গত দুই দিনে কতগুলো মারাত্মক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। এসব ঘটনাবলী দেখে শুধু মাত্র বুদ্ধিজীবীরা নন, দেশের শিক্ষিত সচেতন সমাজ রীতিমত শংকিত এবং আতংকিত। এসব ঘটনাবলীর গতি, দ্রুততা এবং ধরন দেখলে বোঝা যায় যে সরকার শুধুমাত্র এক তরফা নির্বাচন করার জন্যেই এগিয়ে যাচ্ছে না, এই এক তরফা নির্বাচনের পেছনে তাদের একটি ভয়ঙ্কর দুরভিসন্ধিও রয়েছে। আর সেটা হল, দেশে বাকশাল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা তথা একদলীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সারা পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম এই যে, একটি সরকার যতই স্বৈরতান্ত্রিক হোক না কেন, অন্তত নির্বাচনকালে তারা কিছুটা উদারপন্থী আচরণ করে এবং গণতন্ত্রের ন্যূনতম আচরণবিধি মেনে চলে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার করছেন ঠিক তার উল্টা। যতই দিন যাচ্ছে তার সরকার ততই স্বৈরাচারী হচ্ছে। দেশকে ততই তারা একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
শনিবার ভোর রাত ৪টায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটি সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে। তারা বিএনপি অফিসের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক পথে ঢোকেনি। অর্থাৎ সিঁড়ি ব্যবহার করেনি। তারা মই বেয়ে ওপর তলায় উঠে যেখানে জনাব রিজভী থাকতেন। তারা বাইরে থেকে জানালার কাচ ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে। অতঃপর যে রুমে রিজভী আহম্মেদ থাকতেন সেই রুমের দরজায় লাথি মারা শুরু করেন। তাদের লাথির শব্দে রিজভী আহমেদ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং বলেন যে, এসব কা- না করে স্বাভাবিকভাবে এসে তাকে গ্রেফতার করতে পারতো। তারা শুধুমাত্র রিজভীকে গ্রেফতারই করেনি, অফিস সহকারী বেলাল আহমেদকেও গ্রেফতার করে। ইতোমধ্যেই বিএনপি অফিসে হামলার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদের ক্যামেরাসহ অফিসে হাজির হন। পুলিশ একাধিক ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে তাদের টিভি ক্যামেরা কেড়ে নেয় এবং ঐ সব ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গ্রেফতারের আশঙ্কায় যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ মাসাধিককাল থেকে বিএনপি অফিসেই অবস্থান করছিলেন। রিজভীর গ্রেফতারের পর অপর যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি টিভি সাক্ষাৎকারে সালাউদ্দিন আহম্মেদ রিজভী আহম্মেদকে বিপ্লবী যুগ্ম মহাসচিব এবং সময়ের সাহসী সন্তান বলে আখ্যায়িত করেন। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক অফিসে পুলিশের এই হামলা বর্বরোচিত। তবে এটাই তাদের প্রথম হামলা নয়। এর আগেও তারা বিএনপি অফিসে হামলা করে। সেবার তারা অফিস তছনছ করে। এবারও তারা তছনছ করল। সেবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৫৮ জন সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। সেবার নানা টালবাহানা করে ঐ ১৫৮ জন নেতাকে প্রায় পৌনে ২ মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়। অবশেষে উচ্চ আদালত তাদের জামিন দিলে আওয়ামী সরকার তাদের কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়।
রিজভী আহমেদকে গ্রেফতার করার পূর্বে সরকার বিএনপি ও ১৮ দলের ১৬ জন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার আওয়ামী ক্যাডারের মতো স্পর্ধা সহকারে বলেন যে, যারা মানুষ হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হবে।
দুই.
অবরোধের শেষ দিনে সন্ধ্যা বেলায় বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করার অভিযোগে যে ১৭ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর সদস্যসচিব আবদুস সালাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি মাহিদুল ইসলাম হিরু, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, ঢাকা মহানগর উত্তরের ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির রওশন, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, যুবদলের মহানগর উত্তর সভাপতি মামুন হাসান এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির সমগ্র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্য কথায় এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপিকে সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বশূন্য করা হচ্ছে। এর আগে তারা একই রকম ঠুনকো অভিযোগে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ৫ নেতাকে গ্রেফতার করেছে। এই ৫ নেতা হলেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সংসদ সদস্য এম কে আনোয়ার, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং জনাব শিমুল বিশ্বাস। এই সরকার এমন উন্মাদ এবং হিং¯্র হয়ে উঠেছে যে, তারা এই ধরনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ৮ দিনের রিমান্ডে নেয়। তবে এসব নেতার কপাল ভালো যে, ২৪ ঘণ্টা পরেই হাইকোর্ট সেই রিমান্ড স্থগিত করে। এর পর তাদের মুক্তির আবেদন জানানো হলে, অধিকতর শুনানির প্রয়োজন, এ কথা বলে তাদের মুক্তি আটকে রাখা হয়। ওপরের এই তালিকা এবং বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির সমস্ত সিনিয়র নেতা হয় কারাগারে আটক রয়েছেন, না হয় পলাতক রয়েছেন।
ইতঃপূর্বে আওয়ামী সরকার ১৮ দলের অন্যতম বৃহৎ শরিক দল জামায়াতে ইসলামীকে প্রচ- দমন নীতির দ্বারা কোণঠাসা করেছে। জামায়াতের প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারি ও তৃতীয় সারির সমস্ত নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। এরপরেও যে সব মধ্যম সারির নেতা রয়েছেন তাদের সকলেই আন্ডার গ্রাউন্ডে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতিকে শুধু গ্রেফতার করাই হয় নাই, গ্রেফতারের পর রিমান্ডের নামে তার ওপর এমন ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে যে, তিনি পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তিন.
গত শনিবার অবরোধ কর্মসূচি পালনের পরিবর্তে ১৮ দলীয় নেতৃত্ব এই শনিবারে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। ঘোষণায় কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, এই বিক্ষোভ কর্মসূচি যেন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হয়। বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠানের কথা ছিল। গত শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সভার অনুমতির জন্য বিএনপি নেতৃবৃন্দ পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে ছোটাছুটি করেন। সন্ধ্যার পর বিএনপিকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয় যে, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি বিএনপি তথা ১৮ দলকে দেয়া হবে না। তখন বাধ্য হয়ে বিএনপিকে শনিবার থেকে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়।
যে কথা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করেছিলাম সেই কথায় আবার ফিরে যাচ্ছি। এই সরকার মুখে বলছে যে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং কোনরূপ জুলুম-নির্যাতন পক্ষপাতিত্ব করা হবে না। কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে। এটিই স্বাভাবিক। পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনকালীন সরকার শুধুমাত্র দৈনন্দিন রুটিন কাজ ছাড়া নীতিগত এবং গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। কিন্তু হাসিনা সরকার সব কিছুরই ব্যতিক্রম। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি সম্পাদন করেছে। স্বাভাবিক সরকারের সময়েও অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তি জাতীয় সংসদে পেশ করতে হয়। অথচ টিকফা চুক্তির ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে সংবিধান লংঘন করা হয়েছে। যেদিন বলা হয়েছে যে আর সংসদের অধিবেশন বসবে না, যেদিন বলা হয়েছে যে সেটিই ছিল সংসদের শেষ অধিবেশন, তার পরদিন টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এত বড় বেআইনী কাজের পেছনে একটি মাত্র কারণ ছিল। আর সেটি হল, হাসিনা সরকারের প্রতি রুষ্ট মার্কিন সরকারকে খুশি করা। একদিকে বিরোধী দলকে বলা হচ্ছে নির্বাচনে আসুন, আবার অন্যদিকে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের পাইকারী হারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্ব শর্তই হলো সব দল মত প্রকাশের সমান সুযোগ পাবে। অথচ হাসিনা সরকার কোনো মিছিল করতে দিচ্ছে না। এমন কি মিটিংও করতে দিচ্ছে না।
একদিকে তারা আলোচনার কথা বলছে, অন্যদিকে তারা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। আলোচনার কথা বলে আবার ২রা ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ঘোষণা করেছে। পাঠক ভাইয়েরা বলুন, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পরে কি আর আলোচনার কোনো সুযোগ থাকে? ঐ দিকে বর্তমান সংসদকে শুধুমাত্র অক্ষতই রাখা হয়নি, ঐ সংসদের ৯০ শতাংশ সদস্যকে আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। এর অর্থ হলো তাদের পদ শূন্য হল না, অথচ সে পদে আবার নির্বাচন হচ্ছে। আইনের ক্ষেত্রে এমন গাঁজাখুরি গোঁজামিল অবস্থা জীবনে শোনা যায় নাই।
আওয়ামী লীগের নীলনকশা হলো এই যে, ইলেকশনের পরিকল্পনা এমনভাবে রচনা করা যাতে করে নির্বাচনী সীমার চারদিকে বেড়া দেয়া হয়, যাতে করে বিএনপিসহ ১৮ দল সেই বেড়া ডিঙ্গিয়ে নির্বাচনী অঙ্গনে না আসতে পারে। এরপর নির্বাচনটি পার করতে পারলে তাদের আর পায় কে। তাদের পূর্বসূরি শেখ মুজিবর রহমানের কীর্তিকে অনুসরণ করা এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সেই পথেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ, সুপরিকল্পিতভাবে। সেই নীলনকশা বস্তবায়নের জন্য তারা অনুসরণ করেছে সেই মহাজনী পন্থা, “যখন যেমন তখন তেমন ইয়া হোসেন”।
জাতির সামনে মহাদুর্যোগ। আকাশে সেই মহাদুর্যোগের ঘনঘটা। কবি নজরুল ইসলামের কবিতা দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।
দুর্গম গিরি কান্তার মরু
দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে
যাত্রীরা হুঁশিয়ার।