ সরকার-সমর্থক কর্মকর্তারা ফিটলিস্টে জায়গা করে নিতে পারেন, সে জন্য ১৫তম ব্যাচকে ফিটলিস্টের জন্য ডাকা হয়নি। ব্যাচটিতে প্রশাসনিক ক্যাডারের ১১২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ জনকে পদোন্নতি দিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে উপসচিব করা হয়েছে। বঞ্চিত করা হয় সমসংখ্যক কর্মকর্তাকে।
পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ চলেছে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে। এ সরকারের বিগত চার বছরের শাসনামলে পুলিশবাহিনীতে দলীয় অনুগত ৩২ হাজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এদের মধ্যে ২৮ হাজারের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং আরো চার হাজার ৩১ জনের নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্তপর্যায়ে। পুলিশ সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলাভিত্তিক কোটা থাকলেও গোপালগঞ্জসহ বৃহত্তর ফরিদপুর এবং কিশোরগঞ্জ অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিয়ে পুলিশবাহিনীতে বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে কোটার তিন গুণেরও বেশি লোককে পুলিশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে ১০ হাজার ও কিশোরগঞ্জ থেকে সাত হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুধু গোপালগঞ্জ জেলা থেকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে আট হাজার। বাকি ১৫ হাজারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সারা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে।  অভিযোগ রয়েছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু দলীয় বিবেচনায় আওয়ামী লীগের অনুগতদের এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ দিকে বিরোধী দল ও মতের লোকদের দমন-পীড়নে নগ্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাকে। ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। তবে মন্ত্রী ও এমপিদের সুপারিশে দলীয় লোকদের নিয়োগ দেয়া হলেও এতে লাখ লাখ টাকার উৎকোচ-বাণিজ্যও সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। বলাবাহুল্য, যোগ্যতার বিচার না করেই দলীয় লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এ ধরনের দলীয় পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। আর এ ক্ষেত্রে যে যত বেশি পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারছেন, সরকার তাকে পুরস্কৃত করছে পদ-পদবির উন্নতিসহ নানাভাবে। তার অন্যতম নজির বহুল আলোচিত বিষয় ডিসি হারুনকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক দেয়া। এ কাজে অতি উৎসাহীর ভূমিকা পালন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি দলবাজ পুলিশ সদস্যদের পক্ষ নিয়ে বারবার কথা বলে কার্যত পুলিশের বিরোধী দল-মত দমনের নৈরাজ্যকর পথকেই আরো প্রশস্ত করছেন। এবার তিনি ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক’ পাওয়ার জন্য বাছাই কমিটির ৬৬ জনের সাথে অনেকটা জোর করে এ তালিকায় ডিসি হারুনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে তাকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৬ জুলাই বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি চলার সময় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালিয়ে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করেন। এর ফলে তাকে বিদেশে পর্যন্ত বহু দিন চিকিৎসা নিতে হয়। সে দিন ফারুক প্রাণপণ দৌড়েও আওয়ামী পুলিশ হারুনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। বিষয়টি সব মহলে নিন্দিত হলেও সেই ডিসি হারুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বদান্যতায় ২০১২ সালের ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ ভূমিকা’ পালনের জন্য এবার পেলেন ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক’। বিষয়টি বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারুনের প্রশংসায় বারবার মুখ খুলেছেন। তার মুখ থেকে দেশবাসী শুনছেন ডিসি হারুন-বন্দনা। তিনি বলছেন, ডিসি হারুনের মতো সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা থাকলে কেউ আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করার সাহস পেত না। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারে হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই হারুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও টেলিভিশনের পর্দায় মানুষ দেখেছেন ডিসি হারুন যখন একদল পুলিশ নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান’ রাখছিলেন, ঠিক তখন তার ও তার চোখের সামনে ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎকে  কুপিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা নাটকের চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন করছিল। আজ সেই ডিসি হারুন পেলেন প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক। দলবাজি কাকে বলে!
আসলে আওয়ামী লীগ কখনোই নিয়মনীতি বা স্বাভাবিকতায় বিশ্বাসী নয়। কোনো ধরনের অনৈতিক ও অযৌক্তিক কূটকৌশল ছাড়া দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক, জনগণের সমর্থিত দল ক্ষমতায় আসুক, গণতন্ত্র চর্চায় স্বাভাবিকতা ফিরে আসুকÑ এসবে এ দলের বিশ্বাস নেই। তাই কখনো একদলীয় বাকশাল, কখনো সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, কখনো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েমের নামে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, কখনো তা তাড়াতে নানা কূটচাল অর্থাৎ যাতে যখন সুবিধা দলের জন্য, সে দিকেই দৌড়াতে শুরু করে এ দল। এতে জনগণের মত-অমতের তোয়াক্কা করে না। যখনই দলটি দেখে, জনগণের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না, তখনই খোঁজে নানা অপকৌশল। এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার অপকৌশল সেই একই উদ্দেশ্যতাড়িত। অর্থাৎ যে করেই হোক, ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করা। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল-মত দমন-পীড়ন করা হয় খোলাখুলি। আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী ও দলটির সমালোচনা যিনিই করুন তারই ওপর নেমে আসবে আওয়ামী নেতাদের সমালোচনার ঝড়। এবার এমনই এক ঝড়ের মুখে পড়েছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমপি এবিএম মূসা। তিনি সম্প্রতি ‘সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত এক সভায় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেছেন, ছাত্রলীগের এখন নাম দেয়া হোক ‘হাসিনা লীগ’ বা ‘বাম লীগ’। তিনি পাঠ্যপুস্তক থেকে মওলানা ভাসানীকে বাদ দেয়ারও সমালোচনা করেছেন। এতে মূসার প্রতি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এরা এখন বলছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান সরকারের সহযোগী। কিন্তু এরা বলছেন না, শেখ মুজিবের আমলে তিনি আওয়ামী লীগেরই এমপি ছিলেন। আসলে তাদের চোখে শুধু আওয়ামী লীগের পক্ষে যারা বলবেন ও চলবেন, তারাই স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। বাকিরা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’। জানি না, এবিএম মূসা আরেকটু সত্য কথা বললে তার নাম যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় উঠে যায় কি না!
আসলে শুধু আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, আর বাকিদের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলা একধরনের মূর্খতারই নামান্তর। কারণ, আমরা দেখি, নির্বাচনে দেশে ৩৫-৪০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। তাহলে কি দেশের বাকি ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী? তা-ই যদি হয়, তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, আওয়ামী লীগের তত্ত্বের অপর অর্থÑ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ চায় না। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন।
আসলে আওয়ামী লীগের আচার-আচরণেই দলটির প্রতি বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষ এমন আস্থা রাখতে পারছেন না যে, এ দলের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আজ জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল, সুশীলসমাজ ও সাধারণ মানুষের দাবিÑ আগামী নির্বাচন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। জানি না, এ ব্যাপারে সরকারের বোধোদয় কখন ঘটবে? না দেশ ও জাতির জন্য অপেক্ষা করছে নতুন কোনো বিপর্যয়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads