স্বদেশ নিয়ে কমবেশি সবাই ভাবেন। হয়তো সবার ভাবনা একরকম নয়, ভাবনার মানেও রয়েছে তারতম্য। তবে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, প্রবাসে গেলে দেশের কথা বেশি করে মনে পড়ে এবং প্রবাসীরা দেশের ভাবনায় থাকেন বেশ আন্তরিক। দেশ সম্পর্কে প্রবাসীদের লেখায়ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনি একজন লেখকের নাম আলী রিয়াজ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক। দেশে এসে গত শুক্রবার তিনি চ্যানেল আই-এর একটি টকশোতে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানও নেই যার প্রতি মানুষ পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারে। নির্দ্বিধায় বলতে পারছি না নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মত প্রতিষ্ঠানগুলো সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হলে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, যে পুলিশ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে তাদের প্রতি আজ মানুষের চরম আস্থাহীনতা। কয়েক বছর ধরেই টিআইবি'র জরিপে তা উঠে আসছে। কিন্তু আইনের শাসন কার্যকর করতে এইসব আইনী প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা থাকতে হবে। পিএসসি'র প্রতি পরীক্ষার পরই পরীক্ষা নিয়ে, ফলাফল নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর দায়দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তাদের। এ জন্যই তাদের নির্বাচিত করা হয়। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এখন একদিনের গণতন্ত্র চলছে। মনে হচ্ছে এখানে নির্বাচনের দিনটাই শুধু গণতন্ত্র। এখানে পরস্পর বিরোধী দু'টি শিবির। গণতন্ত্রে ভিন্ন দল থাকবে। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে কেন? এ দু'টি শিবিরের মধ্যে ন্যূনতম কিছু বিষয়ে ঐকমত্য ও আলোচনার পথ থাকা উচিত।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সার্বিক অবস্থা নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন তার সাথে দ্বিমত পোষণের কোন অবকাশ নেই। তার বক্তব্য থেকে আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করা যায় যে, বিদেশে অধ্যাপনার কাজে ব্যস্ত থাকলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বেখবর নন। তিনি যথার্থই বলেছেন, একটি প্রতিষ্ঠানও নেই যার প্রতি মানুষ পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারে। এমন অবস্থায় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? আর পুলিশের প্রতি যখন মানুষ আস্থা হারায তখন উপলব্ধি করা যায় যে, দেশে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত এমন পরিস্থিতির দায় বর্তায় সরকারের উপর। কারণ দেশ পরিচালনার দায় সরকারের। এ জন্যই তাদের নির্বাচিত করে থাকে জনগণ। প্রসঙ্গত এ বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশকে সামনের দিকে এগুতে হলে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার পরিবেশ বর্তমান না থাকায় সমঝোতা বা ঐকমত্যের দুয়ার যেন বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়টিকে জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাব মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা না থাকলে নির্বাচন ও সুশাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংকটে পড়ে যায়। এমন অবস্থায় দ্বনদ্ব-সংঘাত ও হানাহানির মাত্রাই শুধু বাড়তে থাকবে। উল্লেখ্য যে, সামনে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে, কিভাবে হবে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংকট। এমন অবস্থায় সরকারের দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকাই জনগণের কাম্য। কারণ সরকার জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর বিরোধীদলের সাথে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রেও সরকারের দায়িত্বটাই বেশি। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার তার দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে কিনা। বিগত ৪ বছরে সরকার তার সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সামনের মাসগুলোতে সরকার যদি দায়িত্ব পালনে কিছুটা কান্ডজ্ঞানের পরিচয় দেয় তাহলে মানুষের মধ্যে কিছুটা আশাবাদের সঞ্চার হতে পারে। দেশের কল্যাণে এবং গণতন্ত্রের বিকাশে মানুষের অন্তরে আশাবাদের ভিত্তি তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন