আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহে রাজনীতিকরণ ও বিরোধী মত দমনে নির্মম পন্থা প্রয়োগ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাষ্ট্র ও নির্বাহীরা একাকার হয়ে গেছে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বিরোধীপক্ষ নির্মম নিধনে সরকারি দলের হত্যাকান্ডে বিচার বিভাগ ‘মৃত্যুদন্ড' দিলেও রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কর্ণধার ‘রাষ্ট্রপতি' নির্বাহী অনুরোধে তা মওকুফ করে দিচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আমলে প্রায় ২৩ জনের ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। দলীয় বিবেচনায় পুলিশ ও র্যাব বাহিনীর মতো এলিট ফোর্সে নিয়োগ এখন উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বাহিনীর কর্মকর্তাদের মন্তব্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি ও বিরোধী দলের প্রতি বিদ্বেষ ফুটে ওঠেছে। মাসাধিককাল পূর্বে নারায়ণগঞ্জে পুলিশ কর্মকর্তাদের এক সম্মেলনে এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবির আমার বাহিনীর কারো পা ভাঙলে তোমরা তাদের ১০ জনের পা ভাঙবে। এ বাহিনীতে তাদের সমর্থিত কেউ থাকলে দয়া করে পুলিশ বাহিনী থেকে বেরিয়ে যাবেন- কেননা, এ দেশকে পাকিস্তান-আফগান বানানো যাবে না।' মাধ্যমিক শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রেস ক্লাবে জমায়েত আন্দোলনকারীদের ওপর ‘পিপার স্প্রে' ও পানি ছিটানো, লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করার পর বীরদর্পে আরেকজন পুলিশ অফিসার বলেছেন, ‘‘শিক্ষকদের আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী ঢুকে পড়ায় পুলিশী এ্যাকশন নিতে বাধ্য হয়েছি। চরমভাবে বিরোধী দল বিদ্বেষী পুলিশ অফিসারদের বেছে বেছে নিয়োগ দিয়ে বিরোধী মত দমনে সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়নে আইনশৃক্মখলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশের এসব কর্মকান্ডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের নিস্পৃহ মনোভাব বাহিনীসমূহের অপকর্মে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া এসব অমানবিক ক্রিয়াকান্ড সম্ভব নয় বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ঢাকা ৫৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিকুল ইসলামের র্যাব পরিচয়ে গ্রেফতার ও কুমারখালীতে পুলিশী হ্যান্ডকাপ পরিহিত লাশ উদ্ধারে অপরাধ বিজ্ঞানীদের উদ্বেগে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার বলেছেন, আজকাল বাজারেও পুলিশী পোশাক, হ্যান্ডকাপ কিনতে পাওয়া যায়। কি অদ্ভুত দায়সারা গোছের উপহাসমূলক মন্তব্য। পুলিশী পোশাক, হ্যান্ডকাপ, পুলিশী গুলী-বন্দুক, গ্রেনেড বাইরে পাওয়া গেলে এসব অনাচার বন্ধ করার দায়িত্ব কাদের? র্যাব-পুলিশের ভুয়া গাড়ি নিয়ে ঘাতকেরা গুম-হত্যা চালালে তা বন্ধ করতে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে মন্তব্যকারী কর্মকর্তাসহ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও পদত্যাগ করা উচিত ছিল। ক্ষমতাসীনরা কি এসব অপকর্মের জন্য বিরোধী দলসমূহকে দোষী সাব্যস্ত করবে? বিরোধী দলতো তাদের নেতা-কর্মীদের গুম করবে না। যেসব কথা একজন শিশুমাত্রেও বুঝে- সেসব কথা ক্ষমতাসীনরা বুঝবেন না কেন, বোধে আসে না। জনজীবনের বহমান অসন্তোষ, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। মিছিল, সমাবেশ, হরতাল, অবরোধসহ যাবতীয় প্রতিবাদ সংবিধানসহ উচ্চ আদালত এর বৈধতা দিয়েছে। জননিরাপত্তার দোহাই তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা, নির্মম লাঠিপেটা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, পিপার (শুকনো মরিচ) স্প্রে, গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিক্ষোভকারীদের পায়ের নিম্নাংশে গুলীবর্ষণ ঔপনিবেশিক শাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কোনো সুসভ্য দেশের পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে নিজ দেশের জনগণের উপর র্যাব-পুলিশের এ ধরনের নির্মমতা কল্পনাও করা যায় না। যা কিনা গণতন্ত্রের ‘মানস কন্যা' শাসিত সরকারের আমলে ঘটছে। গত ১২ জানুয়ারি একই দৈনিকে লীড নিউজে ‘আন্দোলন দমনে নিষ্ঠুরতা' শীর্ষক প্রতিবেদনে এর ভয়াবহতার কথা ছাপা হয়েছে। শিক্ষকদের দাবি দাওয়ায় কোন সরকারি উদ্যোগ তো দূরের কথা, পুলিশী বর্বরতায় বলা হয়েছে, ‘‘আলোচনার মধ্যদিয়ে এর সমাধান না করে শিক্ষকদের উপর পিপার স্প্রে করায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পিপার স্প্রে কি? এ বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে- পিপার স্প্রে একটি রাসায়নিক গ্যাস যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা ব্যবহার করা হলে সাথে সাথে চোখে পানি চলে আসে, প্রচন্ড ব্যথা হয়, এমনকি সাময়িক অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। কেমিক্যাল উইপেন্স কনভেনশন-এর ১.৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুদ্ধে প্রতিপক্ষ দমনে পিপার স্প্রে ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারো কারো মতে ভয়ঙ্কর সব জীবজন্তু অথবা পাগলা কুকুর ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পিপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়।’’ মানুষ গড়ার কারিগর সম্মানিত শিক্ষককূল সমাজের শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখতে সর্ব আমলেই সমাজ রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন- ইতিহাস তার সাক্ষী। অথচ মহাজোটীয় শাসনামলে পেটের দায়ে শিক্ষকেরা শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচি কিম্বা প্রতিবাদ মিছিলে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে যে নির্মম পুলিশী নিপীড়ন উপহার পেলেন-তা কিন্তু নির্মমতার ইতিহাসে লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। কেমিক্যাল উইপেন্স কনভেনশনের নিষিদ্ধ স্প্রে শিক্ষকদের উপর মেরে ক্ষমতাসীনেরা কোন ন্যাক্কারজনক অধ্যায় রচনা করলেন-তা কিন্তু ভেবে দেখার সময় তাদের নেই ক্ষমতার মদমত্ততা আর অহমিকার জন্য। ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আটক বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে লক্ষ্য করে আইন প্রতিমন্ত্রীর হুঙ্কার বিরোধী মহলে ভীতি ছড়ানোর কৌশল বলে অনেকে মনে করছেন। ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ২০ জন ছাত্রীকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার-রিমান্ড, গর্ভবতী মহিলাকে জামিন না দিয়ে ৮ তলা ভবনে ওঠানো-নামানো, পর্দানসীন মহিলাদের বেপর্দায় আসতে বাধ্য করা- আর যাই হোক সুস্থ গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ বলে মনে হয় না। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ইসলামী আন্দোলনের বরেণ্য নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ২ বছরাধিককালের গৃহবন্দীত্ব ও তার সকরুণ মৃত্যুবরণ সুশাসনের স্বাক্ষর বহন করে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেও সরকারের মন গলাতে পারেনি। সারাবিশ্ব থেকে কেমন জানি একঘরে অবস্থা। বর্তমান সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ বরেণ্য আলেম-ওলামা ও ইসলামী নেতৃবৃন্দের বিচারের জন্য তুরস্কসহ অপরাপর প্রভাবশালী ইসলামী দেশসমূহের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে বাংলাদেশের। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুখকর নয়। যেমন সুখকর অবস্থা নেই দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার।
দৈনিক ‘প্রথম আলো'র শিরোনাম (ছাত্রলীগের ফের হামলা/১৩ জানুয়ারি, ২০১৩) মোতাবেক গত ১২ জানুয়ারি পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ ধর্মঘটি শিক্ষকদের যথেচ্ছভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। কুষ্টিয়ার সেই বিতর্কিত পুলিশ সুপার আশেপাশেই ছিলেন। যেমন উপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ পেটানো উপ-পুলিশ কমিশনার (হারুনুর রশিদ) মর্মান্তিক বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের সময়। একটু তৎপর হলেই কিন্তু মর্মন্তুদ ঘটনাগুলো সংঘটিত হতো না- কিন্তু দলীয় আনুগত্য সে প্রত্যাশাগুলো ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে। জানি না এর অবসান কবে হবে?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন