শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩

জিয়াকে নিয়ে আলোচনা সহজ, সমালোচনা কঠিন



বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণমুখী রাজনীতির জাদুকর প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে তিনি এক প্রচন্ড ঝড় সৃষ্টি করেছিলেন, একথাটি তাঁর বেলায় একমাত্র সত্য নয়। সেই ঝড়কে তিনি শান্ত, স্থিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। তাকে পরিণত করেছিলেন জনগণের শক্তিতে, বিশ্বাসে আর প্রত্যাশায়। এখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে জিয়ার নেতৃত্বের স্বরূপ। অনন্য একই গুণটির জন্যেই তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলেন। সত্তর এবং আশির দশকের ক্রান্তিকালে বিশ্বে যে-ক'জন জননন্দিত নেতার সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি, জিয়া ছিলেন তাঁদের প্রথম সারির একজন। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে কিংবা নিছক ঈর্ষার কারণে যাঁরা ছিলেন তাঁর চরম বিরোধী, তাঁদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি তাঁর উপস্থিতিকে অস্বীকার করা। সম্ভব হয়নি কারও পক্ষেই তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতিতে নতুন কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ফ্যাসিবাদী বাকশাল সরকারের পতন ঘটে এবং প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর তাঁর সহকর্মী বন্ধু, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ নতুন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। সেই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন মুহম্মদ উল্লাহ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানের পিতা), অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ফণীভূষন মজুমদার, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, আব্দুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আব্দুল মোমিন, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর, মল্লিক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় ২৩ বছর আগের জেল হত্যা মামলায় জড়িয়ে বিএনপি নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং জাতীয় পার্টির {জা-মো} নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়), তাহের উদ্দিন ঠাকুর, দেওয়ান ফরিদ গাজী, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে. এম ওবায়দুর রহমান, মোসলেম উদ্দিন খান, ডাক্তার ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মমিন উদ্দিন আহমদ। তখন এরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘স্টার'। উপ-স্টাফ প্রধান জিয়াউর রহমান তখন রাজনীতির সীন-এ-ই নেই।
উল্লেখ্য মোশতাক মন্ত্রীসভার আরো ক'জন জীবিত সদস্য শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় আওয়ামী লীগের দরবার উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন। উপরের তালিকাটার সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৯৭ সালে জেল হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর জনমনে প্রশ্ন জেগেছিল, প্রধানমন্ত্রী তার ‘সভারত্ন'দের বাদ দিয়ে, শুধু তিনজনের প্রতি এতো খড়গহস্ত হলেন কেন? এক জায়গায় দুই ফল কেন? বুঝতে কি অসুবিধা হয় না যে, ওবায়েদ, মঞ্জুর, মোয়াজ্জেমের অপরাধ-তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী অযোগ্য, ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সর্বসময় অগ্রসৈনিক ছিলেন।
যা হোক, শেখ মুজিবের পতন ও হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাকশাল বা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পুনর্দখল ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ চৌধুরী লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড : ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস' গ্রন্থে মোশতাক মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের নামের তালিকা উল্লেখ করে স্বীকার করেছেন- ‘‘খন্দকার মোশতাকের ঐতিহাসিক(!) ভাষণ তখন শেষ হয়েছে। একটু পরেই বাংলাদেশ বেতারে নতুন প্রেসিডেন্টের(!) প্রতি আনুগত্যের ভাষায় কথা বললেন, একে একে সেনাবাহিনীর প্রধান শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনীর প্রধান এ.কে. খন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান এম.এইচ. খান, বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নুরুল ইসলাম, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান লেঃ কর্ণেল আবুল হাসান... সেনাবাহিনী প্রধান সাড়ে এগারটার দিকে হেড কোয়ার্টারে ফিরে এলেন। অফিসারদের এ্যাড্রেস করে বললেন, যা হয়েছে- হয়েছে। বাট নাউ য়ূ অল রিমেইন ইন ইয়োর রেসপেকটিভ ইউনিটস, নো ওয়ান স্যুড গো আউট অব ক্যান্টনমেন্ট আনটিল ফারদার অর্ডার...।’’
অধ্যাপক আবু সাইয়িদই মুজিব হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে তাঁর নিজ দলের লোকদের চিহ্নিত করলেন। সেনাবাহিনীর প্রধান শফিউল্লাহর ভূমিকা ‘চোখে আঙ্গুল দিয়ে' দেখিয়ে দিলেন। এখানে কোথাও জিয়ার একবিন্দু সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং জিয়ার ভূমিকাকে তিনি গ্লোরিফাই করে একই গ্রন্থে কর্ণেল (অবঃ) সাফায়াত জামিলের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘‘পথে উপ-স্টাফ প্রধান লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে যাই, তাঁর পরামর্শ এবং সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য। তিনি তখন অর্ধেক শেভরভ অবস্থায় ছিলেন। আমার কাছ থেকে পরিস্থিতি শোনার পর তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন তো কি হয়েছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা উচিত। জলদি তোমার ট্রুপস প্রস্তুত করে ফেল।’’ গ্রন্থের এ বক্তব্যে ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ, নির্মোহ এক আদর্শ সৈনিক জিয়ার চরিত্রই তো ফুটিয়ে তুলেছিলেন অধ্যাপক সাইয়িদ।
জিয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিলে। এর আগে ৬-১১-১৯৭৫ থেকে ২০-৪-৭৭ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১০-১১-১৯৭৫ থেকে ২০-০৪-১৯৭৫ পর্যন্ত জিয়া ছিলেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। জিয়া সামরিক আইন জারি করেননি। তা করেছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় জিয়ার পূর্বসূরী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ও সিএমএল-এ বিচারপতি সায়েম এবং ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানকারী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর সঙ্গী-সমর্থকরা। জিয়া ডিসিএমএল এ ছিলেন ১০ নভেম্বর থেকে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্যু'র পর ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ বিচারপতি সায়েম যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন জিয়া তখন ছিলেন খালেদের হাতে বন্দী। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই তিনি মুক্ত হন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালের মতো পুনরায় পাদপ্রদীপের সামনে আসেন।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ : এ লিগেসি অব ব্ল্যাড' গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘মোশতাক আর মেজরদের উৎখাতের খবর শুনে আওয়ামী লীগার, ছাত্র ও মুজিব সমর্থিত দলগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে। ৪ নবেম্বর, মঙ্গলবার তারা মুজিব দিবস হিসেবে পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনারসহ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসভা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের বিভিন্নস্থান থেকে মিছিল বের হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে মুজিবের বাসভবনে গিয়ে পুস্তবক অর্পণ করে... তারপর ৭ নবেম্বর শুক্রবার শেখ মুজিবের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোকসভার আয়োজন করে। এসব কারণে জনগণের মনে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এই অভ্যুত্থানের (৩ নভেম্বর খালেদের অভ্যুত্থান) সূচনা হয় বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়... সর্বোপরি তারা যখন আবিষ্কার করলো, আওয়ামী লীগের মিছিলে খালেদের মা ও ভাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন তারা বুঝে নেয় যে তার অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত আর আওয়ামী লীগ জড়িত- এতে কোন সন্দেহ নেই...।’’
খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ম্যাসকারেনহাস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘...সে যাই হোক, জীবনের হুমকির মুখে জিয়ার কাছ থেকে ইস্তফা আদায় করা হয়েছিল বলে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়। কারণ, তিনি ইস্তফা দেয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর বাড়ীতে বন্দী অবস্থায় সময় কাটাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠানো হয় জেনারেল জিয়াকে আটক করার জন্য। তারা তাঁর বাড়ীকে সকল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জিয়াকে তাঁর হল ঘরে আটকে রাখে।'
এই প্রেক্ষাপটেই সংঘটিত হয় ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান। সকাল বেলা সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাজপথে হাজার হাজার মানুষ তাদের অভিনন্দন জানায়। চেতনার ঐক্য কিভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে ৭ নবেম্বর তার প্রমাণ। যে জনগণ ৩ থেকে ৭ নবেম্বরের সূর্যোদয় পর্যন্ত ছিলো বাকরুদ্ধ, বিপন্ন স্বাধীনতার প্রশ্নে উৎকণ্ঠিত, তাদের কণ্ঠে বুলন্দ আওয়াজ উঠলো-‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার', ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'। জিয়া মুক্ত হলেন।
৭ নবেম্বর ১৯৭৫ সকালে বেতার চালু হলে বেতারে ভেসে আসে আবার সেই একই চেনা কণ্ঠ-‘আমি জিয়া বলছি... সৈনিক ভাইয়েরা ব্যারাকে ফিরে যান, জনগণ শান্ত থাকুন...।' সমগ্র জাতির কানে কানে যেনো ছড়িয়ে পড়ল কিসের এক জাদুমন্ত্র! মুহূর্তে জেগে উঠল প্রাণ, বেজে উঠল জীবনের নতুন গান।
আনন্দে উদ্বেল জাতি তাঁকে অর্পণ করে নেতৃত্ব, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। তিনি দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক প্রভূত্ব কায়েম করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। জনগণের সঙ্গে তিনি স্থাপন করেছেন বন্ধুত্ব। জনগণের অজেয় শক্তির ওপর তিনি পরিপূর্ণ আস্থাবান ছিলেন। তিনি বলতেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, জনগণই ক্ষমতার উৎস। তাই তিনি চেয়েছিলেন রাজনীতিটা জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে। তিনি বলতেন, জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে, তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে শেখাতে হবে এবং তাদের সমস্যা নিজেদের প্রচেষ্টায় সমাধান করার মানসিকতা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। জনগণের ক্ষমতা তিনি জনগণকেই ফিরিয়ে দিলেন। বাকশালী একদলীয় ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। জিয়ার আগমন না ঘটলে আজকের আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হতো কি না সন্দেহ।
এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, ‘...উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বে-সামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাংক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার ওই ট্যাংক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে ট্যাংকের সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। চারদিন ধরে তারা মনে করছিলো যে, খালেদ মোশাররফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেলো। জনতা সৈনিকদের তাদের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দিত করলো। সর্বত্রই জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সাথে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে সারা রাতভর শ্লোগান দিতে থাকে-আল্লাহু আকবার, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিলো, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনমত আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিলো সত্যিই একটা স্মরণীয় রাত।'
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের পাদ-প্রদীপের সামনে জিয়ার আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। হঠাৎ এসে সবাইকে তিনি চমকে দিলেন। যেন বললেনঃ ‘আমি এসে গেছি। এখন আমার কথা তোমাদের শুনতে হবে।' সত্যি জিয়ার কথা সবাইকে শুনতে হলো। যারা সনাতন রাজনীতির পাকচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, সেই নতুন মুখ থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট হলেন। অনেকে চোখ কপালে তুললেন। বললেনঃ উজান ঠেলে ঝঞ্জা-ক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দিতে চাইছে কে এই যুবক?
একবারে শুরু থেকেই উজানের বিপদ-সঙ্কুল পথ ধরে যাত্রা শুরু করেছিলেন জিয়া। গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে-যাওয়ার রাজনীতিকে তিনি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কেননা, অনুকূল হাওয়ায় পাল তুলে দেয়ার নীতি ছিলো তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘বিদ্রোহ' বলা হয় সেই অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিদ্রোহী। এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হলো, মুক্তিযুদ্ধে এবং সত্তর দশকের মধ্য-পর্বের রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকার সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
বাংলাদেশের প্রথম শাসক শেখ মুজিব সব দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন জারি করেছিলেন। পার্লামেন্টে ব্রুট মেজরিটির জোরে সংবিধানের মৌল চরিত্র বদলে ফেলে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। খুব অনাকাক্মিখতভাবে তাঁর সরকারের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এতে করে গণতন্ত্রসম্মত স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা বদলের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন।
জিয়ার রাজনীতিতে আবির্ভাব যেমন আকস্মিক, তেমনি ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় তাৎপর্যবহ। তিনি তার ক্যারিয়ার গড়েছেন একজন সৈনিক হিসেবে এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ অর্জনই ছিল তার অভীষ্ট লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্তির পর সেনাবাহিনীতে জৈষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়াকে বঞ্চিত করে শেখ মুজিব তার ব্যক্তিগত পছন্দের জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান বানান।
যারা বলেন, জিয়া সেনাবাহিনীনির্ভর রাজনীতি করতেন এবং বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নিয়েছে তারা ইতিহাসের বাস্তবতাকে ধামাচাপা দিয়ে বিকৃত ব্যাখ্যা হাজির করেছে। মনে রাখতে হবে যে, মুজিবী দুঃশাসনে যখন একদলীয় বাকশাল প্রবর্তিত হয় তখন দেশের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ও নিষিদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়নের কারণে রাজনৈতিক কর্মীরা বিশৃক্মখল এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। আপেক্ষিক অর্থে তখন সুশৃক্মখল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেবলমাত্র সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রই অবস্থান করছিল এবং যেহেতু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল সেহেতু রাজনৈতিক দল গঠনসহ গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীকে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। এটি না দোষের না অপরাধের বিষয়। এ পরিস্থিতির জনক স্বয়ং শেখ মুজিব। ক্ষমতার মদমত্ততায় সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের সদস্যদের রাজনৈতিক দলভুক্ত করার প্রক্রিয়া তিনিই প্রথম চালু করেন। জিয়ার কৃতিত্ব এখানেই যে, শেষ বিশ্লেষণে রাজনীতিকে সেনাপ্রভাব থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেন তিনি। যার ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে হত্যা করেও তার প্রবর্তিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বহাল রাখতে বাধ্য হয়।
জিয়া সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস সংযোজন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ছুরত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এতে জাতীয়তাবাদের যে ধরনের অন্ধত্ব, উগ্রবাদ ও বর্ণবাদ আসন গাড়তে পারে তার আশঙ্কা দূরীভূত হয়েছে। এমনি আমাদের জাতীয়তার মানস গঠনে কিংবা সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তা নির্মাণে ইসলামের ভূমিকা প্রত্যক্ষ এবং সর্বব্যাপক। ইসলাম কোনো আচার সর্বস্ব ধর্ম হলে জাতীয়তা বিনির্মাণে তার ভূমিকা তেমন প্রাধান্য বিস্তার করতে পারতো না। কিন্তু ইসলাম এ দেশের মুসলমানদের আগমনকে যেমন অনিবার্য করেছে, তেমনি মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকামী একটি সংগ্রামী জাতিতে পরিণত করেছে। রাষ্ট্র শাসনের ভিত্তি হিসেবে ইসলামের মূলনীতি গ্রহণ করা না হলেও সংবিধানের মূল চেতনাকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বায়নের সাথে জিয়া সমন্বিত করে গেছেন। মুজিবী দুঃশাসনে যেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ইসলাম নির্মূল করার নির্দয় অভিযান চালানো হয়, সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা-সংগঠক ও সেক্টর কমান্ডার হয়ে জিয়া সংবিধানকে তৌহিদবাদী চেতনায় আলোকিত করেছেন। এটাকে নিছক রাজনৈতিক কৌশল বললে ভুল হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় পরিচিতি গৌরবকে সমন্বিত করার জন্য সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর চেয়ে মহৎ উদ্যোগ আর কি হতে পারে? আওয়ামী-বাকশাল এবং সীমান্ত বহির্ভূত আনুগত্যবাদী তথাকথিত সেক্যুলার গোষ্ঠী ছাড়া আর কেউ জিয়ার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বিরোধিতা করেনি। জিয়া তৌহিদবাদী জাতির পরিচয়-ঠিকানা ফিরিয়ে দিয়েছেন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়। এই বিশাল অর্জনকে মূল্যায়ন করা না হলে জিয়ার প্রতি অবিচার করা হবে। সংবিধানের এই গুণগত পরিবর্তনকে আজও আওয়ামী-বাকশালী চিন্তার ধারকরা মেনে নিতে পারেনি।
শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আরও একটি বড়ো অভিযোগ, তিনি সাম্প্রদায়িক, ধর্মভিত্তিক, রাজনীতির পথ উম্মুক্ত করেছেন। শহীদ জিয়া যদি ইসলামী রাজনীতিকে পুনর্বাসিত করে থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগকেও বাকশালের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগকে বাকশালের কবলে ঢুকিয়ে যান। আওয়ামী লীগের রূপান্তর-বাকশাল ছিল শেখ মুজিবের চূড়ান্ত রাজনৈতিক সমীকরণ। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে   পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বী রাজনীতিকরাও বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সুবাদে জিয়ার আমলে বাংলাদেশে দল গঠন ও রাজনীতি করার সুযোগ ফিরে পায়। কিন্তু এটুকুতেই তারা তুষ্ট থাকতে পারেনি। এদের একটি অংশ প্রকাশ্যে চাঁদ-তারা পতাকার দাবি তোলে।
মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনকে জিয়া গুরুত্ব দিতেন। দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তোলার স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তা লাভের চেষ্টায় তিনি প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে বাদশাহ, আমীর, সুলতান ও শেখদের প্রভাবিত করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা জিয়ার রাষ্ট্রনীতিকে ডিকটেট করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের অনমনীয়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা ষড়যন্ত্রকারী মহল এই ক্ষোভকেই কাজে লাগায়। তাদের উস্কানিতে সবখানে দেখা দেয় মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বনদ্ব। অমুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তৈরি হয় বিদ্রোহী গ্রুপ। সিভিল প্রশাসনেও দ্বনদ্ব সৃষ্টি হয়। সারাদেশে দেখা দেয় অস্থিরতা। জিয়ার সমন্বয়ের রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। দূরদর্শী জিয়াউর রহমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি অগ্নিকুন্ডের উপর বসে আছি।'
জিয়া বলতেন, ‘রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক তুলে জাতিকে বিভক্ত করা আমার পছন্দ নয়, এই বিতর্ক অনেক আগেই শেখ মুজিব শেষ করে গেছেন। তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে গেছেন। জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর তাগিদেই তিনি তা করে গেছেন। এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তোলার কোন প্রয়োজনই নেই। দেশের যারা মঙ্গল করতে চায় না, যারা দেশের উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে চায়, তারা এই সব ছুঁতো তুলে দেশকে বিভক্ত রাখতে চাইবেই। এতে বিদেশী শক্তিদের লাভ আর আমাদের দেশের ক্ষতি... আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাই কোন রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করতে নিষেধ করতে পারব না। জনগণই বিচার করবে কোন রাজনৈতিক দলকে তারা গ্রহণ করবে অথবা বর্জন করবে।'
অমুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের চাপে জিয়া জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতবাসী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পুনর্বাসিত করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়কার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা উভয় পক্ষেই জিয়ার বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে বিরূপ ও ক্রুদ্ধ করে তোলা হয়েছিল। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। যদিও জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দিকেই নিজেকে অনেকখানি ঝুঁকিয়ে রেখেছিলেন। অভ্যন্তরীণ এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাগরসীমায় জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ভারত দখল করে নেয়। জিয়া ওই দখলদারীর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কাকতালীয়ভাবে ঠিক ওই দিনটিতেই এক চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া মাথায় নিয়ে ভারত প্রবাসী শেখ হাসিনা পা রাখেন বাংলাদেশের মাটিতে। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আওয়াজ তোলেন-‘বোন তোমায় কথা দিলাম মুজিব হত্যার বদলা নেব।'
হাসিনা দেশে ফেরার তেরো দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে খুন হয়ে যান জিয়া। আওয়ামী লীগের কেউ বা শেখ হাসিনাসহ তাদের দলের কেউ জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাসূচক কথা বলেনি। শেখ হাসিনা শহীদ জিয়াকে ‘অখ্যাত মেজর' বলে উপহাস করেছেন। বলেছেন বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দল। যদিও খালেদা জিয়া বা বিএনপির অন্য কেউ আজ পর্যন্ত শেখ মুজিব সম্পর্কে কোন অসম্মানসূচক রূঢ় মন্তব্য করেননি। জিয়াও কখনও শেখ মুজিবকে নিয়ে চটুল মন্তব্য করেননি। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads