পুলিশ, র্যাব প্রভৃতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্তব্য আর দায়িত্ব এদের বর্ণনার মধ্যেই আছে। এরা চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, ছিনতাই, খুন ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধ করবে, দুষ্কৃতকারীকে শাস্তি দেবে। অন্তত তাই হওয়া উচিত, যদিও বর্তমান বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। বহু ক্ষেত্রে বিপরীতটাও হয়ে থাকে। পুলিশের পোশাক পরে যদি কেউ দুষ্কর্ম করে, তাহলে সেটা ডাবল গুরুতর অপরাধ। একে তো দুষ্কর্ম, তার ওপর আবার জনসাধারণকে প্রতারণা এবং পুলিশকে দুর্নাম দেয়ার চেষ্টা।
এ-জাতীয় ঘটনা পৃথিবীর আরো কোনো কোনো দেশেও ঘটেছে। বিশেষ করে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে শিকাগো এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরো কোনো কোনো শহরে মাফিয়ারা পুলিশের ছদ্মবেশে খুনখারাবি করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেসব দুষ্কৃতকারীকে দমন করেছে। বাংলাদেশে পুলিশ, র্যাব প্রভৃতি তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ঘুষ, চোরাচালান ইত্যাদিসহ ছোটখাটো দুষ্কৃত ছাড়াও বর্তমান সরকারের নির্দেশে কিংবা প্রশ্রয়ে যে ছিনতাই ও হত্যাসহ বহু দুষ্কৃত করছে, সে অভিযোগ জোরালো। জনগণও তেমনটিই মনে করে।
সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক মতামত স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে নির্যাতন-নিপীড়ন গত চার বছরের বাংলাদেশে পুলিশ ও র্যাবের (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চার বছরে র্যাব সন্ত্রাসী, বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে কয়েক শ’ লোককে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং শেষ পর্যন্ত সরকারগুলো তুমুল প্রতিবাদ তুলেছে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার। হয়তো সে কারণেই ‘ক্রসফায়ার’ হত্যা কিছু কমেছে, কিন্তু সে স্থলে শুরু হয়েছে অন্য এক রকমের ভয়াবহ উৎপাত। জ্বলজ্যান্ত মানুষগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। পরে কখনো কোথাও কারো হাত-পা বাঁধা লাশ ভেসে উঠছে রাজধানীর কাছাকাছি কোনো নদীতে। কারো বা কঙ্কাল আবিষ্কার হচ্ছে কোনো নালা বা জলাভূমিতে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকগুলোর আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ধরনের প্রতিপক্ষকে গুম করার পদ্ধতি প্রথম লক্ষ করা যায় ত্রিশের দশকে হিটলারের জার্মানি আর মুসোলিনির ইতালিতে। পরবর্তীকালে চিলিতে ১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট পিনোশের আমলে। চিলিতে হাজার হাজার মানুষকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আর কখনো তাদের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। বহু বছর ধরে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে বন্দীদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হেলিকপ্টার কিংবা বিমান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাজকর্ম প্রায় ফ্যাসিস্টদের অনুকরণ বলে মনে হয়। সুতরাং গুম আর খুনের ঘটনাগুলোতে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের গন্ধ পাওয়া স্বাভাবিক।
এই গুম-খুনের ঘটনাগুলো প্রথম মিডিয়ার নজরে আসে আড়াই বছর আগে। ঢাকা মেট্রোপলিটন করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপিদলীয় জনপ্রিয় কমিশনার চৌধুরী আলমকে কয়েকজন লোক নিয়ে যায়। তার পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার পর থেকে এ যাবৎ গুম-খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা দুই শ’ ছাড়িয়ে গেছে। ক্রসফায়ারের ব্যাপারে যেমনটা লক্ষ করা গিয়েছিল, নিহতরা সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কর্মী এবং সরকারের বিরুদ্ধপক্ষীয়। এ-জাতীয় মহা দুষ্কৃত সাধারণত রাতের আঁধারে কিংবা লোকচুর অন্তরালেই ঘটে থাকে। কিন্তু কতগুলো ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের কিছু প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এবং তারা সবাই দুষ্কৃতকারীদের র্যাবের সদস্য বলে শনাক্ত করেছেন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সাভারে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রকে বাস থেকে নামিয়ে নেয়া হয়। বাসভর্তি যাত্রী ঘটনাটি দেখেছেন। সবাই বলেছেন যে, ছিনতাইকারীরা র্যাবের ইউনিফর্ম পরা ছিল, র্যাবের সরকারি যানে তারা এসেছিল এবং যাত্রীদের চ্যালেঞ্জের জবাবে তারা বলে যে তারা র্যাবের লোক, কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা ওই দু’জন ছাত্রকে নিয়ে যাচ্ছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু আজ অবধি সেই দুই ছাত্রের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। র্যাব সম্প্রতি বলেছে, সে ঘটনা সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না। তাদের তরফ থেকে আরো বলা হয় যে, সন্ত্রাসীরা র্যাবের অনুকরণে ইউনিফর্ম পরে সেই দুষ্কৃত করেছে।
গত বছরের এপ্রিল মাসে গুম হয়ে যান বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট বিএনপির সভাপতি ইলিয়াস আলী। রাতের বেলায় নিজের গাড়িতে বনানীর মূল সড়ক ধরে যাচ্ছিলেন তিনি। কয়েকজন লোক গাড়ি থামিয়ে এবং টেনে-হিঁচড়ে তাকে ও তার ড্রাইভারকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরো বহু দেশ ইলিয়াস আলীর মুক্তি দাবি করেছে কিন্তু তিনি ও তার ড্রাইভারের কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। দু’জন লোক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেছেন। তারা উভয়েই বলেছেন ছিনতাইকারীরা র্যাবের ইউনিফর্ম পরা ও র্যাবের নাম লেখা গাড়িতে এসেছিল। র্যাব এ ঘটনায়ও তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। শুধু তা-ই নয়, খোঁজ পেয়ে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের অভিযানের নাম করে তার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুর পরিহাস করেছে।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার ৪ জানুয়ারি। রাজধানীর সেই ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডেরই অত্যন্ত জনপ্রিয় বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদার ঝিনাইদহের শৈলকূপায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। শুক্রবার কয়েকজন লোক সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের পরনে ছিল র্যাবের ইউনিফরম এবং যে সাদা মাইক্রোবাসে তারা এসেছিল, তাতে র্যাবের স্টিকার লাগানো ছিল। তারাও নিজেদের র্যাবের লোক বলে দাবি করেছিল। পরদিন শনিবার কুষ্টিয়া জেলার আদাবাড়িয়া গ্রামের মাঠ থেকে দুই হাতে পুলিশের হাতকড়ার মতো এবং পুলিশ কথাটা লেখা হাতকড়া পরা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়।
অবস্থাগত প্রমাণ
র্যাব এসব দুষ্কৃতের দায়দায়িত্ব স্বীকার করবে বলে কেউ আশা করে না। কিন্তু আইনের চোখে সারকামস্ট্যানশিয়্যাল এভিডেন্স (অবস্থাগত প্রমাণ) বলে একটা কথা আছে এবং ন্যায্য ও নিরপেক্ষ বিচারে সেসব প্রমাণ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। বর্তমান ক্ষেত্রে এ-জাতীয় প্রমাণ ভূরি ভূরি। প্রথমত, ছিনতাই ও হত্যা প্রাণদণ্ডের উপযোগী গুরুতর অপরাধ। পুলিশ ও র্যাব সেসব দমনে ব্যর্থ হচ্ছে, এমনকি চেষ্টা করছে বলেও কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, বছরের পর বছর ধরে র্যাবের ইউনিফর্ম পরা, র্যাবের সরকারি যানবাহনের অনুরূপ যানবাহন ব্যবহারকারী লোকেরা নিজেদের র্যাবের লোক দাবি করে অন্যদের চোখের সামনে থেকে মানুষকে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই দুষ্কৃতকারীদের ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার ও দলন করতে র্যাব কোথাও চেষ্টা করছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দেশে ও বিদেশে এ-জাতীয় দুষ্কর্মে র্যাবের দুর্নামের বোঝা যে বেড়েই চলেছে, সেটা বন্ধের চেষ্টা করা কি র্যাবের জন্য স্বাভাবিক ছিল না?
রফিকুল ইসলাম মজুমদারের ক্ষেত্রে র্যাবের ইউনিফর্ম ও মাইক্রোবাসের ওপরেও পুলিশ লেখা ও পুলিশের হাতকড়ার মতো হাতকড়া লাশের হাতে লাগানো ছিল। এতগুলো যোগাযোগ ঘটনাচক্রে ঘটেছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তা ছাড়াও যে মানুষগুলো গুম, হয়তো বা খুনও হচ্ছেনÑ তারা সবাই সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী কিংবা সমালোচক ছিলেন। রাজনীতির অঙ্গন এবং সেই সঙ্গে ধরাতল থেকে তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় বর্তমান সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো উপকৃত হওয়ার কথা নয়। আরো একটি ব্যাপার। বর্তমান সরকার যেকোনো উপায়ে গদি আঁকড়ে থাকার জন্য হত্যা-নির্যাতন, জেল-জুলুমসহ বহু নিপীড়ক ব্যবস্থা যে নিচ্ছে সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং এ সন্দেহও স্বাভাবিক যে গুম-খুনের ঘটনাগুলো র্যাব কিংবা সরকারের অন্য কোনো হাতিয়ার সংস্থার মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে।
গুম-খুনসহ বহু হত্যা-দুষ্কৃতের সঙ্গে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জড়িত বলেই সর্বসাধারণের সন্দেহ। অন্য দিকে দেশে চুরি-ডাকাতি-খুনের ঘটনা হু-হু করে বেড়ে চলেছে। দুষ্কৃতকারীরা জানে পুলিশ ও র্যাবের মনোযোগ অন্য দিকে, সুতরাং তাদের ভয়ের কিছু নেই। এক বছর হতে চলল সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নিজেদের শোবার ঘরে নিহত হয়েছেন। সরকারের দু’জন গুণধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘাতকদের গ্রেফতারের বহু প্রগলভ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো কয়েকজনকে খুনি বলে গ্রেফতারও করিয়েছেন। এরাই যে প্রকৃত খুনি সেটা কেউই বিশ্বাস করেনি। এখন আমেরিকা থেকে পাওয়া রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া ডিএনএ স্পেসিমেনের সাথে আটক ব্যক্তিদের কোনো মিল নেই। সর্বসাধারণের পুরনো বিশ্বাসই আরো দৃঢ় হলো যে বিনা টেন্ডারে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কন্ট্রাক্ট দিয়ে যে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, সেটা ঢাকার চেষ্টায় সরকারই রুনি ও সাগরের খুনিদের আড়াল করে রাখছে।
আকাশে থুথু ফেলা, কাচের ঘরবাসীর ঢিল ছোড়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্র সে দিন দুর্নীতি ও খুনবিরোধী বিএনপি দলের গুণ বলে পরিহাস করেছেন। কিন্তু বিগত চার বছরে বাংলাদেশে যে-সংখ্যক খুন আর যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, এ দেশের ইতিহাসের বাকি ৩৭ বছরের মোট হিসাবেও ততটা হয়নি। এবং প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আলামত সরকারের দিকেই ঝুঁকছে। এ সরকার যে দুর্নীতির রানী-মহারানী মাত্র একটা ব্যাপার বিশ্লেষণ করলেই সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। ব্যাপারটা হলো দুই আবুলÑ সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আরো আগের সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ঠেকিয়ে রাখতে সরকার প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
রেল বিভাগে বিনিময়-বাণিজ্যের ব্যাপকতা, গভীর রাতে মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকার স্তূপ ইত্যাদি ঘটনার পর দুর্নীতির অভিযোগের চাপে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না যেতেই রাতের আঁধারে পেছনের দরোজা দিয়ে আবার তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হলো। কিন্তু কেন? দেশে ও বিদেশে সবাই এ সন্দেহ করতে বাধ্য যে, দুর্নীতির অর্থের বখরা আরো ওপরেও যাচ্ছিল এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদেরও বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা হলে ‘ওপরওয়ালাদের ফেঁসে যাবার ভয় আছে’। ভেবেচিন্তে কথা বলেন বলে শেখ হাসিনার সুনাম নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চোর ও চোরের মা ইত্যাদি অপবাদের তোপ দেখে তিনি নিজের অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং বাকি বিশ্ব যে তার সরকারকে মহাচোর বলছে এবং কানাডার পুলিশ যে সে দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে, সে দিকে যেন তার খেয়ালই ছিল না। দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ হিতোপদেশের গুরুত্ব সম্ভবত শেখ হাসিনা উপলব্ধি করতে পারেননি। একটা হচ্ছে, ‘আকাশের দিকে থু থু ফেলতে নেই’। অন্যটা ‘যারা কাচের ঘরে বাস করে তাদের ঢিল ছুড়তে নেই’।
serajurrahman24@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন