শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৩

মানবাধিকারের দোকানদারেরা এখন কোথায়?


আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের অনেক নেত্রী আছেন। টেলিভিশনের পর্দায় এসব নেতা-নেত্রী খুব সুন্দর ভাষায় কথা বলেন। দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম তাদের দখলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কয়েকজন মানবাধিকারবিষয়ক নেতা-নেত্রীর সাথে অনেকবার কথাও বলেছিলাম। মানবাধিকারবিষয়ক একটি কাজ নিয়ে তাদের অফিসে কয়েকবার যাতায়াতও করেছি। তাদের সুন্দর ভাষার কথা, ভদ্র আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সে অভিজ্ঞতায় আরো প্রত্যক্ষ করলামÑ সরকারি মানবাধিকার কমিশনের কচ্ছপ গতির মতো কাজকর্ম। দেখলাম বুঝলাম যে, এ দেশের বিভিন্ন অসৎ ব্যবসায়ী, করপোরেট গোষ্ঠীসহ যারা তাদের দুই নম্বরি কাজকর্ম ঢেকে রাখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন, মিডিয়া তৈরি করেছেন; ঠিক সেই উদ্দেশ্যেই এরা অনেকে মানবাধিকার কমিশনের দোকান খুলেও বসেছেন। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যত বড় ন্যায়নীতি থাকুক না কেন, তারা তাতে সায় দেয় না। বিশেষ সুতায় গেঁথে আছেন সেসব মানবাধিকার সংস্থার তথাকথিত দোকানদারেরা। মানবাধিকারবিষয়ক সরকারি একটি কমিশন আছে সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম ঢেকে রাখার যন্ত্র হিসেবে। এটা শুধু এখনই নয়, সব আমলেই এরকমটি এ দেশে চলার সংস্কৃতি রয়েছে। সে এক লম্বা কথা। গত ২৩ ডিসেম্বর রোববার দৈনিক প্রথম আলোতে সম্পাদকীয় পাতায় জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিচালক সালমা আলীর লেখা একটি কলাম প্রকাশিত হয়। আমি সালমা আলীর লেখা কলামটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। তার লেখা ওই কলামটিতে মানবাধিকার নিয়ে কয়েক ধরনের কথা স্থান পেলেও সেখানে স্থান পায়নি ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস গেট থেকে নিরপরাধ ২৯ জন নারীকে সম্পূর্ণ বে-আইনি এবং অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতন প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো কথা। আমি তাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথা শুনেছিলাম। এত বড় একটি নারী আন্দোলনকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের কাছে ওই ২১ জন নির্যাতিত নারীর কোনোই গ্রহণযোগ্যতা নেই? তারা কি মানুষ নয়? তারা কি নারী নয়? তারা কি বাংলাদেশী নয়? সেই নারীরা রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো কাজের সাথে জড়িত ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কবি সুফিয়া কামালের কবিতা আমি ছোট বেলা আবৃত্তি করেছি। তিনি এখন জীবিত নেই। তার কন্যা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। তিনি আইন ও সালিশ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী। ওই ২১ জন নির্যাতিত নারীর ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় সুলতানা কামাল আপা একটি কথাও বললেন না। এটা কেমন হলো। আমাদের দেশে লক্ষণীয় একটি বিষয়, অবৈধ অনেক সম্পদের মালিকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ছেন। এতে তাদের লাভ বহু রকমের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে সমাজের লোকদের কাছে সম্মান পাওয়া যায়। প্রশাসন ভালো চোখে দেখে। ভালো আয়েরও একটা উৎস। এরপর তারা মিডিয়া তৈরি করছেন। দু-নম্বরি কাজ ঢেকে রাখার জন্য এবং প্রশাসনে প্রভাব খাটানোর ব্যাপারে মিডিয়া একটি শক্তিশালী উৎস। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বহু রকমের মিডিয়া এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। তবে কিছু ব্যক্তি তো অবশ্যই ভালো আছেন; যারা কল্যাণমূলক উদ্দেশ্য নিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। এরপর যোগ হতে যাচ্ছে মানবাধিকার সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানগুলোও গজিয়ে উঠছে দ্রুত। যতই মানবাধিকার সংস্থা গড়ে উঠছে, ততই মানবাধিকার লঙ্ঘন বাড়ছে। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বিশেষ কিছু স্বার্থ, অ্যাজেন্ডা পূরণের উদ্দেশ্যেই তৈরি হচ্ছে, প্রকৃতভাবে মানবাধিকার রক্ষার খাতিরে নয়। যেভাবে এই সংস্থাগুলো বাড়ছে। হয়তো ক’দিন পর দেখা যাবে দেশের বিভিন্ন বাজারগুলোতে মানবাধিকারবিষয়ক দোকান খুলেও বসতে পারে। এই মানবাধিকার সংস্থার কাজকর্ম অনেকটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো হতে যাচ্ছে। যখন যেটা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগবে তখন সেভাবে কাজ করাই তাদের অ্যাজেন্ডা। কিছু দিন আগে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকায় বাসায় শুয়ে বিটিভি দেখছিলাম। তখন বিটিভিতে একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার দুই কর্ণধারকে নিয়ে মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ আলোচনা হচ্ছিল। স্টুডিওতে উপস্থিত সেই মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি তার নিজ আদর্শিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ই ১৯৯৯ সালে গুরুতর ঘুষের অভিযোগে চাকরিতে ডিমোশন পেয়েছিলেন। এমনকি বর্তমানে তিনি জোর তদবির চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন পাওয়ার জন্য, যাতে আগামীতে এমপি হতে পারেন। আমার কাছে বিষয়টা অদ্ভুত লেগেছিল। ভাবলাম শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বাণিজ্যিক হতে যাচ্ছে। গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার মগবাজার থেকে ২১ জন নিরপরাধ নারীকে সরকারের পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণ বেআইনি ও অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়। সেখানে একজন গর্ভবতী নারীও ছিলেন। আদালতের আটতলায় সিঁড়ি দিয়ে সেই গর্ভবতী নারীকে উঠানো নামানো হয়। অথচ আমাদের দেশে কত না নারী অধিকারের নেত্রী আছেন। আছেন হাজারো মানবাধিকার কর্মী। কিন্তু এই ২১ জন নারীকে নিয়ে কেউ তো চোখের পানি ফেলানো দূরের কথাÑ ব্রিফিং করে দু-একটি কথাও বললেন না। এর অর্থ কী? ওদের জন্য কি মানবাধিকার নেই?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads