ভালো লাগুক আর না লাগুক এবং জনগণের মধ্যে ভীতি-আতংক যতোই ছড়িয়ে পড়–ক না কেন, মহাজোট নামের আওয়ামী লীগ সরকারের এসবে কিছুই যায়-আসে না। এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রমাণ একদিকে দিয়েছেন বিদেশ সফরে ‘বিশ^ রেকর্ড’ সৃষ্টির কারণে ব্যাপকভাবে নিন্দিত-সমালোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, অন্যদিকে দিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মাঝখানে আবার প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তুফান তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে শুধু নয়, অতি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে তাকে ‘সাহেবজাদা’ নামেও ডাকতে শুরু করেছেন। এই ‘সাহেবজাদার’ পাশেই সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফকে দেখা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতায় গঠিত ‘মুজিবনগর’ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যার পিতা এবং সে কারণে যাকে ‘সৈয়দজাদা’ বলে ডাকা হয়।
পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে অবশ্যই দীপু মনির দিকে দৃষ্টি ফেরানো দরকার। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, মাত্র ক’দিন আগে, গত ২২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো তেড়ে উঠেছিলেন তিনি। কারণটি ছিল তার বিদেশ সফর নিয়ে প্রকাশিত এক বিশেষ রিপোর্ট। এতে বলা হয়েছিল, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দীপু মনি নাকি ১৮০-১৯০ বার বিদেশ সফর করেছেন। অন্যদিকে দীপু মনি জানিয়েছিলেন, তিনি বিদেশ সফর করেছেন মাত্র ১১৪ বার, ১৮০-১৯০ বার নয়। দ্বিপাক্ষিক সফরের পরিসংখ্যানেও ‘গণিত-বিভ্রাট’ ছিল রিপোর্টটিতে। কারণ, দীপু মনি দ্বিপাক্ষিক সফরে গেছেন ৬২ বার, কিন্তু পত্রিকাটি লিখেছিল ১৭ বার। বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে দীপু মনি বিশ্ব রেকর্ড করেছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পর্যন্ত টপকে গেছেন বলে যে মন্তব্য রিপোর্টটিতে ছিল তারও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, বিদেশ সফরে ‘বিশ^ রেকর্ড’ সৃষ্টি সম্পর্কিত নিন্দা, বিতর্ক ও সমালোচনা চলতে থাকা অবস্থাতেই ২২ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেই ২৫ জুলাই উড়াল দিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে দিয়ে বহুল আলোচিত এবং পদ্মা সেতুর পাশাপাশি আর এক ‘হাই কোর্ট’ হয়ে ওঠা তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করানো। সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন করানোর চেষ্টাও ছিল তার তালিকায়। কোনো কোনো দৈনিক দীপু মনির এ সফরকে এমনকি মহাজোট সরকারের ‘শেষ চেষ্টা’ পর্যন্ত বলেও মন্তব্য করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিক থেকেও চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। তাছাড়া দিল্লির ‘সাউথ ব্লক’সহ ভারতের ওপর মহলে দীপু মনির বিশেষ জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলেও বিভিন্ন সময়ে জানা গেছে। ভারতীয় নেতাদের অনেকে শেখ হাসিনার পাশাপাশি দীপু মনিকেও অতি আপনজন বলেই মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত অমন এক চিন্তা ও আশাবাদের ভিত্তিতেই ‘শেষ চেষ্টা’ চালানোর জন্য দীপু মনিকে দিল্লি পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে তো বটেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন দীপু মনি। বলেছেন, আর কিছু না হোক, ভারতীয়রা যদি তিস্তা চুক্তিটিও কোনোভাবে স্ব^াক্ষর করতেন তাহলেও শেখ হাসিনার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আগামী নির্বাচন পাড়ি দেয়া এবং বিরোধী পক্ষের ভারতকেন্দ্রিক সমালোচনার জবাব দেয়া সহজ ও সম্ভব হতে পারতো।
অন্যদিকে ভারতীয় নেতারা কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য দরদে উথলে ওঠেননি। এবারও যথারীতি শুধু আশ্বাসের কথাই শুনিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদও মুসলমান হিসেবে দীপু মনিকে ইফতার খাওয়ানোর বাইরে শেখ হাসিনার জন্য আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো বার্তা পাঠাননি। প্রত্যেকে বরং ভারতের সংবিধান, লোকসভা ও রাজ্যসভাসহ পার্লামেন্টের কার্যপদ্ধতি এবং সংবিধান কিভাবে সংশোধন করতে হয় এসব সম্পর্কে নতুন করে জ্ঞান দিয়েছেন। ভারত যে বাংলাদেশের মতো ছোট কোনো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র নয় বরং ২৯টি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি যুক্তরাষ্ট্র এবং সেখানে তিস্তা চুক্তি বা সীমান্ত প্রটোকলের মতো বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোরও যে সম্মতি ও অনুমোদন নিতে হয় সেকথাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে দীপু মনিকে। তাছাড়া শুধু সরকার চাইলেই চলবে না, এ ধরনের বিষয়ে বিরোধী দলেরও সমর্থন থাকতে হবে। অর্থাৎ নানা কথার মারপ্যাঁচে সব মিলিয়েই শেখ হাসিনার জন্য বিরাট একটি ‘না’-সূচক বার্তা পাঠিয়েছে মনমোহন সিং-এর সরকার। দীপু মনিও অবশ্য এত অল্পে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নন। তিনি বরং ভারতে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের সঙ্গেই ‘পলিটিক্স’ করার হাস্যকর কোশেশ করেছেন। তিনি প্রথমে গিয়ে হাজির হয়েছেন বিজেপি নেতা অরুন জেটলীর দরোজায়। ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্য সভায় বিরোধী দলের নেতা তিনি। কিন্তু অরুন জেটলীও অনেকটা ‘পত্রপাঠ’ বিদায় করেছেন দীপু মনিকে। সম্ভবত বলেও দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ যে কংগ্রেসের সেবাদাসগিরি করে সে কংগ্রেসের কাছেই গিয়ে ‘ধরনা’ দেয়া উচিত দীপু মনির।
এরপর ভারতীয় রাজনীতিকদের হতবাক করে দীপু মনি গিয়ে ‘ধরনা’ দিয়েছেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র নাথ মোদীর দুয়ারে। উদ্দেশ্যের কোনো রাখঢাক করেননি দীপু মনি। ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০২ সালে গুজরাট রাজ্যে হাজার হাজার মুসলিম হত্যার খলনায়ক হিসেবে বিশ^ব্যাপী ঘৃনিত এই উগ্র হি›ন্দুত্ববাদী নেতার দ্বারস্থ’ হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো, নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে- যদি বিজেপি ও তার জোট এনডিএ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জিততে পারে। ওদিকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ধরনা’ দেয়ার বিষয়টিকে রাজনীতির পুঁজি হিসেবে পরিপূর্ণরূপে কাজে লাগিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ভারতের মুসলমানদের বুঝিয়েছেন, তিনি যদি সত্যিই ঘাতক ও মুসলিম বিরোধী হতেন তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার কাছে ‘ধরনা’ দিতে আসতেন না। নরেন্দ্র মোদী কিন্তু তাই বলে কোনো আশ^াসই দেননি দীপু মনিকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন অবস্থায় আসলে নেইও মিস্টার মোদী। কারণ তিনি ২৯টির মধ্যে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র। তাছাড়া বিশেষ করে তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, যার সঙ্গে এই সময়ে মোদীদেরও কংগ্রেস বিরোধী নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ চলছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য তিনি মমতার সঙ্গে ঝামেলা বাঁধানোর চিন্তাই করতে পারেন নাÑ যদিও এদেশের কারো কারো ‘দিদিমনি’ হিসেবে মমতা ব্যানার্জির আগে থেকে বিশেষ পরিচিতি রয়েছে।
অর্থাৎ দিল্লি সফরে গিয়ে কোনোদিক থেকেই সামান্য সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকে বরং বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, শেখ হাসিনাকে এবং আওয়ামী লীগের মতো একটি সেবাদাস দলকে ক্ষমতায় রাখার বা আনার জন্য ভারতীয়রা নিজেদের দলীয় স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে রাজি নন। বলা দরকার, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়রা স্বাধীনতার পর থেকেই এ মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। এবার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার একটির পর একটি করে এমনভাবেই ভারতীয়দের ইচ্ছা পূরণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে যে, ভারত এই সরকারকে স্ব^াধীন ও সার্বভৌম কোনো দেশের সরকার বলেই মনে করছে না। গুরুত্ব ও সম্মানও যে দিচ্ছে না তার প্রমাণ তো পাওয়া গেছে অনেক উপলক্ষেই। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লি সফরে গিয়ে ভারতকে ‘চাহিবা মাত্র’ স্টাইলে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ভারত কিন্তু শেখ হাসিনার মানসম্মান বাঁচানোর জন্য তিস্তা চুক্তি পর্যন্ত স্ব^াক্ষর করেনি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা সফরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির আড়াল নিয়ে মনমোহন এমনকি সীমান্ত প্রটোকলের ব্যাপারেও কলম ধরেননি।
এতকিছুর পরও শেখ হাসিনার সরকার আগ বাড়িয়েই ভারতকে সবকিছু দিয়েছিল। মনমোহন সিং-এর সফরকালে অমীমাংসিত ও অপদখলীয় ভূমি উদ্ধারের ব্যবস্থা ‘নিশ্চিত’ হয়েছে বলে কল্পকাহিনী শোনানো হলেও বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টোরকম। যেমন বাংলাদেশকে মাত্র ৩৫৭ একর জমি দিয়ে আসাম পেয়ে গেছে ১২৩৯ একর জমি। বাংলাদেশকে মাত্র ৪১ একর জমি দেয়ার বিনিময়ে ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয় পেয়েছে ২৪০ একর। এরই পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের হাজার হাজার একর জমির মালিকানা নিষ্পত্তি না করেই বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ শুরু করেছেÑ যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। একই অবস্থা চলছে ছিটমহলগুলোর ক্ষেত্রেও। এভাবেই সীমান্ত সমস্যার ‘সমাধান’ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন যেহেতু নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে সে কারণে সম্ভবত হঠাৎ করেই দীপু মনিকে পাঠানো হয়েছিল ‘শেষ চেষ্টা’ চালানোর জন্য। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সঙ্গী-সাথীরা এখনো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যকার মূল কথাটুকুই শিখে উঠতে পারেননি। সেটা হলো, দিল্লি শুধু নিতে জানে, দিতে নয়। এজন্যই দীপু মনিকে ফিরতে হয়েছে একেবারে খালি হাতে। এতকিছুর পরও প্রধানমন্ত্রী আগামী মাস সেপ্টেম্বরে দিল্লি সফরে যাবেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, শেখ হাসিনা নিজেও কিছু আনতে পারেন কি নাÑ তা সেটা যতো সামান্যই হোক না কেন।
এবার ‘সাহেবজাদা’ ও ‘সৈয়দজাদা’ সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে বলে তার কাছে ‘তথ্য’ রয়েছে বলে ঘোষণা দেয়ার মধ্য দিয়ে সম্প্রতি ঝড় তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘সাহেবজাদা’র ঘোষিত এই ‘তথ্য-তত্ত্ব’ নিয়ে বিতর্কের ঝড় না থামতেই দৃশ্যপটে এসে গেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মাসের বেশির ভাগ সময় লন্ডনে কাটানো এবং জয়ের মতো অমুসলিম এক বিদেশী রমনীর স্বামী সৈয়দ আশরাফ একদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, অন্যদিকে তিনি আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। সে কারণে মাঝে-মধ্যেই তাকে অনেকের ব্যাপারে ‘উদ্ধারকারীর’ ভূমিকায় দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর কীর্তিমান পুত্রের বিপদেও যথারীতি ‘উদ্ধারকারীর’ ভূমিকা পালন করতে এসেছেন তিনি। ‘না হিন্দু, না মুসলমান’ হলেও সৈয়দ আশরাফ মাথায় টুপি লাগিয়ে রাজধানীর এক ইফতার মহফিলে অংশ নিয়েছেন। ২৮ জুলাই সেখানেই তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের ওপর চেপে পড়া নিন্দা-সমালোচনার বোঝাটা নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। জয় যেখানে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ অবারও ক্ষমতায় আসবে বলে তার কাছে ‘তথ্য’ রয়েছে সেখানে সৈয়দ আশরাফ বলে বসেছেন, তার কাছে ‘তথ্য’ নেই তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন তিনি! এই ‘গন্ধ’ তিনি নাকি পেয়েছেন একজন রাজনীতিক হিসেবে! সৈয়দ আশরাফের ব্যাখ্যায়ও কোনো ফাঁক ছিল না। তিনি বলেছেন, নির্বাচন হবেই এবং সে নির্বাচনে সব দলই অংশ নেবে। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তার নেত্রীর দল আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে বলে তিনি ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন!
শুনতে খুব সহজ-সরল এবং রাজনীতিকসুলভ মনে হলেও একটু লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘তথ্য-তত্ত্ব’ এবং সৈয়দ আশরাফের ‘গন্ধ-তত্ত্বের’ নাড়ি বা মূলটুকু সম্ভবত একই স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় আনা হবে বলে ‘দক্ষিণী’ কোনো বিশেষ কেন্দ্র থেকে দু’জনের কানেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন এতে ‘তথ্য’ হিসেবে নিয়েছেন, অন্যজন এর মধ্যে পেয়েছেন ‘গন্ধ’। অনেকটা হঠাৎ করে রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন বলেই জয়ের পক্ষে ‘কানপড়াটা’ সম্ভবত চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। তার ওপর পাঁচ-পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মায়ের এবং মায়ের দলের জন্য দরদে উথলে ওঠাটাও তার জন্য ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া ছিল দলের নেতিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ‘টনিক’ বা মৃতসঞ্জীবনী ধরনের কোনো মাদক বা ‘সুরা’ দিয়ে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্য। আবেগের আতিশয্যে ‘তথ্য’টি জয় আসলে ‘টনিক’ এবং মৃতসঞ্জীবনী ‘সুরা’ হিসেবেই নেতাকর্মীদের গলায় ঢেলেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কূটনীতিতে যথেষ্ট ঝানু বলে বিশেষ কিছু মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত সজীব ওয়াজেদ খেয়াল করেননি, ঘরের সব খবর বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। কারণ, এখন সময়টা তার মায়ের জন্য মোটেও ভালো যাচ্ছে না। বলা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে এর উল্টো ব্যাখ্যাও করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস এবং ১/১১ ঘটানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা এবং নিজের জননী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। সেই থেকে প্রকাশ্যে না হলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন।
সুতরাং এমন মনে করা মোটেও উচিত নয় যে, ‘তথ্য-তত্ত্ব’টি কোনো অপরিপক্ব যুবকের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছে। বাস্তবে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদী সেনা কর্মকর্তা সিওভাক্কোর সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামী দল, মাদরাসা শিক্ষা ও সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সুচিন্তিত কিছু ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা এবং আওয়ামী লীগের করণীয় সম্পর্কে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়ার মধ্য দিয়ে বহুদিন ধরেই জয় দেশের রাজনীতিতে জড়িত রয়েছেন। তাছাড়া তিনি আবার পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধাসহ প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও। তার গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ে। সব মিলিয়েই বলা যায়, এতদিন যেভাবেই তাকে হাজির করা হয়ে থাকুক না কেন, এখন আর তিনি কেবলই প্রধানমন্ত্রীর অতি আদরের পুত্র বা ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাতি নন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একজন রাজনীতিকও বটেÑ যাকে নিয়ে এরই মধ্যে দেশের সব মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। একই কারণে তার কোনো কথাকেই আর হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তার ‘তথ্য-তত্ত্ব’ও তাই নিন্দা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। বলা হচ্ছে, এটা অবশ্যই কেবলই কথার কথা নয়। সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্যের ভিত্তিতে জয় আসলে আগাম জানান দিয়েছেন। আর এ ধরনের ‘তথ্য’ যে জয়ের জানা থাকে বা তাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখা হয় সে খবর তো বহু আগেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে সৈয়দ আশরাফকেও যেনতেন রাজনীতিক মনে করার সুযোগ নেই। তার সম্পর্কে সবচেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু তথ্য জানিয়ে গেছেন মরহুম আবদুল জলিলÑ যিনি সৈয়দ আশরাফেরই ইমিডিয়েট পূঢ়র্বসুরি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১/১১-এর পর সৈয়দ আশরাফ কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার কোন ধরনের ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হয়েছিল এবং ঠিক কোন আশ্বাস ও ভরসায় তিনি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন এসব বিষয়ে আবদুল জলিল বহুবার টিভিতে বলেছেন, সংবাদপত্রেও এ সম্পর্কিত রিপোর্ট বেরিয়েছে। অর্থাৎ সজীব ওয়াজেদ জয়ের মতো সৈয়দ আশরাফও কেবলই রাজনীতিক নন। ১/১১ ঘটানোসহ রাষ্ট্রক্ষমতার রদবদলে তারও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ধরনের কর্মকা-ে তিনি নাকি ‘তুখোড়’ একজন খেলোয়াড়ও। কথাটা আমাদের নয়, আবদুল জলিল তো বলেছেনই, এখনো বলে থাকেন আরো অনেকে। সুতরাং সে সৈয়দ আশরাফও যখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরপর ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে আগাম ‘গন্ধ’ পান তখন আসলে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। তাছাড়া ‘আউটলুক’ ধরনের ভারতীয় বিভিন্ন ম্যাগাজিন তো অনেক উপলক্ষেই জানিয়ে দিয়েছে, ভারত শেখ হাসিনাকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে চায় এবং এ ব্যাপারে দেশটি তার ‘কৌশল’ও চূড়ান্ত করেছে। ‘আউটলুক’-এর এ খবরটি নিয়ে দেশে হৈচৈ কম হয়নি। বলা দরকার, ‘আউটলুক’ কোনো সাধারণ পত্রিকা নয়। বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের সময় এ ম্যাগাজিনটিই অনেক গোপন খবর ফাঁস করেছিল। ভারত যে বাংলাদেশকে তার ‘রাডার’-এর বাইরে যেতে দেবে না এবং সে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই যে পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল সে খবরও জনগণ ‘আউটলুক’-এর বদৌলতেই জানতে পেরেছিল। সুতরাং ‘আউটলুক’-এর এবারের খবরকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনায় নেয়া দরকার। তাছাড়া ‘আউটলুক’ একা নয়, ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘আনন্দবাজার’সহ আরো কিছু পত্রিকার কল্যাণে আজকাল তো ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের অন্দরমহলের অনেক খবরও বেরিয়ে আসছে।
সব মিলিয়েই ধরে নেয়া যায়, সজীব ওয়াজেদ জয় অকারণে হঠাৎ ‘তথ্য-তত্ত্ব’ হাজির করেননি, সৈয়দ আশরাফের নাকেও সঠিক ‘গন্ধ’ই ঢুকেছে। নিজেদের জন্য শুভ বার্তা বলে তার তাই শুধু ‘গন্ধ’ না বলে ‘খুশবু’ বলা উচিত ছিল। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে একজন ‘তুখোড় খেলোয়াড়’ হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ আশরাফ কেন ‘খুশবু’ না বলে শুধু ‘গন্ধ’ পর্যন্ত বলেই থেমে গেছেন সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তা সত্ত্বেও বলা দরকার, ভারত এবং শেখ হাসিনারা চাইলেই চলবে না, কৌশলের জবাবে পাল্টা কৌশল বলেও তো একটা কথা রয়েছে! যুগে যুগে প্রমাণিত সত্য হলো, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করলেই বাংলাদেশের জনগণকে দমন করা বা ইচ্ছাধীন করে ফেলা যায় না। বিশেষ করে এমন কোনো দল বা নেত্রীকে ক্ষমতায় আনা যায় না, যার বা যাদের বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালন করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যাপাওে ‘সাহেবজাদা’ আর ‘সৈয়দজাদা’দের খুব বেশি কিছু করার নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন