বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৩

দুঃশাসনে পিতাকে ছাড়িয়ে গেলেন শেখ হাসিনা



সৈয়দ আবদাল আহমদ

আর একদিন পর ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সরকারের চার বছর পূর্তি। ২০০৯ সালের এ দিনটিতে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন শেখ হাসিনা। চার বছর পূর্ণ করে তার মেয়াদের শেষ বছরটি শুরু হচ্ছে। এই শেষ বছর বা পঞ্চম বছরের প্রাক্কালে এসে শেখ হাসিনার শাসনকাল কেমন যাচ্ছে, মূল্যায়ন করতে বলা হলে যে কেউই একবাক্যে উত্তর দেবেন দুঃসহ। সত্যিই দুঃসহ। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে বিগত চার বছরের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর সময় পার করছে।
একটি সরকার ক্ষমতায় এলে মানুষ নতুন আশায় উদ্দীপ্ত থাকে। তার সুযোগ-সুবিধা বাড়বে, দৈনন্দিন জীবন উপকৃত হবে এবং দেশের কল্যাণ হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের বিগত চার বছরের শাসনকাল মানুষকে শুধুু আশাহতই করেনি, একের পর এক ভয়াবহ বিপদেও ফেলে দিয়েছে। একটি সরকার যে কত নিকৃষ্ট, নিষ্ঠুর এবং বিপজ্জনক হতে পারে—তার বড় প্রমাণ শেখ হাসিনার সরকার। দেশের মানুষ বলাবলি করছে, পিতা শেখ মুজিবের ১৯৭২-৭৫ শাসনকালকেও ছাড়িয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। তার শাসনকাল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসনের একটি নজির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এ সময়ে সুশাসন নির্বাসনে চলে গেছে। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে একটি পুতুল খেলার বস্তুতে। দুর্নীতি মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে চরম শঙ্কা, উত্কণ্ঠা ও দীর্ঘশ্বাসে। দুর্নীতি, লুটপাট, খুন, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে গেছে। সরকার তার অপকর্মের দ্বারা বার বার বিড়ম্বনায়ও পড়েছে। কিন্তু এ থেকে শিক্ষা নেয়নি; বরং আরও বেশি করে খারাপ কাজটি করেছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসনকাল একটি অপশাসনের কালো অধ্যায় হয়ে আছে। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, দুর্নীতি-কালোবাজারি-লুটপাট এবং দুর্ভিক্ষের কথা মানুষ ভোলেনি। ভোলেনি ফ্যাসিবাদী শাসনের কথা। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনকাল সেই শাসনকেও হার মানিয়েছে। মানবাধিকার হরণ এবং ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে পিতার চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপে মানুষ দেখছে কন্যা শেখ হাসিনাকে। বর্তমান শাসন হার মানিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকালকেও।
শেখ হাসিনা সরকার অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে ও মিথ্যাচার করে জনগণকে হতাশই শুধু করেনি, অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের পরিবর্তনই করেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও লাগামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। দশ টাকা কেজি চাল, বিনামূল্যে সার, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি স্বপ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন একটি অবস্থায় গেছে যে, অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিশ্রুতির বিশাল বহর নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির কথা সরকার কানেই নিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকারও করছে। অর্থনৈতিক ব্যর্থতা আকাশ ছুঁয়েছে। দুর্নীতির জন্য পদ্মা সেতু তো ডুবলই, উপরন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের কপালে আবারও জুটল দুর্নীতির কলঙ্ক তিলক। গত চার বছরে বিরোধী দল ও বিরোধী মতের দমন, দুষ্টের লালন, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, দখল, হামলা-মামলা, দলীয়করণ, মিডিয়া দলনের নতুন নজির সৃষ্টি করেছে সরকার। শেখ হাসিনা সরকারের এই আমলে গুমের ঘটনা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন। দুর্নীতি ও লুটপাট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সেটা এখন আর দেশের মানুষ এবং বিরোধী দলই শুধু বলছে না, দাতা দেশ এবং বিদেশি সংস্থাগুলোও জোরালোভাবে বলছে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থায়ন বাতিল করে দিয়েছে। সরকারি দলের ক্যাডার, বিশেষ করে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য শিক্ষাঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে দেশব্যাপী। ছাত্রলীগ এখন ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন, হত্যা ও মিডিয়া দলনের ক্ষেত্রেও সরকার নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। চার বছরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাসহ ১৭ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দেড় হাজার সাংবাদিক। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, আদালতের রায়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা চালু আছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দশ মাসেরও বেশি সময় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। আবারও আমার দেশ হুমকির সম্মুখীন হয়। সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আজ ২৩ দিন ধরে পত্রিকা অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। হুমকি এসেছে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোর ওপর। আক্রমণের শিকার হয়েছেন টকশোতে আসা বিশিষ্ট নাগরিকরা। সবক্ষেত্রেই মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। তেমনি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিরোধী দলকে মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সরকার দেশকে এক অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশব্যাপী অস্থিরতা বাড়ছেই। এর ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বস্তুতপক্ষে গত চার বছরে সবক্ষেত্রেই ভয়াবহ নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। জনগণেরও কিছু করার নেই। কোনদিকে যাবে, বিকল্প কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
অপরাধের আজ কোনো বিচার হচ্ছে না। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। ছেড়ে দেয়া হচ্ছে ফাঁসির আসামিদের। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী দিয়ে জেলখানা ভরে ফেলা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ৭ হাজার ১০১টি মামলা প্রত্যাহার করা হলেও বিরোধী দলের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করা ওইসব মামলা থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রায় ১ লাখ আসামি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এক কথায় একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে মানুষকে জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায়ও দেখা যাচ্ছে না।
চার বছরের যত অপকর্ম
বিরোধী দলে থাকাকালে একের পর এক দাবি ও দফা উত্থাপনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে পর্যুদস্ত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের যেমন জুড়ি নেই, তেমনি একই কৌশলে ক্ষমতায় থাকাকালে নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতা ঢাকতে এবং জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নিতে একের পর এক অপকর্ম করার সুখ্যাতিও তাদের আছে দীর্ঘদিনের। ২০০৯ সালে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের জরুরি জমানার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নাতীত না হলেও তারা এ বিজয়কে জনগণের রায় হিসেবে বলে থাকে। এ বিজয়ের পর গত চার বছরে অপকর্মের একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শেখ হাসিনা সরকার। এ সময় সরকার সৃষ্টি করেছে শুধু ইস্যু আর ইস্যু। এর মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন নিজের সীমাহীন ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চেয়েছে, তেমনি বিরোধী দলকেও রেখেছে নানা রকম চাপের মধ্যে। এ সময় এমনসব ঘটনা ঘটেছে, যার একটিই সরকারের পতনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এ ধরনের শত ঘটনার পরও বিরোধী দল কিছুই করতে পারেনি। বিরোধী দলের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকার অপকর্ম ঘটিয়েই চলছে। আর এ অপকর্মের কারণে মানুষ অসহায়।
গত চার বছরে শেখ হাসিনা সরকার শতাধিক অপকর্ম বা ইস্যু সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে প্রথম বছর ২০০৯ সালে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি, ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ভারতীয় পুলিশ আসা, উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দিতে সরকারের সম্মতি, উলফা নেতা রাজখোয়ার আত্মসমর্পণ ও দিল্লির কাছে হস্তান্তর, সেনাবাহিনীতে কওমি মাদরাসার ছাত্র থাকার অভিযোগ, ভিন্নমত দমনে একের পর এক এজেন্ডা বাস্তবায়ন, ৩০ বছর পর জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকে মুছে ফেলা, গভীর রাতে স্টেডিয়াম থেকে জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা, মুজিব পরিবারের নিরাপত্তা আইন পাস, ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করে তথাকথিত ডিজিটাল সময় চালু, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে ভারসাম্যহীন ঘোষণা করা, বিডিআরের মতো আরও বিদ্রোহ হতে পারে বলে সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে হত্যাচেষ্টা নিয়ে রাজনীতি, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামী লীগ নেতাদের হুমকি ছিল উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বছর অর্থাত্ ২০১০ সালে সরকারের সৃষ্ট অপকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আমার দেশ বন্ধ এবং পত্রিকা সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন ও ১০ মাসের বেশি সময় জেলে বন্দী করে রাখা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সরকারের তৃতীয় বছর বা ২০১১ সালে সৃষ্ট অপকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে ঢাকাকে দুই ভাগ করা, অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে দেশের ৬১টি জেলায় প্রশাসক হিসেবে সরকারদলীয় নেতাদের নিয়োগ, ফাঁসির আসামি বা খুনিদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা এবং মন্ত্রী কর্তৃক ফুলের মালা দিয়ে বরণ, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লুটপাট করে ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করা এবং পরে এ নিয়ে রাজনীতি, আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ এবং এর বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ, লোকমান হত্যাকাণ্ড, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া এবং এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা, গণপিটুনিতে হত্যা এবং সীমান্তে বিএসএফের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড।
সরকারের মেয়াদের চতুর্থ বছরটি আগের তিন বছরের সব অপকর্মকে ছাড়িয়ে যায়। এ সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তাদের একটি সাফল্য বলে প্রচার করে। কিন্তু এই বিচারকে তারা যে একটি প্রহসনে পরিণত করে, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনায়। এই কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেয় দৈনিক আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট। এই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রমাণ হয় সরকার বিচার বিভাগকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং যোগসাজশের মাধ্যমে বিচার করছে। এ ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারক পদত্যাগ করেন। বিচারপতির এই স্কাইপ কেলেঙ্কারি ছিল বছরের সাড়াজাগানো ঘটনা। এটা শেখ হাসিনা সরকারই ঘটিয়ে গোটা বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। দুর্নীতির জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি ২০১১ সালে এবং ২০১২ সালে দু’দুবার গণমাধ্যমে আলোচিত চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন দুর্নীতির জন্য। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনাটি প্রমাণ হওয়ায় এটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয় এবং বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা বাতিল করে।
মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনের ঘুষ কেলেঙ্কারি ও রেলের কালো বিড়ালের ঘটনা শেখ হাসিনা সরকারের চতুর্থ বর্ষের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ বছর বিএনপির সম্ভাবনাময় নেতা ইলিয়াস আলীর গুম ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের গুপ্তহত্যাও ছিল এ সরকারের একটি চাঞ্চল্যকর অপকর্ম। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা এবং ছাত্রলীগের চাপাতি-রডে বিশ্বজিতের নৃশংস খুন ছিল চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড। তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ১২৫ শ্রমিক আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ঘটনাও এ সরকারের গাফিলতির এক ভয়াবহ নজির। সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং ডেসটিনির প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনাটিও এ সরকারের ক্ষমতাশালী লোকজনের যোগসাজশে ঘটেছে। এ বছরটিতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার রেকর্ড হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে সীমাহীন নৈরাজ্য চলেছে। ছাত্রলীগ এ বছর আরও বেপরোয়া হয়ে অর্থাত্ ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়। সিলেটের এমসি কলেজের প্রাচীন ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়ে তৃতীয় বছরটিতে যেমন ধিক্কার কুড়িয়েছে ছাত্রলীগ, তেমনি চতুর্থ বছরে বিশ্বজিেক নৃশংসভাবে খুন করে দানবের উপাধি পেয়েছে সংগঠনটি। ‘আমি হিন্দু হিন্দু’ বলেও ছাত্রলীগের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি বিশ্বজিত্। এই ছাত্রলীগই শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার জন্য দেশবাসীর ধিক্কার পেয়েছিল। সমুদ্রজয়ের নামে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দু’বার গ্রেফতার, সম্মানিত ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও এবিএম মূসাকে শেখ হাসিনার অপমান করা ইত্যাদি নানা অপকর্ম ঘটেছে চতুর্থ বছরটিতে।
শেখ হাসিনার মতো সরকার দিয়ে বাংলাদেশ কতটা এগোবে
মেয়াদের শেষ বছরের প্রাক্কালে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধু সাজার ভান করছেন। যাদের দিয়ে কুকর্ম করিয়েছেন, তাদের দল থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন খারাপ লোকদের তিনি দলে রাখছেন না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম থেকে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও রাজিউদ্দিন রাজুকে বাদ দিয়েছেন। দলের কোনো কমিটিতে রাখেননি সৈয়দ আবুল হোসেনকে। দলে যারা এতদিন চরম অবহেলিত ছিলেন, সেই তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু ও মোহাম্মদ নাসিমকে প্রেসিডিয়ামে আনা হচ্ছে। মোহাম্মদ নাসিম ঢুকে পড়েছেন। তোফায়েল ও আমু রাজি হচ্ছেন না। শেষরক্ষার জন্য শেখ হাসিনা এখন তাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন—এটা তারা বুঝতে পারছেন।
দুর্নীতির কলঙ্ক নিয়ে মন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করেন আবুল হোসেন। ছুটিতে যান ড. মসিউর রহমান। দফতরবিহীন মন্ত্রী হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই দুর্নীতির সমুদয় দায় এখন তাদের ওপর পড়ছে। কিন্তু এ দায় কি শুধু তাদের একার? দেশব্যাপী আবুল হোসেনকে মানুষ জানে ক্যাশিয়ার হিসেবে। তাকে আড়াল করলেই কি অপকর্মের দায়ভার থেকে শেষরক্ষা হবে? মহীউদ্দীন খান আলমগীর এখন সবচেয়ে সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাকে প্রেসিডিয়াম থেকে সরালেই কি সমালোচনা শেষ হয়ে যাবে? তিনি কার নির্দেশে সমালোচনার কাজগুলো করছেন তা কি দেশের মানুষ জানে না, বোঝে না? নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ওপর জুতাবৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। এটা কি শুধু ব্যক্তি শাজাহান খানকে লক্ষ্য করে? এর দায়ভার কি পুরো শেখ হাসিনা সরকারের নয়?
দেশের অভ্যন্তরেই নয়, অপকর্মের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে শেখ হাসিনা সরকার। দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলো শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও সুশাসনের অভাবের কারণে বিক্ষুব্ধ। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বেদনাদায়ক মন্তব্য করা হচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোটায়। আওয়ামী লীগের বিবেকমান নেতাকর্মীরাও তাদের সরকার নিয়ে বিরক্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমালোচনা করছেন।
বাংলাদেশের সামনে একটি অপার সম্ভাবনা ছিল। বিশ্বব্যাংক মনে করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে এবং জনমুখী সরকার হলে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ সরকার এলে বাংলাদেশ ২০৫০ সালে পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিলের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি সম্ভাবনাময় দেশ সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের মতো এমন সরকার দেশ চালালে বাংলাদেশের পক্ষে কি ওইসব ভবিষ্যদ্বাণী অর্জন সম্ভব?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads