মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৩

দেখামাত্র গুলির নির্দেশ


আলফাজ আনাম

সামরিক সরকারের সময়ে সভা-সমাবেশ বা সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতে কারফিউ জারি বা সান্ধ্য আইন জারি করে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হতো। আবার দেশের কোথাও গোলযোগ সৃষ্টি হলে বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নষ্ট করা হলে পুলিশ গুলি করতে পারে। তবে অবশ্যই পুলিশের সাথে ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে। পুলিশ গুলি করবে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া গুলি করার নির্দেশ দিতে পারেন না। আইন তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে উঠে অথবা নিজেরাই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন শিবির দেখামাত্র গুলি করার।
রাজধানীতে সোমবার ছাত্রশিবিরের মিছিলে বাধা দেয়াকে কেন্দ্র করে শিবির ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ কমিশনার হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান। একজন পুলিশ সদস্যের খোঁজখবর নেয়ার পর তিনি তাকে বলেনÑ অস্ত্র ছিল না? গুলি করতে পারোনি? এখন থেকে শিবির দেখামাত্র গুলি করবা। এরপর তিনি পায়ে আঘাত পাওয়া আরেক কনস্টেবলকে দেখতে গিয়ে বলেনÑ পায়ের আঘাত সুস্থ হয়ে ওদের পা ভেঙে দিবা।
শিবিরের মিছিলে বাধা দেয়ার পর জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরের যেসব ঘটনা ঘটেছে নিঃসন্দেহে ফৌজদারি অপরাধ। যারা এসব কাজের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ জন্য তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি হবে। কিন্তু এ জন্য পুলিশ কর্মকর্তা গুলির নির্দেশ দিতে পারেন না। মতিঝিলে শিবিরের মিছিলে শত শত নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন। মিছিল-সমাবেশে সাধারণ মানুষও থাকেন। কারো গায়ে শিবির লেখা থাকে না। পুলিশ কমিশনারের কথায় যদি পুলিশ এভাবে গুলি চালায় তাহলে শুধু শিবির নয়, সাধারণ মানুষও মারা যেতে পারে। এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? আমরা এই সংঘর্ষের সময় পুলিশের নির্মমতার চিত্রও দেখেছি। সচিবালয়ের সামনে একজন শিবিরকর্মী দৌড়ে পালানোর সময় পড়ে গেলে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে ঘিরে ধরে লাথি, ঘুষি ও মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে। পরে একটি সিএনজি ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অথচ আহত এই শিবিরকর্মীকে পুলিশ সহজেই ধরে নিয়ে যেতে পারত। এই শিবিরকর্মী গাড়ি ভাঙচুর বা আগুন দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। আইনে তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু পুলিশ তাকে মেরে রক্তাক্ত করার কোনো অধিকার নেই। পুলিশ এই ছাত্রটিকে মেরে নিজে আইন হাতে তুলে নিয়েছে। এর মাধ্যমে পুলিশ নিজেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।
পুলিশ বিভাগের সবাই জানেন, ঢাকার পুলিশ কমিশনার পুলিশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি; আইজির চেয়েও ক্ষমতাবান। আইজি নিজেও আহত পুলিশ কর্মকর্তাদের দেখতে গেছেন। সেখানে তিনি আইনি ভাষায় কথা বলেছেন। যারা এসবের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু মহানগর পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের মধ্যে ছিল প্রতিশোধস্পৃহা। পুলিশের পোশাক পরেও সম্ভবত ছাত্ররাজনীতির ক্যাডারের ভূমিকায় থাকার সময়ের কথা তিনি ভুলতে পারেননি। ছাত্রলীগের নেতারা কর্মীদের যেভাবে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের ওপর হামলার নির্দেশ দেন, তিনিও একই ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু পুলিশ কমিশনার নয়, আরো অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখন রাজনৈতিক ভাষায় বক্তব্য রাখছেন। ঢাকার একজন উপপুলিশ কমিশনার টেলিভিশনের সামনে নিয়মিত হাজির হয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছেন। এই পুলিশ কমিশনারকে আদালত থেকে শাস্তিমূলক বদলি করার নির্দেশ দেয়া হলেও সরকার তার পক্ষ নিয়ে আদালতের নির্দেশ স্থগিত করে পদোন্নতি দিয়ে বিরোধী দল দমনের কাজে নিয়োজিত করেছে। ছাত্রজীবনে এসব কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছেন। এখন পুলিশের পোশাক পরে একই কাজ করতে চাইছেন। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এসব পুলিশ কর্মকর্তাকে সেভাবেই দেখছে। এসব পুলিশ কর্মকর্তা যদি রাজনীতি করতে চান করতে পারেন, তবে তাদের পুলিশের পোশাক আগে ছাড়তে হবে। পুলিশের পোশাক পরে রাজনীতি করার আইনগত কোনো অধিকার তাদের নেই।
পুলিশ বাহিনীকে প্রকৃতপক্ষে এখন দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডারদের এখন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দিয়ে রাজনীতি দমনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা পুলিশ হিসেবে নয়, দলীয় আনুগত্যের কারণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন। সম্প্রতি পুলিশের ডিসি হারুনকে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়ার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর কারণে তাকে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে তিনি তার অবস্থানে অনড় থেকে জানান, তার এই সিদ্ধান্ত নাকি সাহসী সিদ্ধান্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সাহসের প্রতিফলন দেখাচ্ছে পুলিশ রাজপথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে বা ধরে নিয়ে গিয়ে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিটি নেতিবাচক কাজের প্রতিক্রিয়া আছে। একটি বিড়ালকে যদি ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়, এক সময় ঘরের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। বিরোধী দলকে ঘরে আবদ্ধ রাখার চেষ্টার প্রতিক্রিয়া এখন দেখা যাচ্ছে। পুলিশ দিয়ে রাজনৈতিক দল দমনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এখন আমরা দেখছি।
পুলিশের মধ্যে এখন এই ধারণা কাজ করছে, সুযোগ সুবিধা ও পদোন্নতির সহজ উপায় হচ্ছে বিশেষ দলের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজধানীতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে কতখানি টলারেন্স দেখানো হবে তার সিদ্ধান্ত নেবেন সরকারের মন্ত্রী। ক্ষমতাসীন দল সিদ্ধান্ত নেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে তারা কিভাবে মোকাবিলা করবেন। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেন কোন রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে কী আচরণ করা হবে? পুলিশ কর্মকর্তাদের সভায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে কিছু দলবাজ কর্মকর্তা পুরো পুলিশ বিভাগকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক শাখায় পরিণত করেছে। জামায়াত-শিবিরকে মোকাবেলা করার জন্য এর আগে যুবলীগ-ছাত্রলীগের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু সে আহ্বানে তারা সাড়া দেয়নি। এখন পুলিশ নিজেই রাজনৈতিক দলকে মোকাবেলা করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। যাদের মোকাবেলার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারাও এখন পুলিশকে মোকাবেলা করছে। এর ফল হিসেবে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ তাদের মোকাবেলা করতে কখনো কখনো ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতার জন্য আবার তারা সরকারি দলের সমালোচনার মুখে পড়ছেন।
প্রকৃতপক্ষে পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের ঠ্যাংগাড়ে বাহিনীতে পরিণত করার ফলে এই বাহিনী এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। পুলিশে বিশেষ দুই জেলার নাগরিকদের গণহারে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সংবাদপত্রে খবর এসেছে, মহাজোট সরকারের চার বছরের শাসনামলে পুলিশ বিভাগে ৩২ হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ আছেন আট হাজার আর কিশোরগঞ্জের সাত হাজার। রাজধানীতে কর্মরত বেশির ভাগ পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ি এই দুই জেলায়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারও আছেন। এভাবে পুলিশকে দলীয় ও আঞ্চলিক বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে।
সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুলিশ অপরাধ দমনের মতো পেশাদারি কাজ বাদ দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পর কয়েক দিন তারা নিখোঁজ থাকছেন। এরপর যখন তাদের আদালতে নেয়া হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে তিনি হাঁটতে পারছেন না । হাত বা পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। শরীরে অত্যাচার-নির্যাতনের চিহ্ন। পুলিশ কোন আইন বলে এভাবে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির না করে নির্যাতন চালাচ্ছে? এসব অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পুলিশের ওপর আরো ক্ষুব্ধ করে তুলছে।
ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনে যেসব দাবি করা হয়েছে তার মধ্যে একটি দাবি ছিল, সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক আবু সালেহ ইয়াহইয়ার ওপর নির্যাতন বন্ধ করা। ছাত্রশিবিরের এই নেতাকে গ্রেফতারের পর কয়েক দিন তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পরে তাকে আদালতে এনে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। এর আগেও শিবির অভিযোগ করেছে, গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের পুলিশ হেফাজতে নানাভাবে নির্যাতন করে হাত-পা ভেঙে দেয়া বা পায়ের নখ ও চোখ তুলে নেয়ার মতো নৃশংসতা চালানো হয়েছে। পুলিশ এসব অভিযোগের ব্যাপারে নীরব থেকেছে।
শিবিরের মিছিল থেকে এই সহিংস আচরণের দায় সরকারকেও নিতে হবে। সরকারকে এই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে, জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্রশিবির  কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। সভা-সমাবেশ করার অধিকার  হরণ করার ফলে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল-সমাবেশ করতে গিয়ে তারা এখন সহিংস আচরণ করছে। জামায়াত বা শিবির হঠাৎ করে জন্ম নেয়া কোনো সংগঠন নয়। এর আগে তারা সভা-সমাবেশ ও মিছিল করেছে। কিন্তু তখন ভাঙচুর বা জ্বালাও-পোড়াওয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের সাথে সংঘর্ষও হয়নি। পুলিশ মিছিল-সমাবেশ বাধা দেয়ার পর থেকে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সরকার যদি মনে করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার আন্দোলন করছে, এই অভিযোগ এনে জামায়াত-শিবিরকে পুলিশ দিয়ে দমন করা যাবে তা ভুল সিদ্ধান্ত। শিবিরের মিছিলে যে শত শত ছাত্র অংশ নিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের অন্তত ২০ বছর পরে তাদের জন্ম। তারা বুঝে-শুনেই সংগঠিত ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। ছাত্রলীগের মতো টেন্ডারবাজি করে অর্থ কামানো তাদের ছাত্ররাজনীতির মূল লক্ষ্য নয়। এই তরুণদের আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে নিপীড়ন চালিয়ে তাদের দমন করা যাবে না। সরকারের উচিত জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা, তাদের সভা-সমাবেশের অধিকার দেয়া। না হলে এ ধরনের সহিংসতা আরো বাড়তে থাকবে। অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ সরকারের জন্য বুমেরাং হবে।
alfazanambd@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads