রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও সংবাদ সম্মেলনের পর নতুন করে এ বিতর্কে যুক্ত হলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি এ কেন্দ্র স্থাপনে সরকারের উদ্যোগের সমালোচকদের অতীত পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকানোর আহ্বান জানিয়ে গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আপনারা যা বলছেন তা প্রথম প্রজন্মের প্রযুক্তি। কিন্তু এখন সময় এসেছে তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তির। রাশিয়ার সাথে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে চুক্তির পর জানানো হয়, এ বছরের অক্টোবরের মধ্যেই দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি সংস্থা রোসাটমের সহায়তায় পাবনার রূপপুরে এই কেন্দ্রের দু’টি চুল্লি থাকবে, যা থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বিদ্যুৎ ঘাটতিতে দেশে এই কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সরকার রূপপুর চুক্তিকে এক বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখাচ্ছে। কিন্তু এ পরমাণু চুক্তির বিষয়বস্তুর সামান্যই বাংলাদেশের মানুষ জানেন। ২০১২ সালের মাঝামাঝি আইএইএ’র কাছে দেয়া বাংলাদেশের ‘সেল্ফ-ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, রাশিয়া বাংলাদেশকে ভিভিএআর-১০০০ ডিজাইনের দু’টি রিঅ্যাক্টর সরবরাহ করবে। এই মডেল ১৯৭০ দশকের পানি দিয়ে শীতায়িত ধরনের। নিউকিয়ার ফুয়েল রডগুলো শীতল করায় রিঅ্যাক্টরের প্রাইমারি সার্কিটের ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহিত করা হবে এবং এই প্রবাহ নির্ধারিত চাপে সব সময় চলবে, যাতে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পর্যায়ে না যায়। রিঅ্যাক্টর কমপ্লেক্সে ব্যবহারের পর এই পানি ছেড়ে দিতে হবে। তা পরিবেশে নির্গত হওয়ার পর রূপপুরের প্রাণবৈচিত্র্য ও জলজসম্পদের কী হবে, সে প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া আরো প্রশ্ন এসেছে, রূপপুরের নিউকিয়ার রডগুলো কিভাবে সরবরাহ ও ব্যবহারের পর অপসারণ করা হবে। রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ বাংলাদেশ করবে না। রাশিয়া রিঅ্যাক্টরের জ্বালানি উপাদান সরবরাহের সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় রডগুলোর জীবনচক্র ফুরালে তারাই এগুলো ফিরিয়ে নেবে। ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ার পর তেজস্ক্রিয় জ্বালানির রডগুলো কোথায় মজুদ করা হবে এবং কিভাবে সেগুলো রূপপুর থেকে নিয়ে যাওয়া হবে, সেটিও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ইউরোপে বহু বছর ধরে এ ধরনের জ্বালানি সরঞ্জাম সড়কপথে আনানেয়ার বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ হয়ে আসছে। পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তাও একটি বড় প্রশ্ন। বলা হচ্ছে, ভিভিএআর-১০০০ মডেল বিশ্বের ভয়াবহ পরমাণু বিপর্যয়ের কেন্দ্র চেরনোবিলে ব্যবহৃত গ্রাফাইট-মডারেটেড মডেল থেকে অনেক নিরাপদ বলে প্রমাণিত। চেরনোবিল দুর্ঘটনায় রাশিয়ার হাজার হাজার মানুষের ক্যানসারে মৃত্যু ঘটেছে, বিরাট এলাকায় কৃষি উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলকে বিপন্মুক্ত করতে বিপুল অঙ্ক ব্যয় করতে হয়েছে। তারপর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় আরেকটি পরমাণু বিপর্যয়ের পর রাশিয়ায় একটি ‘স্ট্রেস টেস্ট’ করা হয়। তাতে দেখা যায়, জাপান ও রাশিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো একই রকম কিছু মৌলিক ত্রুটিযুক্ত।
রোসাটম ২০১১ সালের এক যৌথ প্রতিবেদনে শীতলীকরণ-প্রক্রিয়া কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোর নিরাপদ থাকার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। শীতলীকরণ-প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে পাওয়ার ব্যাকআপ সিস্টেমও কাজ করবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই বলে বলা হয়েছে। রুশ সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থানাভাবে পরিত্যক্ত জ্বালানি রিঅ্যাক্টরের স্থানেই মজুদ করা হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের পরমাণু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থার এই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনায় নিয়েছেন কি না।
আমরা মনে করি, পরমাণু প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের আগে এর সুবিধার পাশাপাশি উদ্বেগের দিকগুলোকেও বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। সেটি যখন করা হয়নি এখন অন্তত এ কেন্দ্রের কাজ শুরুর আগে হলেও এর যে বিপদের দিকগুলো বিশেষজ্ঞরা তুলে নিয়ে আসছেন, সে ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য জনগণকে জানানো প্রয়োজন। একই সাথে পরমাণু জ্বালানি ঘিরে বিশ্বব্যাপী যে বিরাট বিতর্ক হচ্ছে সে বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় আনতে হবে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কুদানকুলামে রাশিয়ার সরবরাহ করা ভিভিএআর রিঅ্যাক্টর বসানো নিয়ে বিরাট আন্দোলন হচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ বছরওয়ারি বন্যায় প্লাবিত হওয়ার দেশ হিসেবে এত বড় ঝুঁকি নেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে কি না দেখতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অবশ্যই বিদ্যুতের প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো মূল্য দিতে দেশের মানুষ রাজি আছে কি না সেটিও দেখতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন