রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৩

বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক নীতি


একটা দেশের বৈদেশিক নীতি রচিত হওয়া উচিত তার আপন জাতীয় স্বার্থকে নির্ভর করে। কোনো আপাত মনোহর বিশ্বজনীন আদর্শবাদকে (Cosmopolitanism) নির্ভর করে নয়। বিশ্বজনীনতা বা কসমোপলিটনিজম বলে যে, মানুষ মানুষ ভাই ভাই, দেশে দেশে যুদ্ধ অবান্তর, কোনো দেশে সেনাবাহিনী না থাকা উচিত। দেশপ্রেম মানব ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বজনীনতা মানলে বৈদেশিক নীতির প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্ব এখনো ভাগ হয়ে আছে নানা জাতি-রাষ্ট্রে (Nation-state)আর জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ এখনো একটা বাস্তবতা। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষা খাতে যতটা ব্যয় হয়, অন্য খাতে তা নয়। আমাদেরও আছে সেনাবাহিনী। আমরাও অনুভব করছি দেশ রক্ষা খাতে ব্যয়ভার বহন করার প্রয়োজনীয়তা। কোনো দেশের বৈদেশিক নীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুটি উৎপাদক (Factor) হতে হয় বিশেষভাবে বিচার্য। এদের একটি হলো তার ভৌগোলিক অবস্থান (Geographical Position) এবং আরেকটি হলো তার ঐতিহাসিক বিবর্তনের (Historical Evolution) ধারা। একটি দেশে ইতিহাস ও ভূগোলকে যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়ে বৈদেশিক নীতি গড়তে গেলে সৃষ্ট হয় বড় রকমের বিভ্রান্তি। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বৈদেশিক নীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। কারণ মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকারের বৈদেশিক নীতি জাতীয় সার্বভৌমত্বকে করছে ক্ষুণœবর্তমান বাংলাদেশ সরকার ভারতকে ট্রানজিটর নামে যা প্রদান করেছে, তা হলো করিডোর। এই করিডোর দেয়ার জন্য হতে পারে বাংলাদেশে চরম বিপত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল পোল্যান্ডকে জার্মানির জমির ওপর দিয়ে বাল্টিক সমুদ্রবন্দরে যাওয়ার করিডোর প্রদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গেছে। যে করিডোর পোল্যান্ডকে দেয়া হয়েছিল, তা এখন হয়েছে পোল্যান্ডের অংশ। পূর্ব প্রুশিয়া (East Prussia) দেয়া হয়েছে পোল্যান্ডকে। আর পূর্ব প্রুশিয়ার জার্মানদের করা হয়েছে বিতাড়িত। করিডোরের ইতিহাস আমরা মনে রাখিনি। রাখলে ট্রানজিটের নামে ভারতকে করিডোর দিতে সম্মত হতাম না। আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল, তিস্তার পানি না দিলে ভারতকে ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা দেয়া হবে না। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি। অথচ ভারত পেতে চলেছে ট্রানজিটের সুযোগ। কী কারণে এটি সম্ভব হলো, আমরা তা জানি না। সম্প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক দফতরের মন্ত্রী গিয়েছিলেন দিল্লি। তিনি সেখানে তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারত যদি তিস্তার পানি বণ্টন এবং বাংলাদেশের সাথে স্থল সীমান্ত চুক্তিতে না আসতে চায়, তবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আজ তিনি বলতে চাচ্ছেন যেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ভারতীয় স্বার্থ হবে ক্ষুণœতার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য চাচ্ছে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা। মনমোহন সিং ভারতের সংবিধান পরিবর্তন না করতে পারলে তিস্তার পানি বণ্টন ও স্থল সীমান্ত চুক্তি আদৌ সম্ভব হবে না। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন করতে গেলে বিজিপির সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ কেবল তা হলেই ভারতীয় সংসদে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাভ সম্ভব হতে পারবে। দীপু মনি বিজিপির নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের কাছে থেকে ভারতের সংবিধান বদলের কোনো আশ্বাস আদায় করতে সক্ষম হননি। তাকে দিল্লি থেকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। আমার মনে পড়ছে, সাবেক পাকিস্তান আমলের নুন-নেহরু চুক্তির কথা। এ চুক্তি অনুসারে দক্ষিণ বেরুবাড়ি পেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু বেরুবাড়ি হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। একজন ভারতীয় নাগরিক ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন, ভারতের সংবিধান অনুসারে বেরুবাড়ি হস্তান্তর আইনসিদ্ধ নয়। ফলে আটকে যায় বেরুবাড়ি হস্তান্তর। এ সময় ভারতের সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেস সরকারের ছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু চান না, ভারতের সংবিধানের সংশোধনী আনতে। ভারতের বৈদেশিক নীতিতে সব সময়ই কাজ করেছে একটা ছলচাতুরীর মনোভাব। জওয়াহেরলাল সরকার তিব্বতের ওপর চীনের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। কিন্তু তিব্বতের ওপর চীনের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়ার পর বিশেষভাবে দেখা দেয়, চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ। ১৯৬২ সালে হিমালয় সীমান্তে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ভারত পারজিত হয় চীনের কাছে, কাশ্মিরের লাদাখ অঞ্চলে। প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের অধিকার। চীনের সাথে ভারেতের ছলচাতুরী সম্ভব হয় না। কারণ চীন ভারতের চেয়ে সামরিক দিক থেকে ছিল অনেক শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশ সামরিক শক্তিতে হলো খুবই দুর্বল। এ ছাড়া ভারত রয়েছে বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে। ভারত তাই বাংলাদেশের ওপর জোর খাটাতে পারছে। বিশ্বটা আজো চলেছে শক্তির যুক্তির ওপর নির্ভর করে। চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেটি বিশেষভাবে প্রমাণিত হতে পেরেছে। সম্প্রতি দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার দেখা করেছেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে। নরেন্দ্র মোদি বিজেপির একজন প্রধান নেতাও বটে। বিজেপি ভারতের আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হলে নরেন্দ্র মোদি হতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি হলেন বিশেষভাবেই মুসলিমবিদ্বেষী। ২০০২ সালে গুজরাটে হয় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এতে নিহত হন দুই হাজারের বেশি মুসলমান। বহু মুসলমান নারী হন ধর্ষিত। বহু মুসলমান নর-নারী প্রাণে বাঁচলেও হন উদ্বাস্তু। ২০০২ সালের দাঙ্গা ছিল একটি ভয়াবহ ঘটনা। ভারতীয় মুসলমানেরা নরেন্দ্র মোদিকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন। নরেন্দ্র মোদিকে তোয়াজ করতে গিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হলো বিশেষভাবেই বিবর্ণ। কেবল ভারতের মুসলমানদের কাছেই নয়, সাধারণভাবে বিশ্ব মুসলিম সমাজে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা অনুজ্জ্বল হতে পারল। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে যেমন আছে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয় চেতনা, তেমনি আবার তার পাশাপাশি আছে মুসলিম উম্মা চেতনা। বাংলাদেশের মানুষের উম্মা চেতনা আহত হচ্ছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বৈদেশিক নীতির কারণে। আর এর ফলে আগামী নির্বাচনে (যদি হয়) থাকছে আওয়ামী লীগের ভোট কম পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা। আওয়ামী লীগ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলো। এ নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের ৬০ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিএনপি। আবার ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ দাবি করছে, জাতীয় নির্বাচনে এই অনুপাত যাবে বিশেষভাবে বদলে। আর তাই আওয়ামী লীগ থাকবে ক্ষমতায়। আমরা জানি না, কী করে এটি সম্ভব হতে পারবে। তাই আগামী নির্বাচন হয়তো হবে আওয়ামী লীগের নীল নকশার অনুসরণে। ভোট ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। আগামী নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ না হতে পারে, তবে বাংলাদেশে ঘটবে গণতন্ত্রের বিলুপ্তি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে ১৯৫৮ সাল থেকে চলেছে সামরিক জান্তার শাসন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে তেমন কিছু ঘটা অসম্ভব নয়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। আর তাই প্রয়োজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে জাতীয় নির্বাচন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads