রাশিয়ার অস্ত্রের গৌরবের কাল রুশ ফেডারেশনের পতনের পর শেষ হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে নিজের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য রাশিয়া একসময় বন্ধুত্বপূর্ণ দামে পৃথিবীতে তাদের মিত্রদেশগুলোতে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। রাশিয়ার ফেডারেশন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার সেই আধিপত্যবাদী মনোভাবের অবসান ঘটেছে। অস্ত্র বিক্রেতা দেশ হিসেবে রাশিয়ার অবস্থান অনেক আগেই বহু নিচে নেমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রুশ অস্ত্রের এত বড় ক্রয় চুক্তি পৃথিবীর কোনো দেশ করেছে বলে জানা নেই।
বাংলাদেশ কখনোই রাশিয়া থেকে এত বিপুল অঙ্কের টাকার অস্ত্র কেনেনি। এর আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বিপুল অঙ্কের দুর্নীতির মাধ্যমে রাশিয়া থেকে বাতিল মিগ-২৯ আমদানি করেছিল। তখন প্রশ্ন উঠেছিল যে, বাংলাদেশে মিগ-২৯-এর মতো দ্রুত গতির যুদ্ধবিমানের কী প্রয়োজন? যদি ওই মিগগুলো সঠিক থাকত, তাহলে তা উড্ডয়নের সাথে সাথেই ভারত কিংবা মিয়ানমারের সীমানায় পৌঁছে যেত। আর সেগুলো ওইসব দেশ নিরাপত্তার স্বার্থেই গুলি করে ভূপাতিত করে দিত। ভাগ্য ভালো সেসব বিমান কখনো ওড়েইনি এবং কয়েক মাসের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, বিমানগুলো অচল। আর বাংলাদেশেও এগুলো সম্ভবত পরে লোহালক্কড় হিসেবে তুলে এনেছে। তবে মিগ ক্রয়ের দালালি হিসেবে আওয়ামী সমর্থক এক ব্যবসায়ী যে পরিমাণ টাকা পেয়েছিলেন, সে টাকায় তিনি ঢাকায়ই পাঁচতারকা হোটেল দিয়েছেন। মিগ না উড়লেও তার ব্যবসায় রমরমা চলছে।
এবার এই আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্রচুক্তির পেছনে কোনো দালাল আছে কি না, সেটি এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির যুগে কিছুই অপ্রকাশিত থাকে না। যেমন থাকেনি পদ্মা সেতু দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ। যেমন প্রতিটি সাধারণ মানুষও জেনে গেছে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে আওয়ামীবান্ধব ব্যবসায়ীরা কিভাবে জনগণের পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে আওয়ামী-পছন্দ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের পকেট কেটে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে লুট করে নিয়েছে। এর কোনো কিছুই লুকানো থাকেনি। ফলে দেশে-বিদেশে এই সরকার লুটেরা-সরকার হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্বব্যাংকের সাথে টানাপড়েন চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে ভাটা। অথচ সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে তিনি বলতে কসুর করেননি যে, যুক্তরাষ্ট্রই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ষড়যন্ত্রের সে কাহিনী ভিন্ন। আজকের আলোচ্য বিষয় নয়।
বাংলাদেশ সাধারণত অস্ত্র সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশ থেকে। আর চীনও বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহকারীর কাতারে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রাশিয়া থেকে এই বিপুল টাকার অস্ত্র কেনার ফলে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে কী টানাপড়েন হবে, সেটি ভেবে দেখার অবকাশ সরকারের আছে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার আরো একটি দৃষ্টান্ত। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, তাঁবেদার জাতিসঙ্ঘ এবং ভারতের আশীর্বাদ ও সহায়তায় জেনারেল মইনের এক পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। কিন্তু পরে তিনি সে কথা আর মনে রাখতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, যেকোনো কারণেই হোক টিকিয়ে রাখতে পারেননি। ফলে ভিন্ন এক ব্লকের অনুসন্ধান করছেন শেখ হাসিনা। তিনি সম্ভবত চীন ও রাশিয়ার উদ্যোগে গঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) ব্লকের দিকে ছুটছেন।
এক দিক থেকে বিষয়টি খারাপ নয়। চীন-রাশিয়ার দীর্ঘকালের শত্রুতামূলক সম্পর্কের এখন অবসান ঘটেছে। মাওয়িস্ট, লেলিনিস্ট দ্বন্দ্ব এখন আর নেই। ফলে বহু ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়া আগের মতো মনোভাব পোষণ করে না। এই এসসিও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যাটোর বিপক্ষে নতুন জোট হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বড় প্রাথমিক অবস্থায় ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ সে দিকে ঝুঁকে পড়ে কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো, সেটিও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশের গার্মেন্টসামগ্রীর বড় ক্রেতা। সেটা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় সূত্রও বটে। কিন্তু যত দূর বোঝা যায়, সম্পর্ক এ অবস্থায় থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি গুরুতর সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। সে কথা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই গোপন রাখেনি। চীন ক্রেতা নয়। গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়া ক্রেতাও নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর নানা কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এখন বোধ করি খানিকটা রুষ্টই। তারা হয়তো চিন্তা করেনি যে, তাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনা তাদের সাথে এতটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করবেন। পাঁচ মাস ধরে চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেইক তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সময়ের অভাবে’ তাকে সময় দিতে পারেননি। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শেখ হাসিনার বার্তা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়েছে। যেসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ সরকারের মতভেদ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হলো, বাংলাদেশের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন আর ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের অসৌজন্যমূলক বিরাগ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এ অবস্থার সুযোগ নিতে চাইছে। বিশ্ব কূটনীতির এটাই ধারা। চীন মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ভারত তো মিয়ানমারের অবকাঠামোগত উন্নয়নে একেবারে যেচে সহায়তা করছে। ওয়াশিংটনের সাথে মিয়ানমার সরকারের বর্তমান মাখামাখিতে চীন যে ভেতরে ভেতরে খুব সন্তুষ্ট এমন কথা বলা যায় না। সে কারণে বাংলাদেশ চীনের কাছে অধিক আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বহু ইস্যুতে রাশিয়া ও চীন একযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষ অবলম্বন করছে। শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ওয়াশিংটনের শত্রুতার সুযোগ তারা নেবে না কেন?
বাংলাদেশ এখন প্রতিদিন ২০৪ কোটি কিউবিক ফিট গ্যাস উত্তোলন করে। যে চাহিদা আসলে ৩০০ ঘনফুটের। সম্প্রতি বাংলাদেশে ছয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রিজার্ভ পাওয়া গেছে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত এই গ্যাসের দাবিদার হয়েছে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। মিয়ানমার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দাবিদার। তারা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশকে প্রতিহত করতে সামরিক শক্তির প্রদর্শনও দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ওই গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। মিয়ানমারের সমরশক্তি চীননির্ভর। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্ভবত মিয়ানমারকে মোকাবেলায় বিকল্প পথের জন্য রাশিয়ার দিকে ঝুঁকল। এর সবই ধোঁকা কি না সেটা বলতে পারি না।
এসব কারণেই সম্ভবত সরকার টিকে থাকার ভিন্ন চিন্তায় মনোযোগী হয়েছে। এর মাত্র মাসখানেক আগে ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৪৪টি চীনা এমবিটি-২০০০ ট্যাংক কিনেছে বাংলাদেশ। তার পরই এই দরিদ্র দেশের ১০০ কোটি ডলার খরচ করে রাশিয়ার অস্ত্র কেনার চুক্তি করলেন শেখ হাসিনা। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে সশস্ত্র যানবাহন, যুদ্ধক্ষেত্রের সরঞ্জাম, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং এমআই-১৭ পরিবহন হেলিকপ্টার। এ সরকার আবার মস্কো থেকে আটটি মিগ-২৯ বিমান কেনার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দুই স্কোয়াড্রন এফসি-১/জেএফ-১৭ এবং এফসি-২০/জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে এর সব কিছুই ভাঁওতাবাজি বা ধোঁকাবাজি কি না, তা নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞ মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটি নির্বাচন পূর্ববর্তী সরকারের একটি স্টান্ট ছাড়া আর কিছু না হয়। সামরিক বাহিনীকে খুশি করতে সরকার এসব ব্যবস্থা নিয়ে থাকতে পারে। বিরোধী দলের আন্দোলনে অচল অবস্থা সৃষ্টি হলেও সামরিক বাহিনী যাতে শেখ হাসিনা পক্ষে থাকে সেই লক্ষ্যেই হয়তো এসব চুক্তি করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন এক গাদা অর্থহীন কারণে দেশের এই বিপুল অর্থের অঙ্ক অপচয় করা হচ্ছে।
এই নিবন্ধে আমরা যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলাম, যেসব যুক্তি উপস্থাপন করলাম, তার কোনোটাই সরকারের তরফ থেকে বলা হয়নি। সরকার সব সময় বলে আমরা কলাম লেখকেরা, সাংবাদিকেরা আর টিভির টকশোর আলোচকেরা সরকারের খারাপ দিকগুলোই দেখি। ভালো কিছু দেখতে পাই না। ভালো দিকও দেখালাম। দেখি, সরকার এসব যুক্তি পরিষ্কার করে কি না। নাকি আগের আমলের মিগ-২৯ ক্রয়ের মতো পুরো বিষয়টাই ধোঁকায় পরিণত হয়।।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন