আলোড়ন হয়েছে মননে এবং রাজপথে। ঢাকায় বাংলা একাডেমীর সামনে থেকে জাতীয় কবি নজরুলের সমাধি পর্যন্ত। প্রতিবাদ শুধু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কালের ঘটনা নয়। আজকেও লড়তে হচ্ছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। পত্র-পত্রিকায়, মিডিয়ায় চলছে সে আগ্রাসন। রাজনৈতিক আগ্রাসনের সহযোগী হিসাবে। রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে বৈধতা দেয়ার জন্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্তরেও আগ্রাসন স্পষ্টতর হচ্ছে দিনকে দিন। হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা এবং চরিত্র হনন চলছে। চলছে চিন্তা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে তছনছ করার অপতৎপরতা।
রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়ার বিষয়টি পুরাতন ও বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। তারপর চলেছে ইসলামী সাহিত্য ও ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়কে জেহাদি বা জঙ্গি সাহিত্য বলে চিৎকার করার প্রবণতা। এখন পর্দানশীন মা-বোনদেরকে ঘর-অফিস-সভাস্থল থেকে গ্রেফতার করার মাধ্যমে ইসলামের প্রতিটি প্রতীক ও উপমাকে আক্রান্ত করার ষোলকলা পূর্ণ হলো। বর্ষীয়ান ও সম্মানিত নারী, অন্তঃসত্ত্বা তরুণী ও আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারী মাত্রেই এখন আক্রমণের মুখোমুখি। মানবতার বিরুদ্ধে এমন আঘাতই এখন চলছে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, ইসলামী সাহিত্য ও পর্দানশীন নারী যদি মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধের দোসর হবে, তাহলে খোদ মার্কিন মুলুকের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ইসলামী স্টাডিজ বিভাগ রয়েছে, তারাও মৌলবাদী-যুদ্ধাপরাধী? বিশ্বের সর্বত্র পর্দানশীন রমণীরাই কি অভিযোগের যোগ্য? মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার এমন চরম অবমাননার প্রতিবাদ করা যেখানে বুদ্ধিজীবীর প্রধান দায়, সেখানে স্তব্ধ তারা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তাঁবেদারির কারণে।
১৯৬৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ‘দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস' পত্রিকায় নোয়াম চমস্কি ‘বুদ্ধিজীবীর দায়' শিরোনামে একটি লেখা লেখেন। বিশ্বের দেশে দেশে এই লেখা চর্চিত হলেও বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দায় কতটুকু মেটানো সম্ভব, সেটা বলাই বাহুল্য। দলপন্থী বা আদর্শপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ নিজের প্রভুদের দালালি করতে করতে ন্যায়-নীতি-নৈতিকতার বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন। অত্যাচারীর সম্মুখে ন্যায়ের কথা বলা সবচেয়ে বড়ো ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বা জেহাদ-এই ধর্মীয় নির্দেশই প্রতিপালিত হচ্ছে না। ফলে চারদিক থেকে বন্য মোষের মতো ঘিরে ধরেছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
বলা অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাংবিধানিকতা, মানবাধিকার ও সুশাসনের চলমান লড়াইয়ের সঙ্গে এসে মিশেছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ। আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে কি করতেন জানি না; তাদের অনুপস্থিতিতেও এটা জেনেছি যে, বাংলাদেশ প্রতিবাদহীন বোবার দেশ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। যে প্রতিবাদ এদেশের মানবমন্ডলীর স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত ছিল হাজী শরীয়াতুল্লাহ ও তিতুমীরের আমল থেকে, সেটাকে নস্যাৎ করে দেয়ার মতলবী অপতৎপরতা চলছে। জনতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত দ্রোহকে সঙ্কুচিত করা গেলেই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কালাপাহাড়ের মতো চাপিয়ে দেয়া যাবে। এখন সেই কালোকর্মের ধারাই চলছে।
বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিকরা যখন প্রতিবাদ করেন না, দ্বনদ্ব-বিভক্তির নাম করে ভাগাভাগি করেন, তখন মনে হয় জাতির আত্মা হাহাকার করে উঠছে। আমরা শঙ্কিত হই। মনে হয় আঘাতটি এসে লেগেছে মগজে, মননে, হৃৎপিন্ডে। বাইরের শত্রু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কুমতলবে কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা বা ব্যক্তি বিশেষের কাঁধে চেপে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হতে চাইলে বড়ই বিপদের কথা। প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বিভাজন ও পক্ষ-বিপক্ষকরণের অনুঘটক হয়ে বিদেশী শক্তির তাঁবেদারী করলে সেটা তো আরও মারাত্মক। এটা স্পষ্টই জাতিগত ঐক্য হননের নামান্তর। ভেতর ও বাইরে থেকে এখন এমনটিই চলছে।
এটা সত্য যে, সৎ, শুদ্ধ, গণসাহিত্যের জন্য পত্রিকা জরুরি বিষয় নয়। কবি জীবনানন্দ দাশ পত্র-পত্রিকায় বিশেষ না লিখেও বিখ্যাত এবং পাঠকপ্রিয়। তার আমলে পত্রিকার পাতা দখলকারীরা এখন ভাগাড়েও নেই। এখনও বহু লেখক আছেন, বিশেষ কোনও পত্রিকার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের লেখকসত্তারও মৃত্যু হবে। অতএব পত্রিকার শক্তি বা দুর্বলতা সংবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অপাঙক্তেয়। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কে কার লেখা ছাপিয়ে কাকে কাকে লেখক বানানোর ঠিকাদারী নিয়েছে, তাতে প্রকৃত লেখকদের বিশেষ কিছুই যায় আসে না। প্রশ্ন হলো, জাতীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে। ‘হে উৎসব' নামের একটি তথাকথিত উৎসবের সঙ্গে বিশেষ কোনও পত্রিকা বা ব্যক্তির স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক দখলদারদের মতলব জড়িত থাকতে পারে বটে; এতে যোগ দেয়ার পেছনে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কি উপকার নিহিত থাকতে পারে? জাতীয় প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করবে বাংলাদেশের লোক-লোকালয়, ভূগোল, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, পরিবেশের বহমানতা থেকে সৃষ্ট লেখককুলকে। কোলে করে আনা বিশেষ বিশেষ লেখকদের নয়। এই স্খলন, দ্বনদ্ব-সংঘাত সৃজন, আগ্রাসনের পথ করে দেয়া বাংলাদেশের কোনও স্বাধীন, সার্বভৌম লেখক মেনে নিতে পারবে না। এটাও মানা যায় না যে, বিশেষ বিশেষ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা; রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চরিত্র হননের মাধ্যমে একতরফাভাবে জর্জরিত করা; বিশেষ করে ইসলামী আদর্শ, মূল্যবোধের অনুসারী নারী ও পুরুষদেরকে আক্রমণে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত করা। রক্তমাখা বাংলা ভাষার প্রতিটি স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ পর্যন্ত প্রতিবাদে কেঁপে উঠবে। পূর্ব কিংবা পশ্চিম, যে কোনও দিকের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাংলাদেশের মানুষ কখনওই মেনে নেবে না। যতই অত্যাচার আসুক এদেশের মানুষের বিশ্বাস বদলানো যায় না। ইংরেজ পারে নি; পশ্চিমবঙ্গ পারে নি। বাংলাদেশ অনন্য ও অন্য রকমভাবে জেগে আছে স্বকীয়তা ও বিশ্বাসের দ্যোতনায়।
এটা ঠিক যে, ইতিবাচক কর্মকান্ডে জড়িতদের চেয়ে অর্থ-বিত্ত-তৎপরতায় নেতিবাচক কর্মপন্থীরা অনেক বেশি জোরালো। বিশ্বাসী মানুষ সত্য বিশ্বাসের পক্ষে যেভাবে প্রচেষ্টারত হওয়ার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। আর অপশক্তি কিংবা আরো ব্যাপকার্থে ‘তাগুত' দেশি-বিদেশি শক্তি ও রসদের বলে রাবণের মতো মদমত্তরা প্রদর্শন করছে। এখানে শক্তির ঈঙ্গিত যেমন আছে, তেমনই রয়েছে কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে সেটাকে মোকাবিলা ও পরাজিত করার তাগিদ। এই বিজয় অর্জনের পূর্বশর্ত জ্ঞান, দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তি, যুক্তি, তথ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্যেই নিহিত। এই শীতকালে দেশের গ্রাম-গঞ্জ-প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে হাজার হাজার ওয়াজ-নসিয়ত-মাহফিল হচ্ছে, সেখানে কি ইসলাম ও মুসলমানদের বাস্তব সমস্যা ও বিপদ প্রাধান্য পাচ্ছে? শত্রু ও মিত্রকে কি ঠিকভাবে সনাক্ত করা যাচ্ছে? প্রতিপক্ষ আমাদেরকে যত ভালোভাবে চেনে; আমরা কি তাদেরকে সেভাবে চিনতে পারি?
আগুন লাগলে ঘর-বাড়ি-মসজিদসহ কিছুই রক্ষা পায় না। শত্রু হানা দিলে বাছ-বিচার করে না। ঘুমিয়ে থাকলেও শত্রুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘুমের নাম হলো, ‘জেগে ঘুমানো' শত্রু জেনে গেছে, আমরা জেগে ঘুমাচ্ছি, সম্পূর্ণভাবে অসচেতন আছি। প্রতিপক্ষের এই বিশ্বাসকে আমরা প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছি। আমরা দেখছি পবিত্র কোরআনের অপমান, মোফাসসিরের প্রতি নির্যাতন-জুলুম, ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের প্রতি বে-রহম, পর্দানশীন মহিলাদের হেনস্তা। মৌনতা যে সম্মতির লক্ষণ, এটাও সম্ভবত আমরা ভুলে গেছি। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে--এই উভয় শ্রেণী মনে হচ্ছে একাকার হয়ে গেছে। এই বিভাজন রোধ করা না গেলে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিহত করা কঠিন হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন