নতুন বছর ২০১৩ নির্বাচনের সাল। এ বছরে বাংলাদেশ নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী বছরগুলোর জন্য নতুন সরকার গঠন করবে। সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতার রাজনীতিকে এবার নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হবে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় একতরফা, অগ্রহণযোগ্য, জনঅংশগ্রহণহীন নির্বাচনের কথা কল্পনাও করা যায় না। একদলীয় নির্বাচনও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈধতা পাবে না। ফলে সরকারের একলা চলো নীতি নির্বাচনের বেলায় খাটবে না। প্রয়োজন হবে সংলাপ, সমঝোতার। প্রয়োজন হবে সকল রাজনৈতিক শক্তি ও পক্ষসমূহের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের। এটা না করে অতীতের মতো হুঙ্কার ও প্রতিপক্ষ দলনের ধারা চলতেই থাকলে নির্বাচনে সবাই আসবে বলে মনে হয় না। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া প্রধান বিরোধী দলসমূহের জোট নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ বের করতেই হবে। দায়িত্বশীলরা যত তাড়াতাড়ি এই সমঝোতার পথটি খুঁজে পাবেন, দেশ ও জনগণের জন্য ততই মঙ্গল। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো থেকে রাজনৈতিক বিবাদ বন্ধ করে সংলাপের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যদিও তাদের পরামর্শ শোনা হচ্ছে না, তথাপি নির্বাচনী সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সে পথেই চলতে হবে। হয়ত পানি ঘোলা করেই সে পানি পান করতে হবে। তখন কাজটি তুলনীয় হবে একটি বিশেষ প্রাণীর কাজের সঙ্গে। বুদ্ধিমান সঠিক সময়ে এবং আগেভাগেই কাজ সম্পন্ন করে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আশা করি নতুন বছরের আশাবাদে উজ্জীবিত হয়ে বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করবেন। জনগণকে আন্দোলন ও সংঘাতের পথে ঠেলে দেবেন না। বিরোধী পক্ষকে মারতে মারতে ক্ষেপিয়েও দেবেন না। অন্যকে শান্তি ও ন্যায়বিচার দিয়ে তারা নিজেদের জন্যেও শান্তি আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবেন।
মনে রাখা ভালো, সংঘাত এড়িয়ে সমন্বয়ের কাজটিই গণতন্ত্রের প্রাণ। আর গণতন্ত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পূর্ণ সুযোগ নিতে হলে বাকস্বাধীনতাই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কিন্তু ‘অসৌজন্যের রাজনীতি' বাক-সংযমের বদলে বল্গাহীন বক্তব্যে সমন্বয়কে নস্যাৎ করে সংঘাতকেই তীব্র করে। এতে গণতন্ত্রের প্রাণ তো প্রতিষ্ঠা পায়ই না, বরং ওষ্ঠাগত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘অসৌজন্য' এবং ‘বাক-বিকৃতি' এতোটাই প্রবল হয়েছে যে, বাগাড়ম্বর, মিথ্যা, কুরুচি এসে ঠাঁই নিয়েছে। বক্তৃতা, বিবৃতি, ভাষণ ইত্যাকার প্রকাশযোগ্য প্রতিটি মাধ্যমেই এখন বাকস্বাধীনতার নামে যা চলছে, তা ভয়াবহ। কথা আর কথায় থাকছে না; চোখ উপড়ে ফেলতে চাচ্ছে। উদাহরণটি পুরাতন। নিত্য নতুন উদাহরণ আমরা প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অমৃত-বচন (!) থেকে পেয়ে থাকি।
এমনিতেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রবল সামাজিক অবক্ষয়ের দরুন সমাজের ছোট-বড়, নেতা-কর্মী, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সকলের কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে সৌজন্য ও শালীনতার অভাব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। বাসে-ট্রেনে-বাজারে-মাঠে-ময়দানে অসৌজন্যের উত্তেজিত ভঙ্গি বন্য মোষের মতো ধেয়ে আসছে। কেউ বিন্দুমাত্র সহ্য করতে, পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে বা উদারতা দেখাতে পারছে না। অথচ শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের মাধ্যমেই মানুষকে উন্নত, মহৎ, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে হয়। এ জন্যই উদার, গণতান্ত্রিক, ভদ্র ও সভ্য মনুষ্যসমাজের অন্যতম মৌলিক শর্ত হল সৌজন্য ও শিষ্টাচার।
পরিতাপের বিষয়, অবক্ষয়ের ধারায় ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি সৌজন্য ও শিষ্টাচারের আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী-সমর্থকরা উৎকটভাবে স্বার্থের দড়ি টানাটানিতে মদমত্ত। আত্মম্ভরিতা ও স্বার্থলি≈vর উদগ্র মোহ এমন নিকৃষ্টভাবে তাদের মতিভ্রম ঘটাচ্ছে যে, তাদের কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি, আচার-আচরণকে মনে হচ্ছে অসৌজন্য ও অভদ্রতার আকর। গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হয়েও অনেকেই প্রায়শ নিজেদের আত্মপ্রকাশের সময় ন্যূনতম সৌজন্য ও শালীনতা প্রদর্শনে কুণ্ঠা বোধ করছেন না।
সমাজে ও রাজনীতিতে মতাদর্শ বা কাজকর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, দলের মধ্যে মতপার্থক্য কিংবা বিরোধিতা থাকতে পারে; থাকা স্বাভাবিকও বটে; তবে তা কখনওই পারস্পরিক সৌজন্য-শালীনতাকে লংঘন করবে না। কিন্তু বিরোধ বা বৈসাদৃশ্যের জন্য একজন যদি আরেকজনকে অবমাননার স্তরে টেনে নামালে তদপেক্ষা নৈরাশ্যজনক আর কিছু হয় না। কর্তাগণের এহেন কর্মে [পড়ুন ‘অপকর্মে'] জনগণের মাথা হেঁট হয়ে আসে। স্তাবক ও স্বার্থলোভী সমর্থকরা এমনতর কুশিক্ষায় আরও এক ধাপ এগিয়ে অসৌজন্য আর অশালীনতার মচ্ছব লাগিয়ে ফেলে। এমন দুরবস্থায় ভোটের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে আরেকটি জিনিস দেয়ার কথাও বিশেষভাবে চিন্তা করতে হয়; যার কথা বলে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ: ‘‘যাকে কিছু দেওয়া যায় না, তাকেও একটি জিনিস দেওয়া যায়, তার নাম সৌজন্য।’’
বিগত বছরগুলোর কথা ছেড়ে দিলেও সরকারের শেষ বছরে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের উদাহরণ আশা করতে ইচ্ছে করে। কারণ সৌজন্য ও শিষ্টাচারের মাধ্যমেই তারা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিসমূহের কাছ থেকে সৌজন্য ও শিষ্টাচার দাবি করতে পারবেন। তা না হলে, হত্যা, গুম, হামলা, মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, শেয়ার-হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেঙ্কারী, সাগর-রুনী হত্যা রহস্যসহ অন্যান্য কাজে ব্যর্থতার মতো অসৌজন্য ও অশিষ্টাচারের দায়ভারও তাদেরকে বহন করতে হবে। পদ্মা সেতু ও রেল কেলেঙ্কারির বিরাট কলঙ্ক তিলক মস্তকে বহন করেও সংশ্লিষ্টরা যে ভাষায় কথা বলেছে; এবং যেমন বীরদর্পে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছে, তাতে মানুষ বিস্মিত হয়ে গেছে। অপরাধ স্বীকারের মতো সৎ সাহস দেখানোর কেউ ছিল না। অপরাধ হয়েছে অথচ সংশ্লিষ্ট কেউ অপরাধ স্বীকার করছে না। তাহলে এসব গায়েব অপরাধের দায়িত্ব কার? নির্বাচনের সময় জনগণ সেটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে-এতে কোনওই সন্দেহ নেই।
শাসন মানে নর্তন-কুর্দন নয়, রণহুঙ্কার বা বাগাড়ম্বর নয়, সকলকে নিয়ে চলা। ছোট-বড় সবার প্রতি আইনানুগত আচরণ করা। প্রতিপক্ষকেও ন্যায়বিচারের স্বীকৃত মানদন্ডের মাধ্যমে বিচার করা। অথচ এখন সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে যে, সব করা হচ্ছে প্রতিপক্ষ নিধনের জন্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য। জনগণ তো কাউকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতায় বসায় না। জনগণ সুশাসনের আশায় ভোট দেয়। সেই জনআশায় ছাই দিয়ে কেউ পার পেতে পারেনি; ভবিষ্যতেও পারবে না। সাদা আর কালো, সত্য আর মিথ্যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজকে রাজনীতি যখন দাবি করে জনগণের ভাগ্য-উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, আয়-রোজগার বৃদ্ধির মতো এজেন্ডা, তখন বেছে বেছে ধর্ম বিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদীদের প্রহসনের মাধ্যমে বধ করার কারণ কি? কি ভয়ঙ্কর নির্মমতায় বিচারের বাণীকে ভ্রষ্ট করা হচ্ছে; সাক্ষী-সাবুদ লোপাট করা হচ্ছে; গায়ের জোরে একটি সুপরিকল্পিত নীলনকশার দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। দেশী-বিদেশী সর্ব মহলেই আজকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সহজে পার পাওয়া যাবে না।
জনগণ নির্বাচনের সময় জবাবদিহি করে। কেমন কাজ করেছে, সেটা মূল্যায়ন করে। গণতন্ত্রে একদলীয় শাসন যেমন কেউ মানে না; একদলীয় নির্বাচনও কেউ মেনে নেবে না। বহুদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই উঠে আসে সঠিক জনপ্রতিনিধি। বাংলাদেশ বহু চেষ্টা ও সাধনায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে ধারা সৃষ্টি করেছে, সেটাও নস্যাৎ হবে যদি সকল মহলকে নির্বাচনে আনা না হয়। যদি নির্বাচনের স্বচ্ছতা, পবিত্রতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সকলের কাছে প্রমাণিত না হয়। এ যাবতকালে দলীয় সরকারের অধীনে নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। সেখান থেকে একক কোন দলের কাছে ফেরত যাওয়ার মানে কি? দলীয় শাসনের নামে চারদিকে কি হচ্ছে সেটা কি জনগণ দেখতে পাচ্ছে না? ঠিকই পাচ্ছে। কিন্তু যাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া জরুরি, তাদের ক্ষেত্রে সুবুদ্ধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটাই পরিতাপের বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন