১৮ দলীয় জোটের প্রধান বিএনপি’র ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বনাম ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান শরীক দল আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে বইছে উত্তাপ। ফলে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে আবারো অশনি সংকেত। সবগুলো বিরোধী দলের দাবি, যে কোনো ভাবেই হোক না কেনো ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এমন দাবির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তারা ঘোষণা দিয়েছে, ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটিয়ে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ পদ্ধতি বহাল রেখে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে সরকারকে।
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ এর অধীনে বিরোধী দলগুলোকে অংশ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এও বলেছেন, বিকল্প কোনো কিছু থাকলে সংসদে এসে প্রস্তাব দিন, যৌক্তিক দাবি হলে মেনে নেয়া হবে। অন্যথায় সরকার বিরোধী আন্দোলন করে কোনো ফায়দা হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীসহ সরকারি দলের নেতারা। কিন্তু বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের এসব কথা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, ‘তত্ত্বাবধায়ক’ পদ্ধতি বহাল রাখতে হবে।
সব মিলে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান দুইদলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রাজনীতির হাওয়ায় গরম আভাস বইছে। নির্বাচনকে ঘিরে দুই রাজনৈতিক দলের এ ধরনের কঠোর শক্ত অবস্থানকে নির্বাচন না হওয়ার অশনি সংকেত হিসাবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা এও মনে করছেন, বিএনপি’র ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বনাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বিষয়টি শেষ পর্যন্ত যদি সমাধান না হয় তবে গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হতে পারে।
ওদিকে, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ইস্যুতে আবারও ২০০৬ সালের মতোই রাজনৈতিক সংঘাতের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (ইআইইউ)।
সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত ইআইইউ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার গত বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান দ’ুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার তৈরি হতে পারে যেমনটি হয়েছিল ২০০৬ সালে।
ইআইইউ ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের বিচার দেশে-বিদেশে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিএনপি এবং এর প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বিচার জামায়াতের কট্টর সমর্থক, ভর্তুকিতে তেল সরবরাহের প্রধান উৎস, আর্থিক সহযোগী ও ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশীর কর্মসংস্থানকারী সৌদি আরব প্রশাসনকে ক্ষুব্ধ করে তুলবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে ইআইইউ বলছে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বলে আসছে যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ পুনর্বহাল না করা হলে তারা পরবর্তী নির্বাচন বর্জন করবে। বিএনপি যে তাদের হুমকি অনুযায়ী কাজ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে ওই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। নির্বাচন বর্জনের বিএনপির হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগ পরবর্তী সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য এক ধরনের অস্থায়ী সরকারের আপোসমূলক প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ইআইইউ বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান সঙ্কটের উত্তরণ ঘটবে কি না সেটা নির্ভর করবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে প্রধান ভূমিকা পালনকারী তিন পক্ষ- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সেনাবাহিনী কী ধরনের ভূমিকা রাখে তার ওপর।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জনঅসন্তোষ, বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলোকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে বিএনপি। এছাড়া আগামী মাসগুলোতে আরও অন্যান্য বিষয় নিয়েও বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোগী দলগুলোর রাস্তায় নেমে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপারে ইআইইউ বলছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের ওপরই বেশি গুরুত্ব পাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে অগ্রগতি হলেও প্রতিবেশী দু’দেশ এখনও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহন বা পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চীনের সঙ্গেও যাতে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সরকার সতর্ক।
চীন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে। চীন থেকে এখনও বাংলাদেশ বেশিরভাগ সামরিক সরঞ্জাম পেয়ে থাকে। ২০১২-১৬ সময়কালে ভারত এবং চীন দু’দেশ থেকেই বাণিজ্য এবং আর্থিক সহযোগিতা পেতে বঙ্গোপসাগরের তীরে দেশটির কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতে পারে।
ওদিকে লন্ডনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের অনলাইনে গত ২৮শে আগস্ট প্রকাশিত হয় ‘রানিং ইলেকশন ইন বাংলাদেশ : জেনারেলি ট্রাস্টেড’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো দল টানা দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের রেকর্ড গড়তে পারেনি। বিরোধী দল হুমকি দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা না হলে তারা নির্বাচন বয়কট করবেন। কিন্তু তাদের ওই হুমকি হয়তো ফাঁকা বুলি। আর এ বিষয়টি ভাল করেই জানে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার র্যাংকিং যেহেতু কমে গেছে তাই বিএনপি’র স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে উদগ্রীব। তাছাড়া, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার আশঙ্কাও কম।
ওই প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতি এতটাই কর্কশ ও তিক্ত যে, দু’পক্ষের কেউ কাউকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আস্থায় নিতে পারে না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির দুই নেত্রীর মধ্যে এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর একজন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা, অন্যজন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রধান খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে এ দুই নেত্রীর মধ্যে পঞ্চম বারের মতো যখন নির্বাচন দোরগোড়ায় তখনই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিএনপি’র দাবি, সরকারকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। খালেদা জিয়া বলেছেন, তাদের দাবি মেনে নেয়া না হলে তারা ২০১৩ সালের শেষের দিকে যে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে তা বয়কট করবেন। অস্থায়ী, পক্ষপাতিত্বহীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের একটিই পথ আছে। তা হলো- কেয়ারটেকার ব্যবস্থা। এটা হয়েছে ১৯৯৬ সালে এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর। তারপর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করার ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের জুনে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার বাতিল করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এর অন্যতম কারণ- সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুরো ব্যবস্থার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা মাইনাস টু তত্ত্ব হাতে নিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা উত্তরাধিকার সূত্রের রাজনীতির দু’টি ধারাকেই বাতিল করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। ওই সময়ে সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতির দায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দু’জনকেই জেলে নিয়েছিল। বাংলাদেশে কার্যকর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গত গ্রীষ্মে শেষ করে দেয়া হয়েছে। বিগত নির্বাচনে যে জালিয়াতি বা সহিংসতা হয়েছে বাংলাদেশ তা ঠেকাতে সেনাদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভর করে থাকা একটি নিশ্চয়তা পাওয়ার মতো বিষয় নয়। ব্যারাকের বাইরে থাকার কোনো আকাক্সক্ষা সেনা কর্মকর্তাদের নেই। পাঁচ বছর আগে তারা লোভী রাজনীতিবিদদের থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সেনা নেতৃত্বকে পছন্দমতো হাতে রেখেছেন। কিন্তু তারা যে ফের তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। দৃশ্যত তারা এবার তার পাশে থাকবে বলেই মনে হয়। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী, যাদেরকে প্রতি বছর জাতিসংঘের এ মিশনে পাঠানো হয় তারা ৫০ কোটি ডলার আয় করে ও বেতনভাতা পান। ৬ বছর আগে, জাতিসংঘের স্থানীয় অফিস একটি বিস্ময়কর বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাতে একরকম হুমকি দিয়ে বলা হয়, সেনাবাহিনী যদি কৌশলপূর্ণ একটি নির্বাচনে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে শান্তিরক্ষী মিশনে তাদের লোভনীয় সুযোগে তার প্রভাব পড়বে। ওই সময়ে নিউইয়র্কে উচ্চতর কর্মকর্তারা ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারির কূটনীতি নিয়ে হতাশ হয়েছিলেন। তখন বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তারা তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও নির্বাচন বাতিল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ওই নির্বাচন ওই মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ধরে নেয়া হয় যে, জাতিসংঘ অফিস একই কৌশল দু’বার ব্যবহার করবে না। এখনও তাদের শিক্ষা ভুলে যাওয়া হয়নি। বিএনপির নির্বাচন বয়কটের হুমকি আসলে ফাঁকা বুলি এবং আওয়ামী লীগ তা জানে। বিএনপি একটি একীভূত শক্তি নয়। এর মধ্যে দু’বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে নানামাত্রিক বিভক্তি আছে। বর্তমান জাতীয় সংসদে এ দলের মাত্র ৩১টি আসন আছে। বিএনপির স্থানীয় শ’ শ’ নেতাকর্মী গত ৫ বছর ধরে জনবিচ্ছিন্ন। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। তাদের এই উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো সরকার টানা দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড গড়তে পারেনি। আওয়ামী লীগ বিএনপির জন্য নির্বাচনকে সহজ করে দিয়েছে। তারা আগামী নির্বাচন এক ধরনের যৌথ অন্তর্বর্তী (ঔড়রহঃ ওহঃবৎরস এড়াবৎহসবহঃ) সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তাতে বিএনপি’র দাবি পুরোপুরি মিটবে বলে মনে হয় না। এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে দেখা হবে তাদের দুর্বলতা হিসেবে। শেখ হাসিনা পুলকিত হবেন যে, ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তা তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নাটকীয় উন্নয়ন করা হয়েছে এ কথাও বলতে পারেন তিনি। পাশাপাশি নির্বাচনে জালিয়াতির চেষ্টাকে কমিয়ে আনার জন্য ভোটার তালিকা ঠিকঠাক করা হয়েছে। মৃত অবস্থা থেকে বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফেরা নিয়ে দাবির যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু যা মৃত তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য এখন কালক্ষেপণ করা সময়ের অপচয়। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ব্যবস্থাকে বাতিল করেছে। বর্তমানের এই পরিকল্পনা যথার্থ কি না বা তাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে তা নিয়ে বিদেশী সরকারগুলো বিস্ময় প্রকাশ করছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদেরকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন যে, ২০১৩ সালের শেষে যে নির্বাচন হবে তা হবে গণতান্ত্রিক পালাবদলের ত্রুটিমুক্ত শুভ সূচনা। কিন্তু এ পথে অনেক বাধা আছে। ঢাকার আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন জুনে মহাসমাবেশের সময় সংঘটিত সহিংসতার জন্য বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে ২৯টি অভিযোগ গঠন করবেন কি না। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটররা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তর দল ও বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামীর পুরো নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- দাবি করছেন। মধ্যবর্তী অবস্থায় অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা অনেকটা কম। হবসিয়ান সহিংসতা ও চৌর্যতন্ত্রের মতো অবস্থায় বাংলাদেশে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীকে শাসন ক্ষমতার কাছে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই অবস্থা এখন আর নেই। নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের হাতকে সংযত করা কঠিন হবে। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) দুর্নীতি বিষয়ক সূচক-এ বাংলাদেশ ছিল খালেদা জিয়ার সময়ে একেবারে তলানিতে। কিন্তু ২০১১ সালে বিশ্বের ৬০টি দেশকে টপকে সেই বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১২০ নম্বর অবস্থানে। শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে লন্ডনে সফরকালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ছোট আকারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি ওই সরকারে যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন মহলের উদ্বেগের এবং রাজনৈতিক বিতর্ক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের সময় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে তাতে বিএনপি অংশ নিতে পারে। তারা সংসদে এ জন্য প্রস্তাব করতে পারে এবং সবাই মিলে একটি মন্ত্রী সভা গঠন করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।।
দেশে প্রধান দুটি দলের প্রধান নেত্রীর এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় বইছে। কোন পদ্ধতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে সংশয় আরো সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ গণমাধ্যমে জানান, গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা বিএনপি’র মেনে নেয়া উচিত। বিএনপি’র উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, দেশের উন্নয়ন কাজে বাধা না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রস্তাব অনুসারে কিভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সংসদে এসে কথা বলুন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাই বলুক না কেন ভিন্ন পন্থায় কিছু করার চেষ্টা করলে সরকার ভুল করবে বলে মনে করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই প্রস্তাবকে নাকচ করে ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী যাই বলুক, আগামী নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। তার মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন শুধু বিএনপি নয়, সারাদেশের মানুষের দাবি।
ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরীক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি গণমাধ্যমে জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কী হবে সেটা এখনই নির্ধারণ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তÍব দিয়েছেন সেটা হতে পারে। এর জন্য জাতীয় ঐক্যমত্যের দরকার।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এর সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে তিনি যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তী সরকার চান এটা সেই সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে সরকার সংবিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্তে স্থির নেই। আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া এটাকে নাকচ করে দেয়ায় প্রমাণ হয় তিনি অচলাবস্থা চান।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে প্রমাণ হয় সামনে দেশে সংঘাত অনিবার্য। এ ধরনের বক্তব্য নির্বাচন না হওয়ার অশনি সংকেত। এখন এর সমাধানে না পৌছতে পারলে গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক এক সংসদ অধিবেশনে খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ইস্যুতে বলেছেন যে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ছাড়া নির্বাচন হতে দেয়া হবে না তা বলে পাখির মতো উড়ে গেলে চলবে। সংসদে এসে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।
উল্লেখ্য, বিরোধী দল বিএনপি’র তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও গত ২০১২ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ পদ্ধতি বাতিল করে মহাজোট সরকার। সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা না রাখা, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশের দিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পরামর্শ ছাড়া আদালতের কোনো রায় না দেয়ার বিধান সংবলিত বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে।
এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৫৮ ধারার সাথে যুক্ত ৫৮(ক) ও ৫৮(খ) অনুচ্ছেদ ২০নং ধারা বলে বাতিল হওয়ায় সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকার পরও বার বার ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে আসছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের নেতারা। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তত্তা¡বধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনার দাবি তোলেন। এ ইস্যুকে নিয়ে রমযানের ঈদের পরে দুর্বার আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তারা।
১৮ দলীয় নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কয়েকটি নীলনকশা তৈরি করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন। তাদের মতে এই দেশে কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনই অবাধ ও সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি হবে না। এভাবে নির্বাচন করে সরকার আবার ক্ষমতায় এসে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়, যা জনগণ চায় না এবং হতে দেয়া হবে না। তাদের মতে তাদের এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য চিন্তা ভবিষ্যত গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বার বার বিরোধী দলের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলে আসছে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারে কোনো নির্বাচন নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন। যেখানে সংসদ এটিকে বাতিল করেছে, হাইকোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। তারপরও এটি নিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল আন্দোলনের ইস্যু করার পাঁয়তারা ছাড়া কিছুই না। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই হতে হবে। যে সরকারে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী তাদের সপদে বহাল থেকে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীর মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করে থাকে। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে তাই সংবিধানের ধারা বলে এ দেশেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের বিপরীত অবস্থান নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজনৈতিক মহল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন অঙ্গনে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও সংঘাত এড়াতে এ পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে মত দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কার্যকর সাড়া পাওয়া যায়নি।
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না অন্তর্বর্তী সরকার এ নিয়ে দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে সংকট, সংঘর্ষ, হানাহানির দিকে ঠেলে দিবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক জোট মতৈক্যে না পৌঁছালে গণতন্ত্রের ধারা হুমকিতে পড়বে এবং রাজনীতিতে তৃতীয় কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতো আমারও ব্যক্তিগত অভিমত, দুই দলে নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য একটি রাজনৈতিক চাল। এ থেকে আসলে নির্বাচন কি পদ্ধতিতে হবে তা পরিষ্কার না। সরকারি দলের এ ধরনের প্রস্তাব যে বিরোধী দল গ্রহণ করবেনা তা ইতিমধ্যে তারা বলেছে। সে ক্ষেত্রে ঈদের পর প্রধান বিরোধী দল কোন অবস্থানে যেতে পারবে তার ওপর নির্ভর করবে যে আগামীতে কী হতে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, দুই দলের এখনই একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া উচিত তা না হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন