বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের যখন মাত্র এক বছর বাকি এবং নবম সংসদের উপনেতা যখন ঘোষণাও দিয়েছেন যে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সব মহলের আশাবাদ বিচূর্ণ করে তিনি সরকারের পরিকল্পিত নির্বাচনপদ্ধতি অর্থাৎ তাদেরই সরকারের অধীনে তা হওয়ার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য এ আশঙ্কা জনমনে আগে থেকেই ছিল। সরকার তো আর সাধে বিগত বছরগুলোতে সংবিধান সংশোধনসহ একটি নির্বাচন বিজয়ে সক্ষম প্রশাসন সাজায়নি। এই লক্ষ্যে তাদের প্রস্তুতি এখনো অব্যাহত আছে। সব সরকারই শেষ বেলায় এমনই করে থাকে ক্ষমতা পুনর্দখলে। কেউ কেউ তাতে সাফল্য পায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবু আশার ছলনায় ক্ষমতালোলুপরা এতে প্রবৃত্ত হয়।
আওয়ামী লীগের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন আছে, যাতে আওয়ামীরা ছাড়া অন্যরা বিশ্বাসী নয়। কিন্তু দেশে তো অন্য লোকেরাও জন্মসূত্রে বাস করে এবং তাদেরও নিজ নিজ মত, পথ ও বিশ্বাস আছে, যা নিয়ে তাদের আওয়ামীদের সাথে সহাবস্থানে আপত্তি নেই। তারা এখন কী করবে? তারা কি আওয়ামী অপপ্রয়াসের কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের রাজনৈতিক হারাফিরি নিশ্চিত করবে? না, তাদের লালিত বিশ্বাসের তাগিদে প্রয়োজনে ‘কামিকাজে’ অপারেশনে লিপ্ত হবে? আওয়ামীদের থেকে ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য এটাই এখন সমস্যা। তবে এ পর্যন্ত তারা একটি বিষয় যথেষ্টভাবেই পরিষ্কার করেছে যে, কোনোভাবেই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতিরেকে নির্বাচনে যাবে না তা শুধু নয় আন্দোলন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচন হতেও দেবে না।
আওয়ামী লীগকে যারা কিঞ্চিতও জানেন তাদের না জানার কথা নয় যে, লক্ষ্য অর্জনে তারা যেকোনো সীমায় পৌঁছতে দ্বিধা করে না। লগি-বৈঠার কথা মনে আছে তো? কিন্তু অন্যের আন্দোলনকে প্রতিহত (নো ভণ্ডুল) করার উন্মত্ততায় তারা ‘বিশ্বজিৎ’ ঘটাতে পারে, পাঁচ কোটি টাকার লেনদেনে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে রহস্যজনকভাবে মুক্তি দিতে পারে। যদি একটি পাতানো নির্বাচনের জন্য বৈধতা পেতে আওয়ামীরা কিছু তাদের সৃষ্ট একটি তৃতীয় শক্তি বানিয়ে ফেলে কেউ তাদের ঠেকাতে পারবেন না।
একটাই শুধু আশার কথা যে, দল আর দেশ এক নয়, ব্যক্তি আর দেশ ভিন্ন সত্তা, পরিবার ও দেশ দুই মেরুতে অবস্থিত। পাতানো নির্বাচন করে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি আওয়ামীরা কেন, তাদের মুরব্বিরাও সামলাতে পারবে না। তাই দেশের কিছু হিতাকাক্সী মানুষ দুই প্রধান দলের মধ্যে আপস নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলেন। সেখানেও আওয়ামীদের আপত্তি। তারা এমন এমন শর্ত আরোপ করেন বা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যা কোনোক্রমেই আপস নিষ্পত্তির অনুকূল। একটার পর একটা রূঢ় বক্তব্য দিয়ে বা পদক্ষেপ নিয়ে এমন উদ্যোগকে তারা চুপসে যেতে বাধ্য করেন।
এ মুহূর্তে দেশব্যাপী দমননীতি চলছে, হাজার হাজার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে পারস্পরিক আস্থাহীনতাই বৃদ্ধি পাবে, আপস-নিষ্পত্তি তো দূরের কথা। গ্রেফতার এড়াতে অনেক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীই এখন আত্মগোপনে। ফলে প্রাক-আলোচনা কোনো পারস্পরিক সংযোগও এ অবস্থায় সম্ভব নয়। জানা যায় যে, রিমান্ডে অভিযুক্তরা কঠিন সময় পার করছেন, তাদের গোয়েন্দারা নাকি কৌশলী নিপীড়নে অসহায় করে রেখেছেন। এরপর আছে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য। এসব প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগপন্থীরাও একসময় গিয়েছেন। তাদের চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে যে এগুলোর দীর্ঘ স্থায়ী বিষক্রিয়া রাজনীতিকে কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ করতে পারে। অনেক আবেদন নিবেদনের পরেও বিরোধীদলীয় স্তম্ভস্বরূপ মির্জা ফখরুলের এখনো জামিন হয়নি। উপরন্তু এখন তো বরং শোনা যায় বেগম খালেদা জিয়ারই গ্রেফতার হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। এক-এগারোর সরকারের হাতে উভয় নেত্রীর গ্রেফতারের ঘটনা ছাড়া স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর কোনো একজনকে গ্রেফতারের চিন্তা কেউ কখনো করেনি। আল্লাহ না করুন এমন কিছু হলে তখন আর রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো পথ খোলা থাকবে না।
যেকোনো সমস্যাসঙ্কুল দেশে আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে সব সময়ই কোনো পক্ষের কাছে বন্দী কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক থাকলে প্রথমেই তার মুক্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়, কিছু Pleasantry বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে আমরা এ পর্যন্ত কুৎসা বিনিময়ই দেখছি। এই সেদিনও যশোরের এক জনসভায় খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে নিয়ে ‘তেল দেওয়ার’ যে ভাষা ব্যবহার করলেন তাতে দেশবাসীকে লজ্জায় অধোবদন হতে হয়। একজন শীর্ষ নেত্রী যিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার মুখ থেকে এমন অভিব্যক্তি শোভা পায়! বঙ্গবন্ধু, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর এন্তার বক্তৃতা শুনেছি, কিন্তু কদাচিৎ তাদের শব্দ চয়নে কুরুচির পরিচয় মিলেছে।
রাজনীতিতে এ এক অদ্ভুত রসায়ন যে ক্ষমতাসীন একজন শীর্ষ নেত্রীর এ দেশের আধুনিক সংস্করণের রূপকার একজন প্রথমসারির মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারণে অনীহা। পাঠকরা খেয়াল করে শুনবেন জিয়াউর রহমান তার অভিব্যক্তিতে ‘ওনার স্বামী’। তাতে তো কোনো সংশয় নেই, কিন্তু জিয়ার প্রসঙ্গ এলে তার নাম উচ্চারণে দোষ কী। এমনই যখন দেশের রাজনৈতিক আবহ, সেখানে আমাদের ‘সংলাপবাদী’রা হন্যে হয়ে সংলাপের মহত্ত্ব তুলে ধরতে ব্যতিব্যস্ত But no taken.
অথচ দুই নেত্রীকে মুখোমুখি হতেই হবে, উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপদ্ধতি উদ্ভাবন করতেই হবে, প্রয়োজনে এই ইস্যুতে রেফারেন্ডামে যেতে হবে। কিন্তু আমরা কিছুতেই একটি পাতানো নির্বাচনের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে একটি দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতায় ফেলতে পারি না। সেই অবস্থায় প্রিয় জন্মভূমিকে বহির্বিশ্বের দাবার ঘুঁটি হতে দিতে পারি না।
এই দেশ অবশ্যই শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পত্তি নয়, একইভাবে তা খালেদা জিয়ারও পারিবারিক জোতদারি নয়। এ দেশের মালিক ষোলো কোটি জনগণ। তাদের একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে’ খেলতে দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করুন যে তারা কী চায়? তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধিদেরই অধিকার এ দেশ পরিচালনার। তার স্থলে অন্য যেকোনো কিছু এ দেশে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন