শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

বাকশাল থেকে ডিজিটাল ও গণতন্ত্রের আবাবিল পাখি


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান কিছু দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘প্রকৃতি দুঃশাসন পছন্দ করে না, দুঃশাসনের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।প্রকৃতির এই প্রতিশোধ বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিরা তাদের মতো করেই অনুভব করেছেন। একজন সাধারণ মানুষও এই প্রতিশোধ নিজেদের মতো করেই দেখতে পায়। গরিবের আল্লাহ অথবা ভগবান এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমান কথিত প্রকৃতিএ কাজ না করলে এই দুনিয়ার সব মানুষ বোধ হয় পাগল হয়ে যেত। সাভারের রবীন্দ্র চন্দ্র সাহা জমি হারিয়ে এভাবে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সংখ্যালঘুদের তথাকথিত জিম্মাদারদের একজন সেই রানার কপালে যখন স্নেহের চুম্বন এঁকে দেয়, তখন এই অসহায় মানুষটির পাগল না হয়ে উপায় ছিল না। কিন্তু বহুতলা বিল্ডিংটি যখন ভূমিদস্যু রানার ফিজিক্যাল মাথার ওপর এবং তাদের পুরো দলের সিম্বোলিক মাথার ওপর ভেঙে পড়ে তখন দেশের হাজার হাজার রবীন্দ্র চন্দ্ররা তাদের ভগবানের ওপর পূর্ণ আস্থাটি আবারো ফিরে পান। সবার মাথার ওপরে যে একজন রয়েছেন, তা আবারো স্পষ্ট হয়েছে। রবীন্দ্র চন্দ্রদের এই ভগবানই হলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমানদের প্রকৃতি। রাষ্ট্রীয় মদদে ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে পড়া মুরাদ জং-রানাদের প্রতিরোধ করার মতো যখন কাউকে পাওয়া গেল না, তখন স্বয়ং প্রকৃতিই এগিয়ে এলো। বিল্ডিংটিতে কারো হাতের যে ধাক্কা লেগেছে, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মখা আলমগীর ঠিকই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু এই হাতটি কার ছিল, তা পুরোপুরি মালুম করতে পারেননি। প্রকৃতির এই হাতটিকেই বিরোধী দলের হাত হিসেবে ঠাহর করে বসলেন। আসলে এই প্রকৃতিও মানুষকে নিয়ে মাঝে মধ্যে মশকরা করে। মূল রহস্যটি উন্মুক্ত করে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো কাউকে কাউকে বানায় দার্শনিক। আবার একটু ভেলকি লাগিয়ে মখা আলমগীরের মতো কাউকে বানায় পাগল বা মাজনুন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের এ উক্তিটি তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশটি বাজিকরদের হাতে পড়ে গেছে। এ সত্য কথাটি উচ্চারণের জন্য তাকে তখন অনেক মন্দ কথা শুনতে হয়েছিল। জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বর্তমান সরকারের মধ্যে না আছে বিচারপতি হাবিবুর রহমানদের মতো দার্শনিক প্রজ্ঞা অথবা না আছে আল্লাহর ক্রোধ উপলব্ধির মতো কোনো আধ্যাত্মিক অনুভব। বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই দেউলিয়া এ সরকারের হাতেই পড়েছে ষোল কোটি মানুষের ভাগ্য। পুরো দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করার মূল কারণ এটিই। সরকারে বসলে দায়িত্ববোধের যে অনুভূতি জন্মানোর কথা, এদের মধ্যে তা আসেনি। নিজের ড্রাম অন্যকে পেটাতে দিলে ফাটাইয়াফেলিতে পারে। তাই ঢাকা শহরের সব বিলবোর্ড দখল করে সরকার নিজের উন্নয়নের ঢোলটি নিজেই বাজাচ্ছে। স্বৈরশাসকেরা এমন উৎকট ভঙ্গিতেই নিজেদের উন্নয়নের ঢোল বাজান। সরকার সারা দেশে এমন উন্নয়ন করেছে যে তা আর মানুষের চোখে পড়ছে না। বাকশালীদের উন্নয়ন হলো কাজীর গরু সব সময় কেতাবে থাকে, গোয়ালে থাকে না। এসব বিলবোর্ড একজন স্বৈরশাসকের শেষ সিম্পটমটিই তুলে ধরেছে। ১৯৭৫ সালে যারা বাকশাল দেখেননি, তারা এখন ডিজিটাল সংস্করণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে সরকার আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের সব রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করে নিয়েছে। বিরোধী মতের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক সম্পর্কে নিজেদের একপেশে রাজনৈতিক মতামত চাপানোর চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার ঘোষককে ডেমনাইজ করার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি নিজেদের অনুকূলে বাতিল করে দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একটি সার্বভৌম সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালতের রায়ে বাতিল করা হয়েছে। অপছন্দের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে আদালত এমনভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পড়েন যে, তাতে আদালতের রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতা অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে ধরা পড়ে গেছে। আদালত স্বাধীন হয়েছে কিন্তু বিচারকেরা কতটুকু স্বাধীন হতে পেরেছেন, তাও আজ বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর আদালতের এসব রায় একবারের তরেও সরকারের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে না। আদালত দিয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের এ চেষ্টা পুরো দেশ ও জাতিকে ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার নামে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগের এই সর্বনাশটি করা হয়েছে। দেশের বিরাট অংশের রাজনৈতিক বিশ্বাস আজ আদালত অবমাননার নামান্তর হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে মুক্ত থেকে আদালতের মর্যাদা রক্ষার প্রথম দায়িত্ব আদালতের। আদালতের সেই প্রজ্ঞা ও সংযম আজ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে গেছে। মানবসমাজ ও বিশ্বপ্রকৃতি সব সময় একটা আরামদায়ক অবস্থান বা কমফোর্ট জোনেথাকতে চায়। যে শক্তিই কোনো মানবসমাজকে আনকমফোর্ট জোনেঠেলে দিতে চায়, তারাই প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আনকমফোর্ট জোন থেকে কমফোর্ট জোনে ফেরার জন্য একটি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। কম্যুনিজম মানবজাতিকে আনকমফোর্ট জোনে ঠেলে দিয়েছিল বলেই নিজের আজ এ পরিণতি হয়েছে। বাকশাল ও ডিজিটাল সংস্করণ তেমনি একটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ পরিকল্পনা। কাজেই প্রকৃতির প্রতিশোধ হবে এর সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্স। শক্তির মদে মত্ত এসব মানুষ প্রকৃতির সম্মুখে নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষুদ্রতা সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস এই মানুষকে মুহূর্তেই মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে। এ মানুষের ঔদ্ধত্য, স্পর্ধা ও অহঙ্কার খোদ এই বিশ্বচরাচরের মালিকের ক্রোধের কারণ হয়। সামান্য মাছির মাধ্যমে তাই তিনি অনেক নমরুদকে ধ্বংস করেছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি দিয়ে তিনি আবরাহার বিশাল হস্তী বাহিনীকে ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো নমরুদ, কোনো ফিরাউন, কোনো হিটলারই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। বর্তমানকালের কোনো পুরুষ হিটলার বা কোনো নারী হিটলারের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। কাজেই বিচারপতি হাবিবুর রহমান কেন এই কথাটি উচ্চারণ করলেন, তা একটি তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে প্রকৃতি আরো ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিয়ে বসতে পারে। প্রকৃতির কিছু ছোটখাটো প্রতিশোধ বা সতর্ক বার্তা অনেকেরই উপলব্ধিতে এসেছে। জনগণ বা বিরোধী দল যখন প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তখন মনে হয়েছে কোথা থেকে কেউ যেন হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখা গেছে, সরকার যখন একটি অপকর্ম ঢাকতে চেয়েছে তখন আরো বড় একটি অপকর্মে আপনাআপনি জড়িয়ে গেছে। প্রথম দিকে যাকে জীবনতরী বা লাইফ বোট বলে মনে হয়েছে, শেষ দিকে তাই সরকারের জন্য ডেথ ট্র্যাপ বা মারণতরী বনে গেছে। এ ধরনের অনেক ঘটনা এ সরকারের আমলে ঘটে গেছে যে তার যথাযথ ব্যাখ্যা কঠিন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান সম্ভবত এগুলোকেই বলেছেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। নিচের ঘটনা প্রবাহগুলো প্রকৃতির এ প্রতিশোধ ম্যাকানিজমটিকে আরো স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত করেছে। রাস্তায় চাপাতিলীগ, প্রশাসনে পুলিশলীগ, বিচারালয়ে বিচারপতিলীগ, মিডিয়ায় চাপাবাজ-লীগ সব কিছুর যুগপদ ক্রিয়ায় দেশের মানুষ সত্যিকারভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। পদ্মা সেতুর আবুল হন সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে পেটানো পুলিশ অফিসার পান প্রেসিডেন্ট পদক। দুর্নীতি, অবিচার, অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ শক্তি বলতে গেলে একেবারে শূন্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সামান্য একজন ড্রাইভার দুর্দান্ত সাহস দেখিয়ে ৭০ লাখ টাকার বস্তা ও তার বাহক এপিএসসহ পিলখানার গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে। অতি ক্ষুদ্র এই আবাবিল পাখিটি হস্তীবত সরকার ও তার বাহিনীকে চরমভাবে ধাক্কা দেয়। সরকারের জন্য চরম লজ্জার কারণ হয়। এ লজ্জা ঢাকতেই সরকার আরো বড় একটি পাপে জড়িয়ে যায়। এ সময় হঠাৎ বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা কালো বিড়ালকে ঢাকতে পারেনি। বরং তাকে আরো কদর্য ও বীভৎস করেছে। শেরেবাংলা বা বাংলার বাঘ বলতেই যেমন এ কে এম ফজলুল হকের চেহারাটি ভেসে ওঠে, তেমনি বাংলার কালো বিড়ালবলতেই অন্য একটি চেহারা ভেসে ওঠে। এ দিকে পদ্মা সেতুর লজ্জা ঢাকতে গণজাগরণ মঞ্চকে জাগানো হলো। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে আবুলদের খবর চলে গেল অনেক পেছনে। গণজাগরণকে মনে হলো সরকারের জীবনতরী। শাহবাগের এক শিশুপীরের ভক্ত হয়ে পড়ল সারা দেশ। আওয়ামী লীগ ও সেই ঘরানার কলাকুশলীরা তো বটেই খোদ বিএনপির একটা অংশও মিডিয়ার ধাক্কায় এই শিশুপীরকে কদমবুছি করে বসে। এই শিশুপীরের কথায় দেশের পতাকা ওঠে আর নামে। সে এক এলাহি কাণ্ড। শাহবাগীদের মন্ত্রণায় সরকার ব্লগার রাজীবকে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম শহীদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বসে। সরকারপ্রধান রাজীবের বাসায় চলে যান। কিন্তু পরে দেখা গেল সে ছিল এক চরম ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক। এই রাজীবকে শাহবাগীরা সিরিয়াল দেয় ৩০ লাখ+১ হিসেবে। সিরিয়াল দেয়ার এ ধারাটি অব্যাহত থাকলে এবং গুলশানের শপিং মলটির সামনে সিসিটিভির ক্যামেরা মোতায়েন না থাকলে যুবলীগ নেতা মিল্কিরও এমন ধরনের একটা সিরিয়াল নম্বর পড়ে যেত। নিজ দলের অপর নেতা সেই কিলারের পাঞ্জাবি-টুপি পোশাক বাছাইতেও মুনশিয়ানার ছাপ ছিল। মিল্কির বডিগার্ড সাগরের স্ত্রী ও ঘাতক তারেকের প্রেমিকা লোপার জবানবন্দী থেকে জানা যায় যে মিল্কিকে হত্যার জন্য ঘাতকেরা গোলাম আযমের রায়ের দিনটিকেও প্রথমে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ব্যাটে বলে মিলেনি বলে মিল্কি দ্বিতীয় প্রজন্মের দ্বিতীয় শহীদ হিসেবে গণ্য হতে পারল না। লোপার সাথে পরকীয়া ও রাজাকারদের অ্যাকাউন্টে নিজের শত্রু মিল্কিকে খতমÑ দুটির স্বাদই তারেকদের কাছে একই রকম লাগত। খেত একজন বিলটি জমা পড়ত অন্যের নামে। কিন্তু বিশেষ চেতনায় সমৃদ্ধ এমন মহান বা মজার কাজটিতেও বাদ সাধল এই বেরসিক প্রকৃতি। একটি সাপ খুঁজতে বা খুঁড়তে দিয়ে অনেক কেঁচোকে বের করে আনল। গণজাগরণ মঞ্চটি তখন একটি ভেলকি বা বুদ বুদ হলেও এর প্রতিক্রিয়ায় যে হেফাজতের জন্ম হলো, তা সরকারের জন্য চরম বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিলো। সেই হেফাজতকে মোকাবেলার জন্য গার্মেন্টের মেয়েদের নিয়ে বিশাল সমাবেশের ডাক দেয়া হলো। বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দেয়ার পরও রানা প্লাজার গার্মেন্টশ্রমিকদের কাজে আসতে বাধ্য করা হলো; কারণ এখান থেকেই একটু পরই রানার নেতৃত্বে মিছিলটি বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রকৃতি এ সময়টিকেই বেছে নেয়। রানা প্লাজার মালিকসহ কয়েক হাজার মানুষের মাথার ওপর সেই বিল্ডিংটি ধসে পড়ে। কাজেই গার্মেন্টের যেসব নারী শ্রমিককে দিয়ে হেফাজতে ইসলামকে টাইট বা হেফাজত করার কথা ছিল, প্রকৃতি তাদেরই সরকারের জন্য আরো বড় হেফাজতবা হুমকি বানিয়ে ছাড়ল। পরের ইতিহাস সবার জানা আছে। এটিকে অনেকেই বলেন শফী হুজুরের বদদোয়া। বাকিরা গণ্য করেছেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। বিশ্বজিতকে শিবির ভেবে নৃশংসভাবে খুন করে চাপাতিলীগ নামে পরিচিতি পাওয়া ছাত্রলীগ। বিশ্বজিতের রক্তকে শিবিরের রক্ত ভেবে বিশেষ শিহরণ নিয়ে খুনিরা বীরদর্পে রাজপথ দিয়ে হেঁটে যায়। কিছুক্ষণ পরই মারাত্মক ভ্রমটি স্পষ্ট হয়। প্রকৃতিও হয়তোবা বুঝতে পারে এ দৃশ্যপটে তখন বিশ্বজিতের মতোই কারো থাকা দরকার ছিল। কারণ বিশ্বজিতকে নিয়ে ভুলটি করাতে যা হয়েছে কোনো আবদুল বা মোগাম্মদ নাম নিয়ে সেই ভুলটি করলে প্রকৃতির এ উদ্দেশ্যটি সাধিত হতো না। বিশেষ একটি হিসাব থেকেই প্রকৃতির এই শিডিউলটি নিয়ন্ত্রিত হয়। অতি চালাক মানুষ বা সরকারকে প্রকৃতি কেন যেন দুই চোখে দেখতে পারে না। হাতেনাতে বা রাম ধরা ধরিয়ে দেয়। গাওগেরামের এক লোক নিজেকে অত্যধিক বুদ্ধিমান ঠাহর করে। আশপাশের সবাইকে হাবাগোবা জ্ঞান করে। তাদের সারাক্ষণ ধমকাধমকি বা তিরস্কার করে। নিজের বুদ্ধি বা জ্ঞানগরিমা দিয়ে সবাইকে চমকিয়ে দেয়। দশ গেরামে বিলাতফেরতকেউ নেই। কাজেই সেই বিলাতফেরত সাজতে বিলাত গমনের সিদ্ধান্ত নেয়। জীবনে প্রথমবারের মতো বিমানে চড়েছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে বোকা ঠেওরাতে পারে। তাই দরকারি বিষয়গুলোও জিজ্ঞেস করে না। বিমানে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে কুয়োয় (টয়লেটে) কিছু জল দেখতে পেয়ে নিজের জলটুকুও কায়দা করে নিঃসরণ করে দেন। অন্য প্রাকৃতিক কাজটি কোনো মতে আটকে রাখেন। তার অনুমান, বিলাতে যদি বিলাতি বেগুন থাকতে পারে, তবে নিশ্চয়ই এই কাজটির জন্য বিলাতি ঝোপঝাড়ও থাকবে। কিন্তু সুমসাম বিমানবন্দরে নেমে প্রকৃতির এ ডাকটি তীব্র হয়ে পড়ে। এ ডাকে সাড়া দেয়ার মতো জায়গা পুরো এয়ারপোর্টের কোথাও খুঁজে পায়নি। শেষমেশ প্রকৃতি সদয় হয়। বিলাতি ঝোপঝাড় না পেলেও একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পায়। নিজের পায়ের মোজা খুলে তার ভেতরেই প্রকৃতির জিনিসগুলো বুদ্ধিমানের মতো ভরে ফেলেন। তার পর দেয়ালের ওপর একটি ফাঁকা জায়গা বা ভেন্টিলেটের দেখে তা দিয়ে মোজাটি বাইরে নিক্ষেপ করতে চায়। এতক্ষণ প্রকৃতি মোটামুটি সদয় থাকলেও শেষ দৃশ্যে এসে বিট্রে করে বসে। মোজার ভেতরের জিনিসগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। প্রমাদ গুনেন ভদ্রলোক। আশপাশে এক কিনার দৌড়ে আসে। কাকুতি মিনতি করে তাকে বলে, ‘ভাই এগুলো একটু পরিষ্কার করে দাও। আমি তোমাকে দশটি পাউন্ড দেবো।সব কিছু দেখে বিস্ময়মাখা চোখে কিনার বলে, ‘আমি তোমাকে বিশ পাউন্ড দেবো তুমি আমাকে আগে দেখাও যে এই মেস কী করে সম্ভব হলো?’ এই ভদ্রলোক যাদেরকে উঠতে বসতে বোকামির জন্য গালি দিতেন, তাদের কাছে সমুদ্র বিজয়ের মতো এই বিলাত বিজয়ের কাহিনীটি নিঃসন্দেহে অফুরন্ত আনন্দের উৎস হয়ে দেখা দিয়েছিল। কাজেই এ সরকার তার চালাকির জন্য যখনই প্রকৃতির কাছে এমনভাবে জব্দ হয়েছে সারা দেশের মানুষ, তখন বিমল আনন্দ পেয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রতিটি পরিকল্পনা শুরু হয়েছে এমনি চালাকি ও বুদ্ধিপনার মধ্য দিয়ে। এই অতি চালাক লোকটির মতোই কারো কথা বা পরামর্শ এ সরকার কখনো কানে নেয়নি। সব জায়গায় সবজান্তার ভাব দেখিয়ে এসেছে। দেশের তাবত মানুষকে বোকা ভেবেছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কেউ কোনো পরামর্শ দিতে গেলে মুই কার খালুবা এ ধরনের কথা বলে থামিয়ে দিয়েছে। পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণ তাদের হৃদয়ে পুষে রাখা সেই ক্ষোভটিই প্রকাশ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে বাড়াবাড়ি এই সরকারও একই পরিণতি ভোগ করতে বাধ্য। এটিকে প্রতিরোধ করতে প্রশাসনে, বিচারালয়ে ও মিডিয়ায় যে হস্তীবাহিনী প্রস্তুত করা হয়েছে, তারা গণতন্ত্রের আবাবিল পাখিদের সামনে কোনোভাবেই টিকতে পারবে না। কারণ গণতন্ত্রের এই আবাবিল পাখিদের সাথে রয়েছে প্রকৃতির পুরো আশীর্বাদ। এখন বাকশালের এই হস্তীবাহিনীটি যাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়বে, তাদের প্রথম কাজ হবে গণতন্ত্রের আবাবিল বাহিনীতে যোগ দেয়া। ইতালির কবি দান্তে বলেছিলেন, The hottest place in hell are reserved for those who, in time of moral crisis maintain their neutrality, অর্থাৎ নৈতিক সঙ্কটের সময় যারা নিরপেক্ষ থাকে তাদের জন্য দোজখের সবচেয়ে উত্তপ্ত জায়গাটি সংরক্ষিত আছে। কাজেই গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বোধসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে এখন নীরব থাকা সম্ভব নয়। একটি কঙ্কর নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের পক্ষে আজ দাঁড়াতে হবে। থমাস জেফারসনের কথামতো When injustice becomes law, resistance becomes duty. অর্থাৎ অবিচার যখন আইন হয়ে পড়ে প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই সামনে উদ্ভূত পরিস্থিতির সব দায়টুকু এই নব্য বাকশালকেই নিতে হবে। সামান্য প্রজ্ঞা যদি এই সরকারের কোথাও অবশিষ্ট থেকে থাকে, তবে সেখানেই নিবেদন, দয়া করে আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে খেলতে যাবেন না। আরো ভয়ঙ্কর প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার আগেই হুঁশটি ফিরিয়ে আনুন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads