বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
জনাব স্পিকার,
আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে ধন্যবাদ। নবম জাতীয় সংসদের সবর্শেষ বাজেট সেশন এটি। জাতীয় জীবনের এক ক্রান্তিকালে বর্তমান অধিবেশনটি চলছে। এই অধিবেশনেই নতুন স্পিকার হিসেবে আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন।
আমি আমাদের ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন জাতীয় সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযদ্ধের বীর শহীদদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি এদেশের বীর জনগণ ও জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ও জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে তাঁরা গৌরবময় অবদান রেখেছেন। আমরা কাউকে খাটো করে দেখতে চাই না। সকলকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে চাই। প্রত্যেকের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের ভার ছেড়ে দিতে চাই ইতিহাসের ওপর। আমি বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের তরফ থেকে বিশেষ করে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি স্বাধীনতার মহান ঘোষক, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি। তিনি এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। যে গণতন্ত্র ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক পরম লক্ষ্য। একদলীয় বাকশাল শাসন চালু করে সেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিলো। জনগণের মৌলিক অধিকার, বাক-ব্যক্তিসংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কারণেই আজ সংসদে আমরা বিরোধীদল হিসেবে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। আমি অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের জনগণকে। তারা দীর্ঘ সংগ্রাম করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ১৯৯১ সালে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছিলেন। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমরা দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের সুযোগ পেয়েছিলাম। যার কারণে জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছিলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক।
মাননীয় স্পিকার,
আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও বাধা-বিঘœ সত্ত্বেও সংসদীয় রীতিনীতি অনুশীলনের একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। এই ঐতিহ্য স্থাপনে যে-সকল দক্ষ ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ভূমিকা রেখেছেন, আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। জাতীয় সংসদে আমরা সরকারি দল এবং বিরোধী দল হিসেবে অতীতে ভূমিকা পালন করেছি। গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এবারের মতো পরিবেশ আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি। সংসদ মেঠো বক্তৃতার জায়গা নয়। কিন্তু এবার গোড়া থেকেই এই সংসদে যে ভঙ্গি ও ভাষা ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়। সরকারি দলের দায়িত্বশীল সদস্যরা, মন্ত্রীবর্গ, এমনকি সংসদ নেতা পর্যন্ত বিরোধীদল ও আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় যেসব নোংরা ইঙ্গিত করে আসছেন, তাতে রুচিশীল মানুষ মর্মাহত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের, আমার, আমার পরিবারের সদস্যদের এবং বিরোধীদলের নেতাদের সম্পর্কে যেসব উক্তি করা হয়েছে, তা শোনারও অযোগ্য। এ ধরণের বক্তব্য শুনে আমরা অভ্যস্ত নই। এসব কুৎসিত বক্তব্যের জবাব দেয়া আমার রুচিবোধ ও পারিবারিক শিক্ষার বিরোধী। সে কারণেই আমরা এবারের এই সংসদ কার্যক্রমে অংশ নিতে বিব্রত ও লজ্জাবোধ করি। আমরা তাদেরকে শুধু একটি কথা বলতে চাই। অনেক সময় নীরবতা ও উপেক্ষাই হচ্ছে নোংরামির উৎকৃষ্ট জবাব। জাতীয় সংসদে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার হচ্ছে, তাতে রাজনীতিবিদদেরকে নাগরিকরা কী চোখে দেখছেন, নতুন প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কী শিখছে এবং তরুণ সংসদ সদস্যরা কী ধরনের ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত হচ্ছেন, সেটা আমাদের তলিয়ে দেখা দরকার। আমরা যদি গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাই, সংসদীয় রীতিনীতি অক্ষুণœ রাখতে চাই, তাহলে এই সংসদের পরিবেশ এতোটা কলুষিত কেন হলো Ñ সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতেই হবে। কেবল দুইদিকের নবীন সদস্যদের দোষারোপ করে, তাদেরকে ভর্ৎসনা করে, কেবল তাদের কথা এক্সপাঞ্জ করে কোনো লাভ হবে না।
সম্মানিত স্পিকার
নবম জাতীয় সংসদের গঠনপর্বে সংসদ নেতা অঙ্গীকার করেছিলেন, বিরোধী দলকে সংখ্যাশক্তি দিয়ে বিবেচনা করা হবে না। বিরোধী দলকে মর্যাদা ও গুরুত্ব দেয়ার লক্ষ্যে তিনি কথা দিয়েছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করবেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার অনেক ওয়াদার মতোই এই প্রতিশ্রুতিও সময়ের ¯্রােতে ভেসে গেছে। জাতীয় সংসদের ভেতরে এবং বাইরে বিরোধীদলের সঙ্গে গত সাড়ে চার বছরে কী আচরণ করা হয়েছে, তা এদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এসব কারণে বিগত বাজেট অধিবেশনগুলোতে আমরা অংশগ্রহণ না করলেও জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে আমরা প্রতিবারেই সংসদের বাইরে আমাদের বাজেট ভাবনা উপস্থাপন করেছি। যা মিডিয়া ও সুধীমহলে সমাদৃত হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে দেশবাসী আমাদের অবস্থান জানতে পেরেছেন। তবে সরকার কখনো আমাদের সুপারিশ ও প্রস্তাবনার কোনো কিছুই গ্রহণ করেনি। এবারের বাজেট অধিবেশনে সরাসরি অংশ নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে আমি আমার এই বক্তব্যে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। আমার আজকের বক্তব্যের প্রথম পর্বে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক তথা জাতীয় জীবনে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং দ্বিতীয় পর্বে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে কথা বলবো।
মাননীয় স্পিকার,
জাতীয় জীবনের নানাবিধ শোকাবহ ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংসদের চলতি অধিবেশন শুরু হয়েছে। সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এগারোশ’য়ের বেশি শ্রমজীবী নারী-পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কতজন মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। এখনও অনেকে তাদের নিখোঁজ স্বজনের লাশের খোঁজে আহাজারি করছে। অনেকে অঙ্গহানি হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে অনেক অসহায় শ্রমজীবী মানুষ। যাদের শ্রমে-ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আমরা সচল রাখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় মর্মান্তিক ভবন ধসের ঘটনা অতীতে আর কখনও ঘটেনি। এর আগে তাজরীন গার্মেন্ট-এর ভয়াবহ অগ্নিকা-ে একশ’ তেরো জন কর্মী জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। যারা শোচনীয়ভাবে প্রাণ হারিয়েছে আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। যারা আহত হয়েছেন, বিকলাঙ্গ হয়েছেন, তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। বিধ্বস্ত রানা প্লাজা থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে দু’জন নাগরিক জীবন দিয়েছেন। তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শদ্ধা জানাচ্ছি। রানা প্লাজার উদ্ধারকাজে যেসব নিবেদিতপ্রাণ সাধারণ মানুষ দিনরাত নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন, আমি তাদের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সামরিক বাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মী উদ্ধার তৎপরতায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদেরকেও জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ যেসব প্রতিষ্ঠান পঙ্গু ও আহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে তাদের জন্য রইল আমাদের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতাবোধ। ধারাবাহিক কয়েকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ফলে পোশাক কারখানার কর্মীদের জীবনমান ও সমস্যার প্রতি দেশে-বিদেশে সকলের নজর পড়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের জন্য একটা বড় দুঃসংবাদ এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। কাজেই বিষয়টিকে আর খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যার নিরসন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা। গার্মেন্ট শিল্পের কর্মীদের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গার্মেন্ট খাতে সাধন করতে হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ ক্ষেত্রে মালিক, কর্মজীবী, সরকার ও ক্রেতাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই শিল্পের দারোদ্ঘাটন করেছিলেন। এই শিল্পের বিকাশে আমরা সাধ্য অনুযায়ী ভূমিকা রেখেছি। বিকাশমান এই শিল্প এখন কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এই শিল্প সংকটে পড়লে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল দিকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমি বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ, জাপান, কানাডাসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি আমার আবেদন থাকবে, তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ না করেন। কারণ যে শ্রমজীবী মানুষের স্বাথর্ রক্ষার নামে এই কঠোর সিদ্ধান্ত তা প্রকৃতপক্ষে তাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
মাননীয় স্পিকার,
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এখন জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন প্রচারণা শুরু করেছে। বলা হয়েছে, আমি নাকি চিঠি দিয়ে জিএসপি সুবিধা বন্ধ করেছি। আমার পক্ষে এধরনের কোনো চিঠি দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। কেউ কেউ বিদেশী একটি পত্রিকায় আমার নামে প্রচারিত একটি লেখার কথা বলেছেন। আমি এমন কোনো লেখা পাঠাইনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আমি জিএসপি সুবিধা বহাল রাখা এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাককে এই সুবিধার আওতায় আনার সুপারিশ করেছি। আমি আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টসহ সকল রফতানি পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার জন্য আবারও জোরালো আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারের উদ্দেশে বলবো, নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। দেশবাসী জানেন, বাংলাদেশে সাহায্য বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে কারা বিদেশে চিঠি লিখেছে। কারা বাংলাদেশকে ব্যর্থরাষ্ট্র বলে বিদেশে জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। আজ এই স্পর্শকাতর সময়ে তাই এসব প্রচারণা বন্ধ করা দরকার। তবে, আমাদের সকলকে একথাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। কাজেই আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর দিকে দুনিয়ার কেউই চোখ বন্ধ করে থাকে না।
জনাব স্পিকার, রাজধানীর মতিঝিল এলাকার শাপলা চত্বরে ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর ব্যানারে অবস্থানরত আলেম-ওলামা, মাদরাসার ছাত্রশিক্ষক ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিতাড়িত করতে গত ৫ মে দিবাগত গভীর রাতে যে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়, তা আমাদের জাতীয় জীবনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। পুরো ঘটনাটির উদ্দেশে, প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি এখনও রহস্যের অন্ধকারে ঢাকা। সরকারের পক্ষে থেকে এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে, তাতে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হবার বদলে তা আরো ঘণীভূত হয়েছে। আলেম সমাজের তরফ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, আলো নিভিয়ে রাতের অন্ধকারে তাদের উপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালানো হয়েছে। তারা অভিযানের যে বিবরণ দিচ্ছেন ও হতাহতের যে সংখ্যা উল্লেখ করছেন, তাতে শিউরে উঠতে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে সৃষ্ট গভীর বেদনাবোধ নিরসনের কোনো চেষ্টা সরকার করছে না। বরং প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা নানা ধরনের উপহাস-পরিহাস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করেই চলেছেন। এর পরিণাম কখনো শুভ হতে পারে না। আমরা দেখেছি, কিছুদিন আগে বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েব সাইটে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম পবিত্র ইসলাম, আল্লাহ ও মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা:) সম্পর্কে একশ্রেণীর বিপথগামী লোক কুরুচিপূর্ণ কুৎসা রটনা করে। এতে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এ ধরনের হীন কার্যকলাপ বরদাশ্্ত করা হয় না। উচ্চ আদালত থেকে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। দুঃখের বিষয়, সরকার এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। এই ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের কেউ কেউ শাহবাগের মঞ্চে নেতৃত্ব দিতে থাকে। শাহবাগের সমাবেশের প্রতি সরকারের আনুকূল্য ও সার্বিক সহযোগিতা ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। তাদের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, সরকার ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের পক্ষ নিয়েছে। সরকারের সমর্থন ও আস্কারাতেই এই ধর্মদ্রোহীরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার সুযোগ পাচ্ছে। এই পটভূমিতেই আলেম সম্প্রদায় এবং কওমী মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত হেফাজতে ইসলাম নামের অরাজনৈতিক সংগঠনটি শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। এই সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে আমরা সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের বিভিন্ন সময়ে বৈঠক, দেন-দরবার ও আলোচনা করতেও দেখেছি। ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ ও শাপলা চত্বরে সমাবেশ কর্মসচি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদেরকে অভিনন্দন জানান। তিনি তাদের ১৩ দফা দাবিও বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির দু’দিন আগে ৩ মে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী কেবল এই সংগঠনের বিষয়েই এক সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, হেফাজতের ১৩ দফা দাবির অনেকগুলো বাস্তবায়ন করা আছে। বাকী দাবিগুলোর মধ্যে যেগুলো যৌক্তিক, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হবে। এরপর হঠাৎ করে কী ঘটলো তা আজও রহস্যই হয়ে আছে। হেফাজত অনেক আগেই ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলো। ৫ তারিখ সেই কর্মসূচি পালনের পর তারা সরকারের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করতে আসে। এই আসার পথেই নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে তারা সরকারি দলের লোকদের বাধার মুখে পড়ে। সরকার সমর্থক সন্ত্রাসী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ হামলায় অনেকেই হতাহত হয়। সরকারি সূত্রে শাপলা চত্বরের বাইরে মোট এগারো জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। সরকারি দলের এই ক্যাডারদের আগে থেকেই কেন জড়ো করে রাখা হয়েছিলো তার জবাব পাওয়া যায়নি। শাপলা চত্বরে হেফাজতের মূল সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম ও বিজয়নগর এলাকায় সংঘর্ষ ও নাশকতামূলক তৎপরতা চলে। সেখানে পবিত্র কুরআন শরীফসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ পোড়ানো হয়। যানবাহনে আগুন দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও লুঠতরাজ করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবীধারী বেশ কয়েকজনকে এইসব সন্ত্রাসী তৎপরতায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তাদের হামলার চিত্র বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে। অথচ ৫ মে বিকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ এক সংবাদ-সম্মেলনে ঐ সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য হেফাজতে ইসলামকেই দায়ী করেন। তিনি তাদের ‘রাজাকার-আলবদরের নতুন প্রজন্ম’ বলে উল্লেখ করে অবিলম্বে ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ দেন। অন্যথায় হেফাজতে ইসলামকে গর্তে ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। সৈয়দ আশরাফ বলেন, হেফাজতকে দমন করতে আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। শাপলা চত্বরে অবস্থানরত নিরস্ত্র আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর গভীর রাতে বিজেবি, র্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী দিয়ে অভিযান চালানো হয়। সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, ঐ অভিযানে কোনো প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। বলা হচ্ছে, একটি গুলীও ছোঁড়া হয়নি। অথচ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, সেদিন প্রায় দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে। হেফাজত দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে সাত হাজারের বেশি সদস্য সরাসরি অংশ নেয়। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ তাদের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলেছে যে, এ পর্যন্ত ৬১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও অভিযানে অনেকের হতাহত হবার খবর প্রচার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভয়াবহসব ভিডিও চিত্র দেখা যাচ্ছে। আহত ও নিহতের সংখ্যা যাই হোক না কেন, এই ঘটনায় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। কারণ শাপলা চত্বরের অভিযান সরাসরি সম্প্রচারের কারণে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে দুটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। তারা এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, দেশের কোনো সংবাদ মাধ্যম অভিযানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে সারা রাজধানী জুড়ে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। শাপলা চত্বর অভিযানের পর অনেকেই এখনও ফিরে যাননি। অনেক নিখোঁজ রয়েছেন। মসজিদ, মাদরাসাগুলোতে এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এই ঘটনায় আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিরাট ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে তার নিরসন ঘটাতে না পারলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ দুঃখের বিষয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনও আলেম ওলামা এবং মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা দিয়ে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা এই অপরিণামদর্শিতার আশু অবসান চাই। সংঘাত ও বলপ্রয়োগ নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে সমাজের বিরাজমান দ্বন্দ্ব ও দাবি নিরসনের জন্য বার বার আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে বিরোধিতার জবাব দিচ্ছে রক্তক্ষয়ী পথে। হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে। শাপলা চত্বর অভিযানের পর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ¯া^ধীন তদন্তের জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠা সত্ত্বেও সরকার তা মানছে না। এই হঠকারিতার পথ পরিহারের জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
মাননীয় স্পিকার,
একের পর এক দুঘর্টনা ও দুর্যোগের ফলে জাতি যখন আড়ষ্ট ও বিমূঢ়, তখন দুয়েকটি সুসংবাদ স্বস্তি ও আনন্দ বয়ে আনে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘ইউএস কংগ্রেশনাল এ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়েছেন। এ জন্য জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। ড. ইউনূসকেও জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। তবে স্বদেশে তিনি যেভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, তা সত্যিই দুঃখজনক। তাঁর মেধা-শ্রমে-ঘামে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও আজ হুমকির মুখে। সরকার নিয়োজিত কমিশন নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে ভেঙে ১৯ টুকরা করার সুপারিশ করেছে। আমরা এতে স্তম্ভিত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করে ফেলবে। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে এই ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সেই প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের উদ্দেশ্যে প্রতিশোধমূলক চক্রান্ত বন্ধের জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। দেশের মানুষ এ ধরনের হীন কার্যকলাপ মেনে নেবে না। একটা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলা, ধ্বংস করা খুবই সহজ। কিন্তু এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অনেক কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজ। গ্রামীণ ব্যাংকের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব আরোপের অপচেষ্টা চলছে। আমরা এরও তীব্র বিরোধিতা করি। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো লুঠপাট করে সরকার যে অবস্থা করেছে তারা কি গ্রামীণ ব্যাংকেও সে অবস্থায় নিতে চায়? আমরা ড. ইউনূসের সমর্থনে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করছি। জাতির জন্য যারা সম্মান বয়ে আনেন সেই কৃতি সন্তানেরা যেন দেশেও মর্যাদা পান, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। না হলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।
মাননীয় স্পিকার,
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কার্যত দেশ থেকে গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত। জাতীয় জীবনে সৃষ্টি করা হয়েছে নানামুখী বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ। এর প্রতিটির কর্মপরিধি, এখতিয়ার, ক্ষমতা, আওতা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক কী হবে তা সুনির্দিষ্ট করা ছিলো প্রজাতন্ত্রের সংবিধান এবং প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতির মাধ্যমে। আজ তা ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সৃষ্টি করা হয়েছে গুরুতর সাংবিধানিক সংকট। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদেই গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে ছিলো। সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের নামে সব দল-মত নিষিদ্ধ করে ছিলো। সেই ভূতের আছর আজও রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ আজও ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। বিরোধী দলকে মেনে নিতে পারে না। তাই বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে দলীয় ক্যাডার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বাধা দেওয়ার পুরনো অভ্যাস তারা ছাড়তে পারেনি। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে রাজধানী ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। সংবিধানে বর্ণিত সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে অলিখিত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির লিফলেট, পোস্টার ছাপা ও বিতরণের কাজে পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে বাধা দেয়া হয়েছে। ছাপাখানায় অভিযান চালিয়ে আমাদের প্রচারপত্র জব্দ করা হয়েছে। এটাই কি গণতন্ত্রের নমুনা?
মাননীয় স্পিকার,
আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, গত ১১ মার্চ আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ চলাকালে আচমকা বোমা ফাটিয়ে সভাটি প- করে দেয়া হয়।
মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দের উপর নির্বিচারে গুলী চালানো হয়। আমাদের কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ অনেকে গুরুতর আহত হন। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের শরীর গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়। বিদেশে জটিল অপারেশন করে তাঁর মাথা থেকে গুলীর স্পিøন্টার বের করতে হয়েছে। তাঁর দেহে এখনও বেশ কিছু স্পিøন্টার রয়ে গেছে। পুলিশের গুলীবর্ষণের পর দলের নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আশ্রয় নিলে পুলিশ অফিসের ভেতরে ঢুকে তাদের উপর হামলা চালায়। এতে বহু নেতা-কর্মী আহত হন। পুলিশ সেদিন আমাদের কার্যালয়ে থেকে ১৫৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। পুলিশের গ্রেফতারি অভিযান থেকে আমাদের পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রেহাই পাননি। তারা বিএনপি অফিসের কম্পিউটার ও মূল্যবান দলিলপত্র তছনছ করে এবং টাকা-পয়সাসহ রেকর্ডপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বিভিন্ন রুমের দরজা পুলিশ কিভাবে শাবল দিয়ে ভেঙে নেতা-কর্মীদের আটক করেছে সে দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেশবাসী দেখেছেন। একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ে এই ধ্বংসলীলা চালানোর চিত্র এদেশের ইতিহাসে এক চরম বর্বরতার নজির হয়ে থাকবে। পলিশ এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। সকলকে বের করে দিয়ে পুলিশ আমাদের কার্যালয়ে ককটেল রেখে মিডিয়া ডেকে ককটেল উদ্ধারের নাটক করে। তারপর আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশকে এভাবে রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার করলে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এভাবে মিথ্যা মামলা দায়েরে উৎসাহিত করলে দেশ পলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এতে গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়ে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি পোড়ানো ও সচিবালয়ে বোমা হামলা চালাবার মতো হাস্যকর অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে। এইসব মামলায় তাকে বার বার গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিরোধী দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা একইভাবে মিথ্যা মামলা ও হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। দিনের পর দিন তাদের কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে। সারা দেশে আমাদের চার লাখেরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে। কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দিকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে।এর বিপরীত চিত্রও দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অতীতের মামলাগুলো তুলে নেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুঠপাটের মতো গুরুতর অপরাধ করেও সরকারি দলের লোকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে না। তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ সাহস পাচ্ছে না। উপরন্তু সরকারি দলের ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামীদেরকে পর্যন্ত ক্ষমা করে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আইন এখন আর স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। সরকারের ইচ্ছায় আইনের দু’ধরনের প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারি দলের জন্য এক রকম এবং বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের জন্য অন্য রকম। বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশ থেকে সুশাসন আজ সম্পূর্ণভাবে নির্বাসিত হয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
জনগণকে নিয়ে যখন আমরা রাজপথে শান্তিপূর্ণ মিছিল করি আওয়ামী লীগ তখন দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার লেলিয়ে দেয় এবং পুলিশ, র্যাব, দাঙ্গা পুলিশ ও বিজিবি জলকামান, টিয়ারগ্যাস, বোমা ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। তারা বৃষ্টির মতো গুলীবর্ষণ করে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চায়। আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যমেও আমাদের ওপর এসব নগ্ন হামলার খবর বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। গত কয়েকমাসে পুলিশের গুলীতে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। সরকারি দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় বিরোধদলীয় অসংখ্য ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। বাড়ি-ঘর, দোকানপাট লুট করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে কেবলমাত্র গ্রেফতার ও জেলজুলুমই নয়, গ্রেফতারকৃত বন্দীদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য ও নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন চালান হচ্ছে। প্রায় প্িরতটি মামলায় আদালত পুলিশের আবেদনক্রমে দীর্ঘসময়ের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করছে। রিমান্ডকালীন সময়ে বন্দীর প্রতি আচরণের উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে। অনেকেই রিমান্ড অবস্থায় জীবন সংকটে পড়েছেন। রিমা-ে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কথিত জবানবন্দি ও তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে বিরোধীদলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ অবস্থা কোনো সভ্য দেশে মেনে নেয়া যায় না।
মাননীয় স্পিকার,
বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হচ্ছে। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, কোন্ ধরনের দুর্ধর্ষ ফৌজদারি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ডান্ডাবেড়ির বিধান প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সরকারি নির্দেশে সমস্ত সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে সম্মানিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ডা-াবেড়ি পরিয়ে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত ক্ষমতা কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার ফেরে কেউ যেন এভাবে নিগৃহীত না হন সে দিকে আমাদের সবার যতœবান হতে হবে।
মাননীয় স্পিকার,
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ‘অধিকার’, ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’, ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন’, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মানবাধিকার রিপোর্ট’ থেকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যায়। আমরা মনে করি, বাস্তব পরিস্থিতি এসব রিপোর্টে বর্ণিত অবস্থার চাইতে অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ সব ঘটনা সব সময় মিডিয়া কিংবা জনসমক্ষে প্রকাশ পায় না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মারাত্মক ভয়ভীতির পরিবেশে সবকিছু প্রকাশ করতে সাহস পায় না।বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের গুম করার এক ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া অবাধে চলছে। ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজনেরা অভিযোগ করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাব এ সব ঘটনায় জড়িত। এসব ঘটনার ফলে জনমনে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে মহাখালী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩ এপ্রিল সিলেট ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমেদ দিনার এবং জুনায়েদকে একইভাবে ঢাকা থেকে অপহরণ করা হয়। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় শ্িরমক নেতা আমিনুল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হন। পরদিন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁর দুটো হাটঁ ুই ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। তাঁর ডান হাঁটুর নীচে গর্ত করে ফেলা হয়, দাঁত ও নখ উপড়ে ফেলা হয়। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরও আগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে চার বছরে দেশে ৮৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এসব গুমের ঘটনা ৭২-৭৫ সালে আওয়ামী-বাকশালী শাসনের সময় রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের স্পেশাল টিমের হাতে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীর গুপ্তহত্যার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ও অব্যাহত গতিতে চলছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক বছরে কয়েকশ’ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন।
মাননীয় স্পিকার,
আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের হরতালের দিন হরতাল প্রতিহত করার নামে শাসক দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নির্মমভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ নামে একজন তরুণ কর্মজীবীকে হত্যা করে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় বিশ্বজিতের উপর হামলার সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
দলীয়করণ করার ফলে পুলিশ পেশাগত নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলার কথা পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গেছে। আমরা গুরুতর বিভিন্ন অপরাধ দমনে র্যাব গঠন করেছিলাম। বিরোধী দল দমনের কাজে নিষ্ঠুরভাবে অপব্যবহার করে সেই বাহিনীর সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে ‘গ্রেফতার বাণিজ্য’ নামে একটি বিষয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কোথাও কোন সংঘষের্র ঘটনা ঘটলে পুলিশ কিছু লোকের নাম দিয়ে বাকি হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে আসামী করে মামলা দায়ের করে। এরপর গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এটা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এই গ্রেফতার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। নিরপরাধ কোন মানুষ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হয় এবং পুলিশ বাহিনীর সততা ও শৃঙ্খলা যেন পুরোপুরি ভেঙ্গে না পড়ে তার জন্যই এটা বন্ধ করতে হবে। আমি একথা বলছি এ কারণে যে, পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের মধ্যে নৈতিক স্খলন এখন গুরুতর এক অশণি সংকেতের পর্যায়ে পৌঁচেছে। সরকার পুলিশ বাহিনীকে যথেচ্ছভাবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নে ব্যবহার করে চলেছে ফলে পুলিশের কোনো কোনো সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুককে দৈহিক নির্যাতন করার কারণেই একজন পুলিশ অফিসারকে মেডেল দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সে কথা বলেছেন। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ অন্যায় আচরণে উৎসাহী হবে, এটাই স্বাভাবিক।
মাননীয় স্পিকার,
বর্তমান সরকার আমলে কোন ধর্মের মানুষেরই জান-মাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নেই। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একটি উস্কানিমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ৭০টি বৌদ্ধমন্দির পোড়ানো ও লুটতরাজ করা হয়। এ ছাড়াও ২৭টি বৌদ্ধ বাড়ি সম্পূর্ণভাবে এবং ৭৭টি বৌদ্ধবাড়ি আংশিকভাবে পোড়ানো হয়। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ঘটনা প্রতিরোধে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, যদিও পুরো ঘটনাটি তাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল। ২১ মার্চ সাতক্ষীরার ফতেপুর গ্রামে ৭টি হিন্দু পরিবারের উপর হামলা চালানো হয়। তাদের বাসস্থান লুট করার পর সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘর-বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও সরকার তার কোন প্রতিকার করেনি। কারণ সরকারি দলের লোকেরাই এসব হামলায় জড়িত বলে ভিকটিমরা অভিযোগ করেছেন।
মাননীয় স্পিকার,
গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতা অপরিহার্য। সে কারণেই সংবাদ মাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘ফোর্থ এস্টেট’ হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকতা শৃঙ্খলিত। সাংবাদিকদের উপরে সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়, গত সাড়ে চার বছরে সারাদেশে সহ¯্রাধিক সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সস্ত্রাসী ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হাতে তারা নির্যাতিত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ১৬ জন সাংবাদিক। গ্রেফতার, মামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন অনেকেই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-ের রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তারা নিজ বাসগৃহে নৃশংসভাবে খুন হয়। স¦রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধীর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত রহস্য উদঘাটিত হয়নি। গত মে মাসে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ছাপাখানা সীলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে পত্রিকাটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার দেশ-এ কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীরা অনিশ্চিত জীবন-যাপন করছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সরকারের দমন পীড়ন ও দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বলেই তার উপর এই নির্যাতন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়ে বিচারের নামে প্রহসনের চিত্র তুলে ধরার কারণেই পত্রিকাটি সরকারি রোষানলের শিকার হয়েছে। অথচ এই কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে একজন বিচারক আইসিটি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহের সম্পাদকবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে আমার দেশের পুনঃপ্রকাশ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। আমরাও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করি। অবিলম্বে আমার দেশ পুনঃপ্রকাশের বাধা অপসারণ ও মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার দাবি করছি। একই সময় সরকার দুটি জনপ্রিয় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ‘দিগন্ত টিভি’ ও ‘ইসলামি টিভি’ চ্যানেলও বন্ধ করে দেয়। এ চ্যানেল ২টি মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ লাইভ টেলিকাস্ট করছিল। এই সরাসরি সম্প্রচারের ওপর সরকারের কোনো নিষেধাজ্ঞাও ছিল না। এর আগে সরকার চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছে। যমুনা টিভির সম্প্রচারের অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। আমরা এই চ্যানেলগুলোও পুনরায় চালু করতে দেয়ার আহ্বান জানাই। ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সোস্যাল মিডিয়াগুলো সরকারের মারাত্মক অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছে। হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে গণমাধ্যমকে নতজানু ও অনুগত করে রাখা হচ্ছে। অদৃশ্য হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ ও টকশোগুলো। টকশোগুলোতে আলোচক হিসেবে কারা অংশ নেবে তার তালিকাও সরকারের বিশেষ সংস্থা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। অনেক জনপ্রিয় আলোচককে কালো তালিকাভূক্ত করা হচ্ছে। তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কেউ কেউ হামলার শিকারও হচ্ছে। টকশোগুলোতে যারা সরকারের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও তাদের সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। বলেছেন, তারা না-কি মধ্যরাতের ‘সিধেল চোর’। প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের উক্তি শোভা পায় না। এই অসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রে চলতে পারে না।
মাননীয় স্পিকার,
বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের সর্বস্তরে যে দলীয়করণ হয়েছে তা নজিরবিহীন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই বলেন, আওয়ামী লীগের লোক ছাড়া কাউকে কোথাও নিয়োগ দেয়া হবে না। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ১৮৮০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। বর্তমানে সচিব হতে সহকারী সচিব পর্যন্ত ৬০০ জন কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। এদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হবে বলে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ৫ জনকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটিই। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাখা। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন পদে ৮ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এসব অনিয়ম, অবিচার, অন্যায় সবই করা হচ্ছে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে। প্রশাসনে বর্তমানে মেধা, জেষ্ঠ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পদোন্নতির মাপকাঠি নয়। একদিকে দলবাজ ও অদক্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, অপর দিকে মেধাবী, দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হচ্ছে। ফলে প্রশাসন হয়ে পড়েছে অদক্ষ ও অকার্যকর। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলীয় ব্যক্তিদের হাতে। এর ফলে রাষ্ট্র তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে এবং সুশাসন চলে গেছে নির্বাসনে। আমি বিশদ বিবরণ ও পরিসংখ্যান দেব না। নির্যাতন-নিপীড়ন, গুপ্তহত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, দখল, দলীয়করণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস আজ সারা বাংলাদেশকেই এক উপদ্রুত জনপদে পরিণত করেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ শাসক দলের সহযোগী সংগঠনগুলো আজ মানুষের সামনে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। মানুষ আজ আতঙ্কিত। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কষাঘাতে জর্জরিত। কোথাও শান্তি ও স্বস্তি নেই। সুযোগ পেলেই জনসাধারণ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের চারটি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে দেয়া গণরায় তারই প্রমাণ।
মাননীয় স্পিকার,
আমরা সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক অবশ্যই প্রয়োজন। তবে তা হতে হবে পারস্পারিক স্বার্থে এবং ভারসাম্যপূর্ণ লেনদেনের ভিত্তিতে। সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বেসামরিক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন এই সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়। আমি ভারত সফরে গিয়ে এবং ঢাকায় সফরে আসা ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে এই হত্যা, নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু সরকারের দুর্বল ভারত-নীতির কারণে এই সীমান্ত হত্যা এখনও বন্ধ হয়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, কেবল ২০১২ সালে ভারতীয় বিএসএফ-এর হাতে ৩১৯ জন বাংলাদেশী নিহত এবং নির্যাতিত হয়েছেন। এর আগের বছর এ রকম ঘটনায় ১৫৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি গত ছয় মাসে সীমান্তে কোনো বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ঘটেনি বলে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেয়ার ২ দিন আগে এবং পরে একাধিক বাংলাদেশী বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছে। সীমান্তে কাঁটাতারে বাংলাদেশী কিশোরী কন্যা ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ এদেশের মানুষের মর্মমূলে যে গভীর বেদনাবোধের সঞ্চার করেছে সেই ক্ষত এখনও শুকায়নি। সেই মর্মান্তিক ঘটনা দেশে বিদেশে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের দাবিদার আমাদের দেশের সরকার এসব নির্মম ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ভারত সরকার নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৪৬ একর ভূমিতে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরামশর্ক প্িরতষ্ঠানের কাছ থেকে টেন্ডার আহবান করেছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয় যে, বিষয়টি স¤পর্কে বাংলাদেশ সরকার আদৌ অবহিত ছিল না। মাননীয় স্পিকার, আমি আপনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য কী তা দেশবাসীকে জানাবার আহ্বান জানাচ্ছি। ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়টির আজও কোন ফয়সালা হয়নি। আরও উদ্বেগের বিষয় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক স্থগিত করে দিয়েছে। অথচ অতিসম্প্রতি বাংলাদেশকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করে ভারত ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল ত্রিপুরা রাজ্যে নেয়ার ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যৌথ সমীক্ষা চালানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে কি না আমরা জানি না। এসব বিষয়েও সরকারের বক্তব্য দেশবাসী জানতে চায়।
মাননীয় স্পিকার,
বর্তমান সরকারের মেয়াদ সাড়ে চার বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফয়সালা হল না নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কি হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। আমরা বার বার বলেছি, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হলে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। দেশের মানুষের দাবিও তাই। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ অনুযায়ী দেশের ৯০% ভাগ মানুষ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন চায়। কিন্তু সরকার সেই পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। ১৯৯৬ সালে তত্তা¡বধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও তাদের তখনকার সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পাটির্ মিলে যে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল তার প্রমাণ সে সময়কার সংবাদপত্র। আমি সে সময়কার সংবাদপত্রের কিছু কাটিং আপনার মাধ্যমে এই সংসদে উপস্থাপন করছি।
মাননীয় স্পিকার,
১৯৯৬ সালে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে কারণে আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, সে কারণগুলো এখনও বিদ্যমান, বরঞ্চ পরিস্থিতি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব চাইতে বড় সমস্যা হলো, আস্থার সংকট। এই আস্থার সংকট যতদিন থাকবে ততদিন দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। শাসকদলের পক্ষ থেকে প্রায়শই যুক্তি দেখানো হয় যে তাদের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং তাদের অধীনেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। আমাদের সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত হয়নি। বর্তমান শাসকদলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় তাদের সময় সংসদের উপনির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ভোলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যেভাবে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল সেটি একটি কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে তাদের শাসনকালকে দু’বছর প্রলম্বিত করেছিলো। তাদের অপকর্মকে অন্যতম অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার মানতে অস্বীকার করছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ওটা ছিলো সম্পূর্ণ অবৈধ একটি অসাংবিধানিক সরকার। এই সরকারকে কোনক্রমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায় না। বরঞ্চ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অসাংবিধানিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নিজদের গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক দাবি করলেও বরাবরই তারা সংবিধানবিরোধী হস্তক্ষেপকে অভিনন্দন ও সমর্থন জানিয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আজ যে রাজনৈতিক সংকট ঘণীভূত হয়ে উঠেছে তার উৎপত্তি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে। এই সংশোধনীবলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোটের্র আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক মামলাকে কেন্দ্র করে যে ৮ জন এমিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের সংবিধান সংশোধন কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সুধী সমাজের মতামত আহ্বান কালে এঁরা সবাই এক বাক্যে তত্তা¡বধায়ক সরকার বিধান বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এই কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়ে ছিলো। পরবর্তীতে এই কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বহাল রাখার পক্ষে মতৈক্যে পৌঁছে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসলে প্রধানমন্ত্রী এ্যাপিলেট ডিভিশনের রায়ের অজহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়ার পক্ষে মত দেন। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ে জাতীয় ও জননিরাপত্তার স্বার্থে এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের নিরিখে অন্ততঃ পরবর্তী দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত ব্যক্ত করা হয়ে ছিলো। সংক্ষিপ্ত রায়ের একটি খ-িতাংশ “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানের মৌলকাঠামোর পরিপন্থী”-এর উপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর এহেন অবস্থানের কারণে সংসদীয় কমিটির অবস্থানও পাল্টে যায়। প্রধান বিচারপতির অবসর গ্রহণ এবং সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষিত হওয়ার ষোল মাস পর যে পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া হয় সে রায়ও সর্বসম্মত ছিল না। অবসর গ্রহণের ষোল মাস পর রায় লেখা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। তাছাড়া এই পূর্ণরায়ের আগেই সংবিধান বদলে ফেলায় এই রায়ের আর কোনো প্রাসঙ্গিকতাও থাকে না। সুতরাং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার সংক্রান্ত ইস্যুর নিরসন ক্ষমতাসীন সরকারকেই করতে হবে। কারণ সাংবিধানিক সংশোধনী আনার মতো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বর্তমান সরকারেরই আছে, বিরোধী দলের নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেব না। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দলীয় সরকার নির্বাচনের সময় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তবে আমরা মনে করি, সংঘাত নয় সমঝোতার মাধ্যমেই এ বিষয়ে একটি সমাধানে পৌঁছানো যেতে পরে। এর জন্যে প্রয়োজন সংলাপ। আর সরকারের সদিচ্ছা। সরকারি দলের তরফ থেকে উত্তেজনাকর বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। তারা বলছেন, ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করবেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে পদে বহাল রেখেই নির্বাচন হবে। এইসব যুক্তিহীন ও গায়ের জোরের কথায় সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। আমি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানাই।
মাননীয় স্পিকার,
এখন আমি বাজেটের ওপর আলোকপাত করবো। প্রথমেই বিদায়ী অর্থবছরের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অর্জিত হয়েছ ৬ শতাংশের মতো। অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সাথে সরকার প্রণীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার পার্থক্য দূর করতে হলে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হারের প্রয়োজন হবে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হবার স্বপ্ন আরো বিলম্বিত হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের হার অর্জিত হয়েছে জিডিপির ১৯ শতাংশ অথচ ষষ্ঠ পঞ্চবার্র্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎস মূলতঃ বিনিয়োগ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক ছিলনা। শিল্পের কাঁচামালের আমদানি গত বছরের তুলনায় ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি গত বছরের তুলনায় কমেছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। গত চার বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির হিস্যা হিসেবে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে নেমে ১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ যে হ্রাস পেয়েছে তার অন্যতম প্রমাণ হলো বেসরকারি খাতে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ হারে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি - অর্জিত হয়েছে মাত্র ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, চালু উদ্যোগ ও নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগ মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে। উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি, চাঁদাবাজি এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগও সন্তোষজনক নয়। সরকারি হিসেবে জিডিপির ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ দেখানো হলেও গবেষকরা বলছেন তা নেমে জিডিপির ২৪ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ‘ডুয়িং বিজনেস’ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় ৫ ধাপ নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ ঋণ প্রাপ্তি, কর ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে কোনো আশাবাদ হয়েছে সুদূর পরাহত। বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয়ের হারও এই মুহূর্তে উদ্বেগের কারণ। সঞ্চয়ের হার গত অর্থবছরে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে বিদায়ী অর্থবছরে ২৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবার একটা বড় কারণ হচ্ছে, ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে ব্যাপক লুটপাট ও চরম অব্যবস্থাপনা। শেয়ার মার্কেট ধসের কারণে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথের ভিখারী হয়েছে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। প্রায় লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের সাথে জড়িতরা তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত হলেও সরকারের নিকটজন হওয়ায় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। পুঁজি বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করে বরঞ্চ এই বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী তাদেরকেই বিষয়টি সমাধান করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শেয়ার মার্কেট থেকে লুট করা হাজার হাজার কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত করে বিদেশে পাচার হয়েছে বলে সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা।
মাননীয় স্পিকার,
সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে দক্ষ পেশাদার লোকদের নিয়োগের পরিবর্তে অনভিজ্ঞ ও সরকারদলীয় লোক নিয়োগ দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলোর শৃংখলা ভেঙ্গে পড়েছে এবং দুর্নীতি ও লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ইউনি-পে-টু-ইউ এবং সর্বশেষে বেসিক ব্যাংকে এমন সব মহাদুর্নীতি ধরা পড়েছে, যা আর্থিক খাতের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে, যার বিচার সরকার এখনও করতে পারেনি বরং লুটেরাদের পুনরায় ঋণ দিয়ে তাদেরকে সচল করারও প্রচেষ্টা অর্থমন্ত্রীর ছিল। অবাক ব্যাপার হচ্ছে তিনি জনগণের বিপুল অঙ্কের অর্থের এই তছরুপকে ‘সামান্য’ ব্যাপার বলে উল্লেখ করেছেন। পত্রিকা খুললেই প্রতিদিন ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির নতুন নতন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত করলে হয়তো আরো বিপল অংকের দুুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পাবে। ব্যাংকিং সেক্টরে সর্বগ্রাসী অর্থ-কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের পরিমাণ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি সংগঠিত ঋণ অনিয়মের কারণে ঝুঁকি নির্ভর সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এদের বিপুল ঘাটতির কারণে সামগ্রিক ব্যাংক খাতেই এখন মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে, ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার বর্তমান ১৭-১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনতে পারছে না। অপরদিকে এত চড়াসুদে বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হচ্ছে না। সম্প্িরত সরকার তাদের ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক স্থাপনের জন্য ৪ শত কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিতে হয়েছে। অথচ যাঁরা ব্যাংক করলেন তাদের অর্থের উৎস অদ্যাবধি অস্বচ্ছই রয়ে গেছে।
মাননীয় স্পিকার,
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ সুবিধা সম্প্রসারণে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের বিকল্প নেই। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কারণে এ সরকার বাংলাদেশের ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, আইডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুন্ঠিত হয়েছে। সরকার অস্বীকার করলেও কানাডার আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এবং তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে কত শতাংশ পাবেন বা পেতে যাচ্ছেন তার হিসাব দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের বর্তমান মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার তোড়জোর শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য কোন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে এই অর্থবছরে বাজেটে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। অথচ স্বল্প সুদে বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা করলে আমরা এই অর্থ দেশে জনকল্যাণমূলক অন্য খাতে ব্যবহার করতে পারতাম। দেশীয় অর্থায়নে এই বিশাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব এ নিয়ে এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ মহলে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
বিদায়ী অর্থবছরের এপ্রিল ২০১৩ পর্যন্ত রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ১ শতাংশ যা লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশ কম।
অথর্বছরের প্রথম ৮ মাসে আমদানির ব্যয় প্রবৃদ্ধি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি। শিল্পের পুঁজি-যন্ত্রপাতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক আমদানির তুলনায় পুঁজি-যন্ত্রপাতির আমদানি দ্রুততর হারে হ্রাস পেয়েছে। শিল্পের পুঁজি-যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস, শিল্পে বিনিয়োগ যে প্রচ-ভাবে কমে গেছে তারই ইঙ্গিত দেয়। মূল্যস্ফীতির হার বিগত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহতভাবে ৮ শতাংশের উপরে রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে ৩৫-৪০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এই অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই ঘাটতি হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। এনবিআর এর রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ দমমিক ৪ শতাংশ কম হয়েছে। সরকার আয়ের উৎস নির্ধারণ না করেই বিরাট ব্যয়ের বাজেট দিয়েছে। যা কখনও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। বিদায়ী অর্থবছরে সরকারি ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধের ব্যয় সরকারের সামগ্রিক ব্যয়ের উপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ছিল মোট সরকারি ব্যয়ের ২০ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই ব্যয়ের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সরকার রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সময় অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয়ও অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এখন সে রকম একটি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মন্থর প্রবৃদ্ধির মুখে এই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভর্তুকির জন্য সরকারের মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৩ শত ৬৮ কোটি টাকা। এই অংক পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে কেবলমাত্র বাংলাদেশ পেট্ট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দেয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার ২ শত ৩০ কোটি টাকা এবং পিডিবিকে ৫ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। আর কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশনগুলো তরল জ্বালানি নির্ভরশীল হওয়ায় বিপিসিকে এত বিপুল অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এসব কুইক রেন্টালের অনেকেই আবার প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই চুক্তির শর্তানুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ এর নামে সরকার থেকে ভর্তুকি পাচ্ছে। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতির রক্তক্ষরণ অব্যাহত আছে।
মাননীয় স্পিকার,
সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা বর্তমানে ৯ হাজার ৫ শত ৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৬৬ শতাংশ সরকারি খাতে এবং অবশিষ্ট ৩৪ শতাংশ বেসরকারি খাতে। কিন্তু সরকারি খাতে উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার ৪২ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশ। বেসরকারিখাতে উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার ৮৩ শতাংশ থেকে ৯১ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত উৎপাদনের দিক থেকে বেসরকারিখাত খুবই ব্যয়বহুল। অন্যদিকে সরকারি খাতের বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও নবায়ন না করার ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই প্ল্যান্টগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে অনেক কম। বেসরকারি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন থেকে ক্ষমতাসীন দলীয় ব্যক্তিবর্গ এবং মালিকপক্ষকে, সংসদীয় দায়মুক্তির বর্ম ব্যবহার করে জবহঃ ংববশরহম-এর সবিধা করে দেয়ার জন্য সরকারিখাতের বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর প্রতি ক্ষমাহীন উপেক্ষা প্রদর্শন করা হচ্ছে। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে অলস বসিয়ে রেখে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে ঁহংড়ষরপরঃবফ ড়ভভবৎ-এর মাধ্যমে পেটোয়া বাহিনীকে দেয়া কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে। এর জন্য জনগণকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে এবং লোডশেডিং থেকেও জনগণ রেহাই পাচ্ছে না। কৃষিতে সেচ ব্যাহত হচ্ছে। এর অভিঘাত পড়ছে কৃষি উৎপাদনে। সরকারের কুইক রেন্টালের সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী। অর্থমন্ত্রী নিজেও তা স্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, আমাদের সময় ২০০১-২০০৬ সনের মধ্যে আমরা সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট জেনারেশন ক্যাপাসিটি স্থাপন করেছিলাম। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা যুক্ত করার জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে সুযোগ করে দেয়া হয়। অথচ বলা হয় আমাদের সময় নাকি ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করা হয়নি। আমরা জ্বালানি সাশ্রয়ী বৃহদাকার কেন্দ্র স্থাপনের যে ব্যবস্থা করে এসেছিলাম, অবাধ লুন্ঠন ও বিনা টেন্ডারে পছন্দসই ব্যক্তিবর্গকে কাজ পাইয়ে দিতে আমাদের সময়কার সকল প্রজেক্ট বাতিল করে।
মাননীয় স্পিকার,
১৯৯১ সন থেকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা অর্জিত হয়েছিল। বাংলাদেশ যেভাবে সম্মানজনক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নজির সৃষ্টি করেছিল সে সব আজ সরকারের অব্যবস্থাপনা, আনাড়িপনা, অযোগ্যতা, পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, লুট-পাট ও অপশাসনের ফলে সম্পূর্ণ ভেস্তে যেতে বসেছে। যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আমাদের সময় সৃষ্টি হয়েছিল তা আজ কেবলমাত্র ধুলিস্যাৎ হতে বসেছে। ফলে, ভবিষ্যতে যে কোনো সরকারের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে সরকার পরিচালনা দুরূহ করে রেখে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।
মাননীয় স্পিকার,
আমি এখন প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের বিষয়ে কিছ মন্তব্য করবো। পূর্বেই বলেছি ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ, এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ ২৫ হাজার ৯ শত ৯৩ কোটি টাকা। ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭ হাজার ৯ শত ৭১ কোটি টাকা যা চলতি অথর্বছরে প্রাপ্ত ঋণের প্রায় আড়াই গুণ। বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার, যা বিদায়ী অর্থবছরে প্রাপ্ত ২ বিলিয়ন ডলারের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ অবাস্তব। অর্থাৎ ঘাটতি অর্থায়নে লক্ষ্যমাত্রা আকাশচুম্বি হবার কারণে শেষ পর্যন্ত সরকারকে বর্ধিত ব্যাংক ঋণের ওপরই নির্ভর করতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় সরকার প্রায় ২৪ হাজার ৭ শত ৮৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই অতিরিক্ত রাজস্বের প্রায় ৮৪ শতাংশই এনবিআর আদায় করবে, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ২০১২-১৩ অর্থবছরেই এনবিআর তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এছাড়া এই অতিরিক্ত রাজস্বের ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ আয়কর থেকে এবং ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভ্যাট থেকে আয় করার উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। করদাতার সংখ্যা না বাড়িয়ে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাই প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক। আমাদের আশঙ্কা, বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১০ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে। মূল্যস্ফীতির হার বিদায়ী অর্থবছরে ৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে এবং এর প্রবণতাও ঊর্ধ্বমুখী। এছাড়া যেখানে একদিকে সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি এবং আরেক দিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেখানে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ২৮ হাজার ৬ শত ৯৫ কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিদায়ী অথর্বছরের তুলনায় ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ কম। কৃষিতে ভর্তুকি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা যা বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৯ শত ৫০ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ কম। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এর জন্য ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে ৫ হাজার ৫ শত কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। কৃষিতে যে ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা শুধু ইউরিয়া সারের ভর্তুকিতেই চলে যাবে। অন্যান্য সারের জন্য অতিরিক্ত ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। এর সংস্থান না হলে খাদ্য শস্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে বিপিসির ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা কম হবার কারণে জ্বালানি তেল আমদানি কমবে এবং জ্বালানি তেল নির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমান পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। এরই মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে বহুবার এবং আরও মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে জনগণের নাভিশ্বাস উঠবে।
মাননীয় স্পিকার,
বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে এবার ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ যে বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে তার ৬৮ দশমিক ৭ শতাংশই হচ্ছে পাঁচটি খাতে। এর মধ্যে যোগাযোগ খাতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে অতিরিক্ত বরাদ্দের ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কৃষিখাতে বরাদ্দ কমে গেছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেশবাসীকে বহন করতে হবে। বাজেট কেবল একটি আয়-ব্যয়ের হিসাব বা একটি অর্থনৈতিক দলিল মাত্র নয়। উন্নয়ন, উৎপাদন, অগ্রগতি, মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের মৌলিক চাহিদা, সামাজিক বিকাশ, বৈষম্য নিরসনসহ জাতীয় জীবনের প্রায় সামগ্রিক দিককেই এই বাজেট স্পর্শ ও প্রভাবিত করে। একটি সরকারের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন বাজেটে প্রতিফলিত হয়।
একটি বাজেট কতটা বাস্তবায়িত হবে এবং এর সুফল জনগণ কতটা পাবে তার সঙ্গে সরকারের সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং বিরাজমান রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা, শাসন প্রক্রিয়া, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবকিছুরই সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই কেবল বাজেটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আলোচনাই শেষ কথা নয়। বর্তমান সরকার এর আগেও পাঁচটি বাজেট দিয়েছে। তাতে দেশ ও জনগণের কতটা উন্নতি অগ্রগতি হয়েছে তা দেশবাসী তাদের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই অনুধাবন করতে পারছেন। আমরা যত বক্তৃতাই করি, যত কথামালাই সাজাই না কেন, জনগণের বাস্তব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে আড়াল করা যাবে না।
মাননীয় স্পিকার,
জনগণের প্রত্যাশার আলোকে গণতন্ত্রকেই অমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের চলার পথ হিসাবে নির্ধারণ করেছি। এটা এক পরিশীলিত পদ্ধতি।
গণতন্ত্রের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কিন্তু এই পথ ছেড়ে আমাদের বিপথগামী হলে চলবে না। ‘ট্রায়াল এ- এরর’Ñএর মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়।
গণতন্ত্রের চর্চায় কোনো ভুলভ্রান্তি হলে তা নিরসন করতে হয় আরো বেশি গণতন্ত্র দেয়ার মাধ্যমেই। গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে নয়। সহনশীলতা, মুক্তি ও স্বাধীনতাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। এই তিনটির অভাব হলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। গণতন্ত্রের বাহনে সরকার ও বিরোধীদল দুটি চাকার মতো কাজ করে। এর কোনো একটি বিকল হলে গণতন্ত্র সচল থাকতে পারে না। বিরোধীদল সমালোচনা ও জবাবদিহি করে সরকারকে গণমুখী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সেই ভূমিকা বিরোধীদলকে অবাধে পালন করার সুযোগ দিতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা কেউ-ই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। আমাদের অতীতের সবকিছুই নির্ভুল ও নিখাদ নয়। আমরা যদি কেবল অতীত চর্চা করতে থাকি তাহলে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। আমি তাই আজ এখানে কোনো অভিযোগের তীর ছুঁড়তে আসিনি। বাংলাদেশের মানুষ নানা মত ও পথে বিশ্বাসী। কাজেই সব মতকে সমন্বিত করে বৈচিত্র্যের মধ্যেই আমাদেরকে জাতীয় ঐক্যের সন্ধান করতে হবে। বিভক্ত জাতি কখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। দেশের মানুষ দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিভেদ, বিভাজন চায় না। নারী-পুরুষ, বয়স-পেশা নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ, পাহাড় সমতলের মানুষ মিলে আমাদেরকে সামনে এগুতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত ও সম্মিলিত মেধাকে জাতীয় অগ্রগতির খাতে প্রবাহিত করতে হবে। প্রবীণের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের সাহস ও কর্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের কাক্সিক্ষত উনœিত সাধন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আজ সেই দিক-নির্দেশনা ও নেতৃত্বই দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিক্ত বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আমরা তাদের সেই আশাকে ধুলায় লুটিয়ে দিতে পারি না। বাংলাদেশে বিএনপি আছে, আওয়ামী লীগ আছে, অন্যান্য দল আছে, থাকবে। আমাদের মত-পার্থক্যও থাকবে। বক্তৃতা করে, জুলুম চালিয়ে আমরা কেউ কারও মতকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবো না। তাই আসুন, আমরা বিরোধিতা সত্ত্বেও একে অপরের মতকে সম্মান করতে শিখি। আসুন, আমরা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শোভন, সুন্দর ও পরিশীলিত করি। আজকের বিশ্বে সন্ত্রাস এক বড় সমস্যা। ধনী-গরীব, উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশই এই ঝুঁকি ও বিপদের বাইরে নয়। পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে, রাজনৈতিক আদর্শের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সন্ত্রাস আমাদের শান্তিময় এই শ্যামল ভূমিকেও রক্তসিক্ত করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষের সহায়তায় কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে দমন করেছি। কিন্তু আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে আর কখনো এই সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এরজন্য আমাদেরকে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। দমন অভিযানের পাশাপাশি চালাতে হবে সন্ত্রাস-বিরোধী প্রচারণা ও নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়া। সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে কর্মমুখী। দারিদ্র্যমোচন প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় সšা¿সও অনেক সময় পাল্টা সšা¿সের জন্ম দেয়। প্রতিরোধের নামে উৎসাহিত হয় উগ্রবাদ। আর তাই সকল রাজনৈতিক মত ও শক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পথে ধরে রাখার জন্য আমাদেরকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দেশ। স্বাধীনতার পর আমাদের খাদ্য ছিলো না। দুর্ভিক্ষ ও মঙ্গায় মানুষ অসহায়ভাবে জীবন দিতো। বিদেশীদের ফেলে দেয়া পুরনো কাপড় এদেশের মানুষকে পরতে হয়েছে। গত ৪২ বছরে আমরা খুব বেশিদূর এগুতে না পারলেও বাংলাদেশ এখন সে অবস্থায় নেই। আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার পথে অনেক দূর এগিয়েছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনেও আমাদের অনেক সাফল্য আছে। নারীর ক্ষমতায়নে আমরা বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছি। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেক দূর এগিয়েছি আমরা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও আমাদের যথেষ্ট সাফল্য আছে। এসব সাফল্যের কম-বেশি অংশীদার আমরা সকলেই। কিন্তু আরো বহু পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে আমাদেরকে কেউ এসে এগিয়ে দিয়ে যাবে না। আমাদের নিজেদের কর্মপ্রয়াসেই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে দ্রুত এগুতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ খুবই সৃজনশীল এবং উদ্যমী। তাদের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে হলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের নিরসন আজ সময়ের দাবি। এজন্য গণতন্ত্রকে সংহত করতে হবে। শান্তিপূর্ণ পথে সরকার পরিবর্তনের সর্বসম্মত পন্থা আলোচনার মাধ্যমে নিরুপণ করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্ন মত ও পথের প্রতিভাবান মানুষদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। তরুণদের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য প্রয়োজন জ্ঞানভিত্তিক ও উন্নত প্রযুক্তিমুখী সমাজ গঠন এবং তাদের উদ্যম ধারণে সক্ষম বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত দুর্বল এবং নড়বড়ে। আইনের শাসন নিশ্চিত করে আমরা ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পরিনি। জাতির সকল অংশের মধ্যকার প্রাণশক্তিকে সমন্বিত করতে পারলেই আমরা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। এ জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সমঝোতার এক নতুন সিমফনি সৃষ্টি। আসুন, আমরা প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ এবং অসূয়া পরিত্যাগ করে আমাদের বাংলাদেশকে এক শান্তি ও সমৃদ্ধির নিবাসে পরিণত করি। আমাদের মিলিত অভিযাত্রা হোক একুশ শতকের আলোকিত নতুন দিগন্তে। মাননীয় স্পিকার, আপনাকে ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ, বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।