বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০১৩

দলের নিবন্ধন বাতিল ও রাষ্ট্রে বহুমত চর্চা


বাংলাদেশের একটি বৃহৎ ইসলামি দলের নিবন্ধন বাতিল ছিল গত সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামের এই দলের নিবন্ধন বাতিলের আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন সদস্যের বেঞ্চের দুই বিচারপতি। অন্য বিচারপতি এর সাথে একমত হননি। এক সময় হাইকোর্টের মামলার রায় খোলা এজলাসে ঘোষণা করা হতো। এতে কোন বিচারক কোন পয়েন্টে কী রায় দিলেন তা সাথে সাথেই স্পষ্ট হতো। যদিও রায়ের লিখিত সত্যায়িত কপি পেতে কিছু দিন সময় লেগে যেত। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের আমল থেকে হাইকোর্টের রায় দানের ক্ষেত্রে এই অনুসৃতি পাল্টে যায়। এখন হাইকোর্টে রায়ের নির্বাহী অংশটুকু ওপেন কোর্টে ঘোষণা করে বাকিটা পরে প্রকাশ করলেও চলে। এ কারণে নিবন্ধন বাতিল মামলায় তিন বিচারপতির মধ্যে কে কোন বিষয়ে কী মত প্রকাশ করেছেন তা স্পষ্ট হয়নি। এমনকি বেঞ্চের প্রিসাইডিং বিচারপতিই অন্য দুজনের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী কি না তাও জানা যায়নি। রায়ের পুরো বিবরণ পাওয়া গেলে স্পষ্ট হবে কে কোন বিষয়ে কী সিদ্ধান্তে এসেছেন। যদিও এ রায়ের কার্যকারিতার তাৎক্ষণিক অনেক উপাদান রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও রয়েছে এর নানাবিধ প্রভাব। বাংলাদেশের নির্বাচন সংক্রান্ত আইন হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২। এ আইনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধনের একটি বিধান রয়েছে। এই বিধান বাধ্যতামূলক না হওয়ায় ২০০৮ সালের আগে এর কার্যকারিতা তেমন একটা ছিল না। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর সময় একবার রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের উদ্যোগ ছিল। পরে সেটি আর সেভাবে কার্যকারিতা পায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৫৫) নির্বাচন সংক্রান্ত বাংলাদেশের মূল আইন। স্বাধীনতার পরপরই এই আইন পাস হলেও এ পর্যন্ত বহুবার সংশোধন করা হয়েছে এটি। এখনো এর বেশ কিছু সংশোধনের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এই আইনটির পরিচ্ছেদ ৬/এ হলো নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসংক্রান্ত। এই পরিচ্ছেদের ৯০এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ৯০বি অনুচ্ছেদে উল্লিখিত শর্ত অনুসারে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন করতে পারে। ৯০বি অনুচ্ছেদে কোন শর্ত পূরণ হলে কোন রাজনৈতিক দল এই নিবন্ধন পাবে তার উল্লেখ রয়েছে। আর ৯০সি অনুচ্ছেদে কোন বিষয় থাকলে কোন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পাবে না সেই শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই দুটি অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পাওয়া না পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষেত্রে ৯০বি অনুচ্ছেদটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাঁচটি বিষয় যদি থাকে তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। এর মধ্যে রয়েছেÑ প্রথমত, কোনো দলের গঠনতন্ত্র যদি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী বা সাংঘর্ষিক হয়। দ্বিতীয়ত, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে যদি ধর্ম বর্ণ গোত্র ভাষা অথবা লিঙ্গগত বৈষম্য করা হয়। তৃতীয়ত, নাম পতাকা প্রতীক অথবা কাজের মাধ্যমে যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয় অথবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। চতুর্থত, গঠনতন্ত্রে দলহীন অথবা একদলীয় ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। পঞ্চমত, গঠনতন্ত্রে বাংলাদেশের বাইরে যদি দলের কোনো অফিস শাখা বা কমিটি রাখা হয় তাহলে সেটিকে নিবন্ধনের অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই অনুচ্ছেদে কোনো নামে একটি দল নিবন্ধন পেলে সেই নামে অন্য দলের নিবন্ধন দেয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে সেই দলকে কমিশন নিবন্ধন দিতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেকগুলো রাজনৈতিক দলকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধন এবং প্রতীক বরাদ্দ দেয়। হালনাগাদ তালিকা অনুসারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এলডিপিÑ ছাতা, জাতীয় পার্টি জেপিÑ বাইসাইকেল, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)Ñ চাকা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগÑ গামছা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটিÑ কাস্তে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগÑ নৌকা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিÑ ধানের শীষ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)Ñ কুঁড়েঘর, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটিÑ হাতুড়ি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশÑ কুলা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদÑ মশাল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীÑ দাঁড়িপাল্লা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডিÑ তারা, জাকের পার্টিÑ গোলাপফুল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলÑ মই, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বিজেপিÑ গরুর গাড়ি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনÑ ফুলের মালা, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনÑ বটগাছ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগÑ হারিকেন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টিÑ আম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশÑ খেজুর গাছ, গণফোরামÑ উদীয়মান সূর্য, গণফ্রন্টÑ মাছ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলÑ বাঘ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ ন্যাপÑ গাভী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিÑ কাঁঠাল, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলনÑ চাবি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশÑ চেয়ার, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিÑ হাতঘড়ি, ইসলামী ঐক্যজোটÑ মিনার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসÑ রিকশা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশÑ হাতপাখা, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টÑ মোমবাতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টিÑ হুক্কা, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিÑ কোদাল, খেলাফত মজলিসÑ দেয়াল ঘড়ি। ওপরের দলগুলোর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যদি উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ না করত তাহলে হয়তো এর অনেকগুলো দলই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভে সমর্থ হতো না। রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় একটি নির্দিষ্ট আদর্শ উদ্দেশ্য অর্জন বা বাস্তবায়নের জন্য। অন্য দিকে রাষ্ট্রের সংবিধানে অর্জিত লক্ষ্যের প্রতিফলন পাওয়া যায়। সংবিধান যেহেতু পরিবর্তনশীল সেহেতু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিকতার বিষয়টিও পরিবর্তনশীল। স্বাধীনতার পরবর্তী সংবিধানে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ছিলÑ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ১৯৭৫ সালের পর এ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তিত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয় আল্লাহর ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও সামাজিক ন্যায়বিচার। সংবিধানের এই মূলনীতি যদি সব দলের দলীয় আদর্শ হতে হয় তাহলে সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না এমন কোনো দল নিবন্ধনযোগ্য হবে না। আর ১৯৭৫ সালের পর আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস যাদের নেই তাদের কোনো দল নিবন্ধনযোগ্য হয় না। এমনকি দলহীন বা একদলীয় আদর্শে বিশ্বাসী কোনো দল নিবন্ধন না পাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০সি অনুচ্ছেদে। অথচ আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেছিল। এ ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি ও সাম্যবাদী দলের ঘোষিত আদর্শই হলো প্রলেতারিয়েতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা তথা এককভাবে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন কায়েম করা। অধুনাবিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এক সময় এক দলের শাসন ছিল। চীনে এখনো রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সংবিধানের পরিপন্থী বলতে ঠিক কী বোঝানো হবে সেটি একটি বিরাট বিতর্কের বিষয় হবে। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৩৮টি দলের মধ্যে অনেকগুলোই রয়েছে ইসলামী আদর্শভিত্তিক দল। এসব দলের প্রায় সবগুলোই আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের মূলনীতিতে বিশ্বাসী। বর্তমান সরকার এ মূলনীতি পাল্টে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে এনেছে। অথচ নিবন্ধিত কোনো ইসলামী দলই তাদের গঠনতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের কথা বলেনি। এ ধরনের বিশ্বাসের কথা বলার সম্ভাবনাও এসব দলের নেই। এখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০সি অনুচ্ছেদের যেভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, সেই বিবেচনাকে গ্রহণ করা হলে বেশির ভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাদের নিবন্ধন হারাবে। হাইকোর্টে তাদের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করা হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুসারে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যেতে পারে। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন প্রাথমিকভাবে কিছুটা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে যে, বিএনপি জামায়াত জাসদসহ ১০টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করে না। শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু বিষয় সংশোধনের শর্ত দিয়ে প্রায় সব দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য আইন, সেই যুক্তি সামনে এসে যায়। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল মামলায় দলটির নিবন্ধন বাতিল কামনাকারী বাদিপক্ষ থেকে অনেকগুলো যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে কোন কোন যুক্তি গ্রহণ করে আদালতের দুই বিচারপতি জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায় দিয়েছেন, সেটি স্পষ্ট হবে আদালতের লিখিত রায় পাওয়ার পর। এ মামলায় বাদিপক্ষের মূল যুক্তি ছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০সি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের পরিপন্থী কোনো আদর্শ রয়েছে এমন গঠনতন্ত্রের রাজনৈতিক দল নিবন্ধনযোগ্য বিবেচিত হবে না। সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হয়েছে জনগণকে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ। এ বিবেচনায় জামায়াত সংবিধানবিরোধী দল এবং এ দল কোনোভাবেই নিবন্ধন পেতে পারে না। এ ছাড়া জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুসারে কোনো অমুসলিম বা মহিলা দলের প্রধান হতে পারে না। এ বিধানের মাধ্যমে ধর্ম ও বর্ণগত বৈষম্য করা হয়েছে, যা আরপিওর ৯০সি অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া জামায়াত যে ইসলামি সমাজ গঠনের কথা বলেছে সেটিও সংবিধানের স্পষ্ট খেলাপ। জামায়াত নামে অনেক দেশেই দল রয়েছে। এসবের জবাব জামায়াতের পক্ষের আইনজীবীরা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সংবিধানে ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে যে সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে সেটি হলো রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের কথা। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার কথা এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। অন্য দিকে জামায়াত যে সার্বভৌমত্বের মালিক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেছে সেটি হলো সমস্ত সৃষ্টি জগতের সার্বভৌমত্বের কথা। এ সার্বভৌমত্বের কথা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানেই বলা হয়েছে। জামায়াত যে ইসলামি সমাজ গঠনের কথা বলে সেটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে, জনগণের রায়ের ভিত্তিতে। এ ছাড়া পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেখানে রাজনৈতিক দল গঠন ও মতপ্রকাশের অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে সেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী আদর্শের দল সক্রিয় থাকতে পারে এবং নির্বাচনে অংশও নিতে পারে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম চলতে দেয়াসংক্রান্ত মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এক বিখ্যাত রায় রয়েছে। এ রায়ে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি যে শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলে তা প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ আমেরিকান সংবিধান অনুসারে নেই। কিন্তু যত দিন আমেরিকান সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকারের স্বীকৃতি থাকবে তত দিন বিরুদ্ধ মতের রাজনৈতিক দলও তাদের তৎপরতা চালানোর অধিকার ভোগ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্তমানে যে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রয়েছে সেই একই মূলনীতি রয়েছে ভারতের সংবিধানে। সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল শিবসেনা যেমন নির্বাচন করে ক্ষমতার অংশীদার হতে পেরেছে তেমনিভাবে মুসলিম লীগও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কোয়ালিশনের অংশীদার হতে পেরেছে। জামায়াতে ইসলামী ভারতে একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে যে অধিকার দেয়া হয়েছে সেটাকে সামনে রাখা হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০সি অনুচ্ছেদের উদার ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করতে হবে। যেটি করে নির্বাচন কমিশন ৩৮টি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন এবং প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। তার পরিবর্তে এর সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যাকে একমাত্র ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা হলে সংবিধানে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার কার্যকারিতার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের উদ্দেশ্য যদি রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে এটি হতে পারে এক রকম। আর তা যদি রাজনৈতিক তৎপরতাকে একটি গঠনমূলক শৃঙ্খলায় আনার জন্য হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই এর উদার ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান যে পরিবর্তনশীল সেটি সংবিধান পরিবর্তন পরিবর্ধন সংশোধনের বিধান রেখে শাসনতন্ত্র নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে সংবিধান ১৫ বার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ এ সময়ে আমূল বদলে গেছে এমনটি ঘটেনি। এ কারণে সংবিধানের সব কথা কোনোভাবেই রাজনৈতিক দলের আদর্শ হতে পারে না। সংবিধানের সব কিছুর প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক দল তৈরি করা এবং এর কাজ পরিচালিত করতে হলে সমাজে বহুমতের চর্চা আর থাকবে না। সমাজ ও দেশ হয়ে পড়বে নিশ্চল ও স্থবির। সে আত্মঘাতী স্থবিরতা কেউ বাংলাদেশের জন্য কামনা করতে পারে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads