সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

দেশ এখন ফরমালিনের কারাগারে বন্দী


আরিফুর রহমান খাদেম


এক সময় প্রায় শুনতাম বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পা রাখতেই মানুষ পেট খারাপসহ নানাবিধ সমস্যায় ভোগা শুরু করত। এখন এর উল্টোটাও বেশ শোনা যাচ্ছে। অর্থাত্ বাংলাদেশ থেকে উন্নত দেশে আসার পর অনেকেই সেখানকার খাবার হজম করতে পারে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশে ভেজাল খাদ্য আহার করতে করতে পাকস্থলীসহ শরীরের পুরো সিস্টেম এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে অনেকের পেটে বিশুদ্ধ খাবার আর সইছে না। যা খায় বা পান করা হয় তাতেই বদহজম লক্ষণীয়। সিডনির কিছু কিছু অভিজ্ঞ ডাক্তারও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অথচ আমি মনে করতে পারছি না আমার অস্ট্রেলিয়ায় কবে বদ হজম হয়েছিল।
কোনো এককালে খাঁটি মধু পাওয়ার আশায় মধু সংগ্রহকারীর পিছু নিতাম এবং ওঁত্ পেতে থাকতাম যাতে মধু সংগ্রহকারী চিনি মিশিয়ে আমাদের কাছে মধু বিক্রি করতে না পারে। সেজন্য গাছ থেকে মাটিতে পা রাখার আগেই দরদাম ও পরিমাণ ঠিক করে নিতাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ওই মধু ব্যবসায়ীরা এক সময় তাদের কুকর্মে সফলতা লাভে মৌচাকে যাত্রার প্রাক্কালেই গোপনে চিনির শিরা বা লালি সঙ্গে নিয়ে গাছে উঠত, যাতে গাছ থেকে মধুসহ নামার পর কেউ ভেজাল বলতে না পারে। দিনের পর দিন মানুষ দুধ ব্যবসায়ীদের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে গ্রামের অনেক সচেতন ক্রেতা দুধ দোহনের সময় উপস্থিত হতেন যাতে গোয়ালা বা গোয়ালিনী দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করতে না পারেন।
যুগের পর যুগ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে গেছে। ভালোটি গ্রহণ করা ও মন্দ জিনিসটি বর্জন করা শিখেছে। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও গত দু-তিন যুগের চেয়ে সাম্প্রতিককালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার কয়েক গুণ বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালাতে পারেনি। আমরা ভালো জিনিসের সুফল ভোগ না করে কুফল ভোগেই বেশি আসক্ত হয়ে পড়ি। দেশে মানুষের জীবন ক্রমেই বিষময় হয়ে উঠছে। মানুষ জেনেশুনে বাধ্য হয়েই বিষযুক্ত খাবার নিয়মিত ভক্ষণ করছে। গত বছর দেশে গিয়ে নিকটাত্মীয়দের অনেকের ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে বেশ মর্মাহত হয়েছি। প্রায় সবার মধ্যেই লক্ষ্য করেছি এক ভয়ানক শারীরিক ও মানসিক অবক্ষয় ও বিভিন্ন রকমের ব্যাধি। স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করতেই অনেকে অকপটে বলে ফেললেন, ‘আমরা কী খাই দেখতে হবে না? যা খাই এর প্রায় পুরোটাই ভেজাল। বেঁচে আছি এটাই অনেক বড় ব্যাপার।’ ত্রিশ-চল্লিশ বছরের অনেককেই দেখতে মনে হয়েছে তারা প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটের কোটায় পা রেখেছেন।
দু-তিন বছর আগেও মানুষ ফরমালিনযুক্ত ও ফরমালিনমুক্ত খাবার যাচাই করে কিনতে পারত। কিন্তু গত বছর দেশে গিয়ে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করলাম। বিশেষ করে, যে কোনো ধরনের ফল ও মাছ মানুষ জেনেশুনেই কিনছে। ফল কেনার আগে দোকানদারদের ফরমালিনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বোকা বনে গেলাম। কেউ কেউ মুচকি হাসি হেসে বলেও দিলেন, ‘এহন কি স্যার ফরমালিন ছাড়া আর কোনো মাল পাইবেন?’ অর্থাত্ এ ব্যাপারে দোকানিদের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাও অনেকটা অবান্তর। আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন অনেকেই আছেন যারা বাংলাদেশে কোনো ফল কিনে খান না। এমনকি আজ-কাল দেশের টিভি নাটকেও বিভিন্ন সংলাপে শোনা যায়, দেশের ফলের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই। তাই খাই না। অথচ চিকিত্সাশাস্ত্র অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে একটি আপেল বা এজাতীয় ফল খাওয়া উচিত।
কোনো এককালে দেশে ফলের আকাল ছিল। যুগের ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে গত দেড় যুগে দেশের কোথাও ফলের অভাব লক্ষ্য করিনি। একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় সবাই নিয়মিত ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু আমরা কতই না অভাগা জাতি, এখন হাতের কাছে পর্যাপ্ত ফল থাকতেও দেশের মানুষ মনের মতো করে খেতে পারছে না! কয়েক বছর আগে যখন দেশে প্রথম ফরমালিনের উপদ্রবের কথা শুনেছিলাম, তখন মনে মনে ভাবছিলাম, হয়তো মধু ও দুধ বিক্রেতাদের মতোই শিগগিরই গাছ থেকে আম, লিচু প্রভৃতি পাড়ার আগেই ফলে ফরমালিন প্রয়োগ করা হতে পারে। এবার দেশে গিয়ে প্রায় সবার মুখেই আমার এ অশুভ চিন্তার বাস্তব রূপ দেখতে পেলাম। শুনেছি টিভিতেও নাকি এর ওপর অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে।
অন্যদিকে, মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটিও অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। ফলের মতো ফরমালিন আতঙ্কে অনেকে মাছও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে গেলে দেখতে পাই অনেকেই ভেজালমুক্ত মাছ কিনতে সরাসরি নদীতে চলে যান, যাতে জেলেরা নদী থেকে মাছ ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেতারা কিনতে পারেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য তাদের বেশ চড়া দামে মাছ কিনতে হয়। এভাবে কিছু কিছু মানুষের কপালে খাঁটি মাছ জুটলেও দেশের আপামর জনগণ কী করবে? তারা কী খেয়ে বাঁচবে? গত বছর আমি নিজেও মাছ কিনতে ঢাকার নামিদামি এক বাজারে গিয়েছিলাম। চোখের নজরে কিছু তরতাজা পুঁটি দেখতেই এগিয়ে গেলাম। মাছগুলো দেখে যে কেউ বলবেন এগুলো কয়েক ঘণ্টা আগে পানি থেকে ওঠানো হয়েছে। বিক্রেতাদের আকর্ষণীয় ও রকমারি উক্তি (এ বাজারে ফরমালিনওয়ালা মাছ বিক্রি হয় না ইত্যাদি) এবং আমি নিজে মাছের নাক, কান ইত্যাদি পরীক্ষা করে, অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে বেশ আশ্বস্ত করে মাছগুলো সাধারণের চেয়ে অধিক মূল্যে কিনে বাড়ি ফিরলাম। খাবার খেতে বসে এতটাই কষ্ট পেলাম যে এত শখ করে কেনা একটি মাছও খেতে পারিনি। পুঁটি মাছের স্বাদ তো দূরের কথা, মনে হচ্ছিল রীতিমত এক ধরনের আজব পদার্থ চিবোচ্ছি। তখন আমার নিজের জন্য যতটুকু দুঃখ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে দেশের মানুষের জন্য। আমার না হয় একদিন বাজে অভিজ্ঞতা হলো, তাছাড়া যে ক’দিন দেশে থাকব, না হয় মাছ না খেয়েই কাটিয়ে দেব। কিন্তু দেশের মানুষের কী হবে, যাদের এগুলো ভক্ষণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই? তখন মনে খুবই কষ্ট ও অস্থির লাগছিল।
পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণে বাংলাদেশের মানুষের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর এমনিতেই কিডনিতে বিভিন্ন সমস্যা; তার ওপর নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার ভক্ষণে কিডনির কী অবস্থা দাঁড়াচ্ছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ফরমালিনযুক্ত খাবারে লিভারে বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি ফুসফুসে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। ফরমালিন হচ্ছে এক ধরনের কেমিক্যাল, যা বিভিন্ন প্রজাতির বিষাক্ত জীবাণু বিনাশে ব্যবহার করা হয়। যেভাবে ইঁদুর মারার ওষুধের উপকরণ দিয়ে সিগারেট বানানো হয়। তাছাড়া ফরমালিনের ব্যবহার মৃতদেহকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করে। রঙিন নেগেটিভ ছবি ডেভেলপ করার কাজেও ফরমালিন ব্যবহৃত হয়; অথচ আমাদের বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার শাকসবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের দেশি ও বিদেশি ফল, মাছ, গোশতসহ সবকিছুতেই ফরমালিনের ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর ফলে দেশের আপামর জনসাধারণ এক অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করছে, যার খেসারত দিনের পর দিন ফরমালিনসেবী প্রায় সবাইকেই দিতে হচ্ছে বা হবে। এক দিকে বাংলাদেশের গড় আয়ু অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম, তার ওপর ফরমালিনের আক্রমণ এ হার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে!
মাদক সেবনে শরীরের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, ফরমালিনযুক্ত খাবার শরীরের জন্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। এ চিরন্তন সত্য কথা আমার চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বেশি জানার কথা। মাদক ব্যবসায়ীদের সাজা যদি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে ফরমালিন ব্যবসায়ীদের সাজাও মৃত্যুদণ্ড হলে দোষের কী? সরকার সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হলে দেশে এভাবে ফরমালিনের রাজত্ব কায়েম হতো না। আর এখনও ইচ্ছা করলে এক মাসের মধ্যেই এর নির্মূল অসম্ভব নয়। মুষ্টিমেয় কিছু স্মাগলারের জন্যই দেশের আজ এ করুণ দশা। কিছু অসত্ ব্যবসায়ীর স্বার্থসিদ্ধি করতে দেশের আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্য হুমকির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শুধু লোকদেখানো বিশেষ কোনো দিন ফরমালিনবিরোধী অভিযান চালিয়ে হাতেগোনা কিছু লোককে গ্রেফতার বা জরিমানা করলেই এর প্রতিকার সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও ইচ্ছা করলে ফরমালিনমুক্ত বাজার গড়তে ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাব নিয়মিত মাঠে কাজ করেন। ইচ্ছা করলেই তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যায়। অন্যদিকে পরিবার-পরিজনের কথা একবার ভাবুন। নিজের কথা না-ই ভাবলেন। তারা কী খাচ্ছে? আপনাদের সন্তানরা কী খেয়ে বড় হচ্ছে? তাদের সুস্বাস্থ্য আপনাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড করেছে। তার মধ্যে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট, ঢাকা বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত শহর ইত্যাদি অন্যতম। প্রবাসে থেকে আমরা অদূর ভবিষ্যতে শুনতে চাই না ভেজাল খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহেও বাংলাদেশ দুনিয়ায় এক নম্বর। সরকার যদি এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, জনগণের উচিত ফরমালিনবিরোধী গণআন্দোলনের ডাক দেয়া। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন গণসচেতনতা বাড়াতে ও ফরমালিনমুক্ত বাজার গড়তে বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচির আয়োজন করতে পারে। জনতার আদালতেই প্রকৃত ফরমালিন ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জাতিকে এ মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করতে এ মুহূর্তে এর বিকল্প নেই।
লেখক : সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও খণ্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.a
u

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads