রবিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩

গণ-আন্দোলনের বিকল্প নেই


মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতির আলো-আঁধারের খেলাটা ত্র“মেই ঘনীভূত হচ্ছে। শাসক দল চাচ্ছে তাদের সুবিধামতো একটি নির্বাচন, বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট চাচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন; অন্য কিছু দল চাচ্ছে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে। এই পরস্পর বিপরীতমুখী রাজনীতির কারণে সব কিছুই ঘোলাটে ও অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। কোনোভাবেই প্রত্যাশিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বেরিয়ে আসছে না। কাজেই আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে সব বিরোধী দলকে এক হয়ে সরকারের ওপর কঠিন চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে রাজনীনিতির গতিপ্রকৃতি নির্দলীয়-নিরপে সরকার ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হয়।
ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি প্রচণ্ড গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কাছ থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা কঠিন। গত ৯ ডিসেম্বরের রাজপথ অবরোধ ছাড়া, সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়; এখন পর্যন্ত এমন কোনো শক্তিশালী গণ-আন্দোলন বিরোধী জোট গড়ে তুলতে পারেনি। ৯ ডিসেম্বর রাজপথ যেভাবে উত্তপ্ত হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে গণ-আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো, সরকারের টনক নড়ত।
আসলে যেকোনো গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অপরিহার্য, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ছাড়া সফলতা আসে না। আর একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে এবং তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে, চার পাশ থেকেই আন্দোলনের পে সাপোর্ট আসতে হয়; শুধু কর্মী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। এর জন্য পেশাজীবী, লেখক-সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এই সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই জনমত সংগঠিত হয় এবং একটি গণ-আন্দোলনের প্রোপট সৃষ্টি হয়। কাজেই গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার েেত্র বিরোধী জোটকে সব মেশিনারিজ সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতীয় রাজনীতিকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার একটা সূক্ষ্ম প্রয়াস ল করা যাচ্ছে। সরকারের সব মেশিনারিজ এ কাজেই নিয়োজিত আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্দলীয় সরকারের পে আন্দোলনের ব্যাপারে পুলিশকে অত্যন্ত কঠোর মনে হচ্ছে। এর পে কোনো শক্তিশালী ও কার্যকর আন্দোলন দেশে গড়ে উঠুক এটি সরকার চাচ্ছে না।
চার বছরের মাথায় এসে হাজারো প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখোমুখি সরকার। মানুষের স্বপ্ন এখন দুঃখ ও বেদনায় পরিণত হয়েছে। তাই অবস্থা বোঝে সরকার বেপরোয়া হয়ে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং এটাকেই তারা মতায় টিকে থাকা ও আবার মতায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে চরম হেনস্তা করছে। এ থেকে বিরোধী শীর্ষ নেতারাও বাদ যাচ্ছেন না। এই বিপজ্জনক পথ থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে, সহনশীল আচরণ করতে হবে; যাতে একটি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের ছবি গোটা দুনিয়া দেখতে পায়।
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কোনো স্বপ্ন চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় না। অপরিপক্ব, অনৈক্য ও অসহিষ্ণু ও বিভাজনের রাজনীতি চূড়ান্তভাবে দেশকে নিয়ে দাঁড় করাবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখিÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশে বর্তমানে রাজনীতির নামে যা কিছু ঘটছে, তাতে যেকোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অজানা গন্তব্য ও মারাত্মক পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে।
নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোটের সাথে শাসক দলের দূরত্ব এখন চরমে। এই ইস্যুতে সরকারের প থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিরোধী জোট তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরবে না। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। এ ব্যাপারে তারা কোনো আলোচনায় বসতে চাচ্ছে না। এই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থায় কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পথ বেরিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় বিরোধী জোটের রাজপথে নামা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
নির্দলীয়-নিরপে সরকার শুধু বিরোধী জোটের দাবি নয়, এটি জনদাবি। এই দাবিতে বিরোধী জোট যেখানে জনসভা ডেকেছে, সেখানে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে; মানুষের অভাবনীয় সাড়া সেখানে ল করা গেছে, রাজনীতির স্বকীয়তা সেখানে ফুটে উঠেছে। কার্যত এটি এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, দেশের সব রাজনৈতিক দল এক বাক্যে এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কেননা একটি সুষ্ঠু, পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল নির্দলীয়-নিরপে সরকারের অধীনেই করা সম্ভব; কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এটি আশা করা অবান্তর।
কিন্তু শাসক দল পরাজয়ের ভয়ে বিরোধী জোটের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে চাচ্ছে না। তাই আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনি সঙ্কেত; সব কিছু নিপ্তি হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সঙ্কটের আবর্তে। মানুষের মনে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাÑ কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, কী হতে যাচ্ছে দেশে। দেশ কি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে? প্রথিতযশা সাংবাদিক ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা তো এমনই আশঙ্কা করছেন। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে, গৃহযুদ্ধের পথেই দেশ ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
দেশকে অপূরণীয় তি থেকে রা করতে রাজনীতিতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র নিরপে সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে দেশকে রা করতে পারে। তা না হলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিত ধারা। মানুষ হারাতে পারে তাদের ভোটের অধিকার, দেশ হতে পারে ভয়াবহ তির সম্মুখীন।
বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো সামনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে মধ্য আয়ের দেশের দিকে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। কে বা কোন দল মতায় গেল সেটি বড় করে না দেখে, দেশকে বড় করে দেখতে হবে; গোটা দুনিয়া বাংলাদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেখতে চায়, কেননা এর মধ্যেই তারা সৃজনশীল, পরিচ্ছন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।
শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে পপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করাও অবান্তর। ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের পে সেটি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার ভোটকেন্দ্রের প্রায় ৯ কোটি ভোটারের ভোট নিশ্চিত করার মতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশবাহিনীর ওপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হয় আর দলীয় সরকারের অধীনে এসব প্রশাসনযন্ত্র কোনোভাবেই নিরপে থাকতে পারে না। সুতরাং কোনো দলীয় সরকার ও তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করা নিঃসন্দেহে অবান্তর।
নির্দলীয় সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। উচ্চ আদালত আরো দু’টি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘও সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। বিষয়টি সর্বোচ্চ বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশে সফর করে যাওয়া জাতিসঙ্ঘের অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দণি এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেকও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। এ ল্েয তারা উভয়ই দ্রুত সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে এবং বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উত্তরণে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। বিলম্ব না করে সরকারের উচিত সংলাপের ত্রে প্রস্তুত করা। সরকার ও বিরোধী দল এক সাথে কাজ না করলে দেশের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে। এসব বিবেচনায় এনে সরকারের এখনই সমঝোতায় আসা উচিত, যাতে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়িয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করা সম্ভব হয়।
e-mail: belayet_1@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads