পত্রপত্রিকায় এখন ছাত্রলীগকে নিয়ে নানা রকম শিরোনাম হচ্ছে। কোন পত্রিকার শিরোনাম ‘আতঙ্কের আরেক নাম ছাত্রলীগ।' কোনো পত্রিকার শিরোনাম ‘ছাত্রলীগ এখন এক সন্ত্রাসী সংগঠন।' ছাত্রলীগকে নিয়ে শিরোনামের যেন শেষ নেই। ছাত্রলীগ এখন শুধু প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের উপরেই হামলা চালায় না, স্বার্থের দ্বনেদ্ব নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করতেও কুণ্ঠিত নয় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। তাই এখন সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রপত্রিকায়ও লেখা হচ্ছে, এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এখন মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় শরীক আওয়ামী লীগের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে, তারা প্রকাশ্যে যা বলেন তা সত্য হলো। গত ৪ বছর ধরে চলছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নানা তান্ডব। শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে দেশের যে কোন স্থানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ বিরোধীদের সঙ্গে মারাত্মক দাঙ্গা-হাঙ্গামায জড়িয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। এতে জনমনে তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগ আতঙ্ক। উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারের ৪ বছরে শিক্ষাঙ্গন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে নৃশংসতা প্রাণ দিতে হয়েছে ২৭ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও পথচারী থেকে শুরু করে অবুঝ শিশুও রেহাই পায়নি ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাত থেকে। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সর্বশেষ তান্ডব লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত শনিবার এখানে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষের প্রধান কারণ ছিল নিয়োগ-বাণিজ্যের ভাগাভাগি। এ ছাড়া ছিল সম্প্রতি শেষ হওয়া সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন খাত থেকে পাওয়া অনুদানের মোটা অঙ্কের টাকার অবশিষ্ট অংশের ভাগবাটোয়ারার দ্বনদ্বও। ছাত্রলীগের পরবর্তী কমিটিতে প্রাধান্য বিস্তার নিয়েও দু'পক্ষের মধ্যে উত্তাপ বেড়ে চলছিল। নিয়োগ-বাণিজ্য, অর্থের ভাগবাটোয়ারা ও কমিটিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বনেদ্ব একই সংগঠনের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটির ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হলেও ছাত্রলীগের মধ্যে এখন তা যেন নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির এমন অধঃপতনের ঘটনায় নানা নিন্দাবাদ শোনা গেলেও প্রকৃত বিশ্লেষণ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। এটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মোটেও কোন সুসংবাদ নয়।
ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠন কি করে, কিভাবে আজ একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হলো তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও সমাধানের দিকে কাউকে দৃষ্টিপাত করতে দেখা যাচ্ছে না। এটি আমাদের রাজনীতির জন্য এবং জতির জন্য বড় দুঃসংবাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, এই জনপদের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা। জাতির স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রনেতাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু সেই ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রনেতাদের আজ এমন অধঃপতন ঘটলো কেমন করে? ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগে ছাত্ররা ছাত্র সংগঠন করতো আদর্শের ভিত্তিতে এবং উন্নত শিক্ষা-দীক্ষার লক্ষ্যে। সেখানে ক্ষমতা, ভাগবাটোয়ারা কিংবা অর্থ লি≈vর কোন প্রশ্রয় ছিল না। ফলে আগে আদর্শকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতিতে সিলেবাসের লেখাপড়ার বাইরেও আদর্শ ও দর্শনের লেখাপড়া করতে হতো, পাঠচক্রের মাধ্যমে জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হতো এবং তাত্ত্বিক লেখাপড়ার সাথে সাথে কর্মের সমন্বয়ও সাধন করতে হতো। ছাত্রনেতাদের ছাত্র সংগঠনের এমন প্রক্রিয়ায় আদর্শ ও জ্ঞানচর্চার সুযোগ থাকলেও সেখানে সন্ত্রাস কিংবা টেন্ডারবাজির কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু আজ যখন আদর্শ ও জ্ঞান চর্চার বদলে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজির প্রশ্রয় লক্ষ্য করা যায়, তখন অঙ্গুলীটা উপরের দিকেই নির্দেশ করতে হয়। আসলে জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার বিষয় থেকে আমাদের সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো যেন মুক্ত হয়ে গেছে। এমন মুক্তির জন্য তো দেশ স্বাধীন হয়নি। ছাত্র সংগঠনে যখন কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রী থাকে তখন তাদের অবশ্যই প্রতিটি অপকর্মের হিসেব নিতে হবে। তারা হিসেব নিতে ব্যর্থ হলে তাদের যারা চালান তাদের হিসেবের ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু দায়িত্ব পালন কিংবা জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতো তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠার বদলে নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতাবান দুষ্ট লোকদের আপন আপন ডানার নিচে আশ্রয় তিতে ব্যস্ত। এর লক্ষ্যও পরিষ্কার। আদর্শ ও ন্যায় নিষ্ঠার বদলে কি করে ক্ষমতায় কায়েম থাকা যাবে, তেমন চিন্তা থেকেই বিস্তার ঘটেছে এমন ভ্রষ্টাচারের। তাই বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগকে রক্ষা করতে হলে আগে এসব ভ্রষ্টাচারের সংশোধন প্রয়োজন। ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসের অন্ধকার থেকে ঐতিহ্যের আলোকময় পথে ফিরিয়ে আনতে হলে জাতীয় নেতা-নেত্রীদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বদলে আদর্শ ও ন্যায়ের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন। এমন প্রত্যাবর্তনে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধন। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোন বোধোদয় ঘটে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন