পর্যবেক্ষকমহল যখন বলছেন, নতুন বছরটি সরকারের জন্য আরও বেশি চ্যালেঞ্জের বছর হবে, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাপ ও ওঝা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বর্তমান সময়ে নেতানেত্রীদের বক্তব্য ও আচার-আচরণে মানুষ আর তেমন আশাবাদী হতে পারছেন না। আসল কাজ বাদ দিয়ে কীভাবে কাকে ছোট করা যায়, হেনস্তা করা যায় তা নিয়েই যত উৎসব। এতে যে দেশের ও জনগণের কোনো কল্যাণ নেই তা যেন আমাদের নেতা-নেত্রীরা উপলব্ধি করতে পারছেন না। ফলে জনগণের জীবনযাপনের সংকট বাড়ছে, বাড়ছে দেশের সংকটও। ব্লেমগেমে যে গণতন্ত্র নেই, জনগণের ইচ্ছে পূরণের উপাদান নেই তা না বোঝার মতো অজ্ঞতো আমাদের নেতানেত্রীরা নন। তারপরও এমন অপসংস্কৃতিতেই তারা মগ্ন। এক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন সরকার এবং সরকারি দল, কারণ শপথের আলোকে তাদের দায়িত্বটাই বেশি। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তারা এগিয়ে আসেননি। বরং ক্ষমতা, রাজনীতি ও দলবাজিকেই এখন তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু অর্থউপার্জন ও বড়লোক হওয়ার বিষয় নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে আছে জনগণের জীবনযাপন ও দেশের উন্নয়নের মতো মৌলিক বিষয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যকে সঠিকখাতে ও সঠিকভাবে পরিচালিত করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু শপথের আলোকে এই দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গত চার বছরে দেশের প্রায় সব খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা একচেটিয়াভাবে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও অনুমোদন নিয়েছেন। এ ব্যাপারে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, বিদ্যুৎ, টেলিকম, ব্যাংক-বীমা, শিপিং, বিশ্ববিদ্যালয়, রেডিও-টিভির লাইসেন্স ব্যবসাসহ এ ধরনের প্রায় প্রতিটি খাতের বড় ব্যবসায়ী এখন সরকারি দলের নেতারাই। শুধু তারাই নন, বড় বড় ব্যবসায় নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিবারের সদস্যরা। আর সারাদেশে সড়ক ও জনপথ, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, মৎস্য ও পানিসম্পদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সব প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি দলের মাঠপর্যায়ের নেতারা। কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ তারাই বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন বড় বড় কাজ পাইয়ে দিতে তদবির বাণিজ্যও করছেন তারা। ভর্তিবাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য ও দখলবাণিজ্যেও রয়েছেন তারাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সুযোগ-সুবিধা আদায়ে সরকারি দলের নেতারা আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা করেন না। ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবসা-বাণিজ্য বাগিয়ে নিতে জোর জবরদস্তিমূলক বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তারা। এর ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের পকেট ভারি হলেও শূন্য হচ্ছে জনগণের পকেট। পকেট শূন্য হওয়ার পাশাপাশি জনগণের সংকটের মাত্রাও বেড়েই চলেছে। এরই নাম যদি ‘দিনবদল' হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে- এমন দিনবদলের জন্যই কি জনগণ মহাজোট সরকারকে ভোট দিয়েছিল?
বর্তমান সরকারের আমলে গত চার বছর ধরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা ও অরাজকতা। একই সঙ্গে চলছে জনগণের পকেট কাটার মহোৎসব। এ সময়ের মধ্যেই সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ছয়বার। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ বিলে ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে দাম বাড়াতে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। দাম আরও একদফা বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও সরকার উল্টো পাঁচ দফায় এর দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে। রেন্ট ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে সরকার এবং সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত থেকে ৩৪ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে সরকার হরিলুটের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত করেছে বলে অভিযোগ করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভেবেছেন, সরকারি ঘরানার লোকদের বিত্তশালী করলে আগামী নির্বাচনে তা কাজে দেবে। কিন্তু ভোট তো দেবে জনগণ। দেশে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে এবং জনগণ যদি স্বাধীনভাবে তাদের ভোট প্রদানের অধিকার পায় তাহলে জনগণ তো কখনও গণবিরোধী লোকদের ভোট দেবে না। তখন সরকারি ঘরানার বিত্তশালীদের বিত্ত-বৈভব সরকারি দলের কি কাজে লাগবে? বরং ঐ সব অর্থ অনেক অনর্থকে ডেকে আনতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সরকারের ৪ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছে ৪টি জরিপের ফলাফল। ৪ দৈনিকের জরিপে উঠে এসেছে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়। বেশির ভাগ ভোটার মত দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে না। এই জরিপে রয়েছে সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। কিন্তু সরকার জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। সরকার জনমতকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি অর্থ ও শক্তির দাপটে স্বৈরমানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হয়, জনমত বিরোধীদলকে অবদমনের প্রয়াস পায় তাহলে ইতিহাসে দুঃখজনক পরিণতি ডেকে আনবে সরকারের জন্য।
সরকার শুধু যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে তা না, স্বাধীন জাতির সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদা রক্ষায়ও ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে সরকার। এবার নববর্ষের শুরুতেই সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিককে গুলী করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)। দেশের জনগণের জান-মাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের উপরে বর্তালেও বর্তমান সরকার বিএসএফ-এর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক দায়িত্বটুকু পালন করছে না। ভারতের বর্বর বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ও দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। এমনকি বিএসএফের বর্বতার বিরুদ্ধে কথা বলছে ভারতের অনেক মানবাধিকার সংগঠনও। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি বলেছেন, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তিনি সীমান্তে গুলী চালানোর অনুমতি দিয়ে এসেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন চেতনায় সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষিত হবে কেমন করে? মানুষতো সরকার নির্বাচন করে শান্তিময় জীবনের জন্য, জান-মালের নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার নির্বাচনী ইশতেহারের কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় ওয়াদার কথাও। ফলে সুশাসনের বদলে জনগণের উপর নেমে আসে দলীয় শাসনের আপদ। এমন অবস্থায় আশা ভঙ্গ হয় জনগণের। দেশের ভেতর এবং সীমান্তে আশাভঙ্গের নানা উদাহরণই এখন লক্ষ্য করছে বাংলাদেশের জনগণ। সরকারতো জনগণকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল কিন্তু জনগণ এখন আর কথার চমক শুনতে চায় না। কারণ কথা ও কাজের গরমিলে সুন্দর শব্দগুলোও এখন জনগণের কাছে তেতো মনে হয়। কথা ও কাজে সমন্বয় থাকার জন্য যে নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধ প্রয়োজন তা যেন আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে। সরকার তার আচার-আচরণে নীতি-নৈতিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যেত রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং সরকারি ঘরানার সংগঠনগুলোর মধ্যেও। সরকার যে এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে তার বড় প্রমাণ ‘ছাত্রলীগ'। বিষয়টি যে শুধু দেশের জনগণই উপলব্ধি করেছেন তা নয়, উপলব্ধি করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদেরও। এজন্যই হয়তো তিনি ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ‘এনালগ' আচরণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, এনালগ আচরণে সৌজন্যবোধ ও মূল্যবোধ থাকে। আসলে মূল্যবোধের সংকট দেখা দিয়েছে রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে। ছাত্রলীগকে তো এনালগ আচরণের কথা বলে সৌজন্যবোধ ও মূল্যবোধের উপদেশ দেয়া হলো। ছাত্রলীগতো ছাত্রদের সংগঠন, কিন্তু এ ছাত্রদের যারা শিক্ষক তথা যারা দেশ ও সমাজ পরিচালনা করছেন তারা সৌজন্যবোধ ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছেন কি? এক্ষেত্রে ফাঁকি রেখে ছাত্রলীগকে যেমন গঠন করা যাবে না তেমনি গঠন করা যাবে না দেশও। এই সত্যটি আজ উপলব্ধি করা প্রয়োজন আমাদের নেতা-নেত্রী ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের। বিষয়টি তারা উপলব্ধি করেন কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন