ক’দিন যাবত সরকারের বিতর্কিত বেনামী ও বেওয়ারিশ উন্নয়নের বিলবোর্ড নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলছে হরদম। মহাজোট সরকারের মন্ত্রী মহোদয়গণের ‘শত নয়ন’ বাংলাদেশের উন্নয়ন। জনগণের প্রতিনিধি বিরোধীদল বিএনপি’র সে ‘নয়ন’ না থাকায় মহাজোট সরকারের উন্নয়ন তাদের চোখে ধরা পড়ে না বিধায় বিলবোর্ডের মাধ্যমে উন্নয়নের সচিত্র প্রতিবেদন প্রদর্শন করতে হচ্ছে বর্তমান মহাজোট সরকারকে। সরকারের জনৈক মন্ত্রী মহোদয়ের বিলবোর্ড সম্পর্কে এ ধরনেরই একটি মন্তব্য ইদানিং পত্রিকায় প্রকাশও পেয়েছে। ঈদের আগের দিন একটি কাজে এয়ারপোর্টে যেতে পথে পথে মনোহারী ঢঙে সরকারের টাঙানো বিলবোর্ডগুলো স্বচক্ষে দেখলাম। বিলবোর্ডে সরকারের বিভিন্নমুখী মুখরোচক উন্নয়নের কল্পগাঁথার মাঝে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো ‘উন্নয়নের অঙ্গীকার, ধারাবাহিকতা দরকার......।’ অর্থাৎ বিলবোর্ডের একটিই মাত্র প্রতিপাদ্য বিষয়- তাহলোÑ আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় পাঠাতে জনগণের প্রতি আহ্বান। খাদ্য নিরাপত্তা, কূটনৈতিক অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, যুগান্তকারী পরিবর্তন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, শিক্ষিত সমাজ, উন্নত জাতি, সবার জন্য শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কল্পিত শিরোনাম ছাড়াও একই সঙ্গে উক্ত বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলের নেতিবাচক কর্মকা-ের তথ্য। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কারণে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী বৈতরণী পারের মানসে বিরোধী দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা, বিরোধী জোটকে নানাভাবে দুর্বল করা, সরকারি প্রশাসনভুক্ত দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার, কালো টাকার বিপুল পুঁজিকে কাজে লাগানো এবং ইসিকে দিয়ে আরপিও সংশোধনের দ্বারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মাধ্যমে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করা এ সরকারের আমলেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে রাতের অন্ধকারে অন্যের বিলবোর্ড দখল করে নিজেদের ভুয়া উন্নয়নের তথ্য প্রকাশ।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি এবং বিরোধী উভয় দলই বৈধপন্থায় যার যার উন্নয়নের প্রচার এবং প্রসারে যে কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তস্করের মতো রাতের অন্ধকারে অন্যের বিলবোর্ড দখল করে বেনামীভাবে সরকারে উন্নয়নগাঁথা প্রচার হলো আপত্তির কারণ। বছর পর ঘুরে আসা ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্যে বিজ্ঞাপণী সংস্থার মাধ্যমে এক বছরের জন্যে উক্ত বিলবোর্ডগুলো কন্টাক্ট নিয়েছিল। আমাদের দেশে সাধারণত সারা বছরে যে পরিমাণ পণ্য বেচা-কেনা হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও অধিক পণ্য বেচা-কেনা হয় ঈদুল ফিতর-এর মওসুমে। সে আশায় উৎপাদনী সংস্থাগুলো ঈদ মওসুমকে কাজে লাগানোর জন্যে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থার মাধ্যমে বিলবোর্ডগুলো ভাড়া নিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন থেকে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরিবার-পরিজনদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদযাপনের আশায়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের সরকার রক্ষক হয়ে ভক্ষকের মতো ঈদের এ খুশির পূর্ব মুহূর্তে অধীনস্থ জনগণের মুখের ভাত কেড়ে নেয়ার মতো অনুমতি ছাড়া অন্যের বিলবোর্ড কি দখল করতে পারে? সরকার নিজেই যদি এরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে তাহলে দেশের অধীনস্থ মাস্তান, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা কি করবে? ঈদের পূর্ব মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তাভাবে বিনা অনুমতিতে তস্করের মতো অন্যের বিলবোর্ড দখল করা কি সরকারের ভূমিকার মধ্যে পড়ে? এটি কি কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কেউ মেনে নিতে পারবে? জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে কি দেশ চলে? এটিই কি বর্তমান সরকারের আইনের শাসন?
বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও পণ্য উৎপাদনকারী কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, প্রচার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নতুন পণ্য বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। নেপচুন অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ইজারা নেয়া ৯০ ভাগ বিলবোর্ডে সরকারের উন্নয়নচিত্র বসানো হয়েছে। অনেকে ঈদকে সামনে রেখে ভাড়া নিয়েছিল। ক্লায়েন্টরা অভিযোগ করা শুরু করেছেন। কী যে করব? আমরাও নিরুপায়।’ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উন্নয়নের প্রচারণা তো ঈদের পরও করা যেত। এখন সবাই ঈদ উপলক্ষে পণ্য ডিসপ্লে করবে, সেটা বন্ধ হয়ে গেল। আমাদেরকে একবার জিজ্ঞেসও করল না। আমরা তো সরকারকে ট্যাক্স দিই।’ সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে চুক্তি করে টাকা দিয়ে এটা করেছে কি না, এক প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘তা আমি জানি না।’ সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বিষয় হলো একটি গণতান্ত্রিক সরকারের স্বৈরাচারের ভয়ে বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ন্যায্য অধিকারের কথা বলতেও ভয় পান নির্যাতিত সংশ্লিষ্ট মানুষ। এটিই কি এ সরকারের গণতান্ত্রিক সুস্থ পরিবেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত!
উপরোক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে আমাদের বরিশালের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বরিশালে যারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক তাদের গ্রামের বাড়ীর সামনে একটি আলাদা ঘর থাকে যার নাম ‘কাচারী ঘর।’ আগের দিনে যখন সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্যে কমিউনিটি সেন্টার, মুসাফিরদের জন্যে আবাসিক হোটেলের যত্রতত্র প্রচলন ছিল না, প্রতি ঘরে ঘরে ড্রইং রুম বা বৈঠকখানা ছিল না তখন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, বিদেশী মুসাফির, অসহায়, ভিক্ষুক এমনকি লজিং মাস্টারকেও কাচারী ঘরে থাকতে দেয়া হতো। সম্ভ্রান্ত গৃহস্থরা ভিক্ষুক মুসাফির যারাই কাচারীতে আশ্রয় নিতেন তাদেরকে মেহমানের আদরে ভূষিত করতেন এবং তাদের সাথে একসাথেই খাওয়া-দাওয়াকে অপমানের কিছু মনে না করে মেহমানদারীকে বরং গর্বের মনে করতেন। ঘটনাক্রমে এক রাতে আমাদের কাচারি ঘরে আশ্রয় নেন একজন ভিক্ষুক। তখন আমরা যুবক। সন্ধ্যা থেকে বাড়ির সকল ছাত্ররা লজিং মাস্টারের নিকট পড়াশোনা শেষ করে রাতে সকলে একসাথে খাওয়া-দাওয়ার পর সমবয়সীরা ভাবলাম ভিক্ষুক চাচাকে নিয়ে একটু মজা করি। তাকে বললাম, চাচা বলেন তো এখন খালে ‘ভাটা’ না ‘জোয়ার’। চাচা বললেন, তোমরা কি বলো? আমরা বললাম, ‘জোয়ার।’ চাচাও বললেন, ‘জোয়ার।’ ফের কিছুক্ষণ পরে একই প্রশ্ন করলাম। চাচা আবার পূর্ববত আমাদেরকেই পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোমরা কি বল? এবার আমরা একটু বুদ্ধি করে বললাম, ‘ভাটা।’ চাচাও উত্তর দিলেন, ‘ভাটা।’ তখন আমাদের বন্ধুরা বললো, এটি কি করে হয় চাচা! আমরা যখন বলি ‘ভাটা’ তখন আপনিও বলেন ‘ভাটা।’ আবার আমরা যখন বলি ‘জোয়ার’ তখন আপনিও বলেন ‘জোয়ার।’ উত্তরে ভিক্ষুক চাচা বলেন, ‘আমি তোমাদের কাচারীতে আশ্রয় নিয়েছি, তোমরাই আমাকে থাকতে এবং খেতে দিয়েছ। তারপর আমি একা বিদেশী আর তোমরা এতোজন এ বাড়ির মালিক। এ অবস্থায় তোমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মরবো নাকি?’ সেরকম ধরে নিলাম ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে সরকার যেহেতু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কাজেই সরকার যা কিছু করে তা মেনে না নিয়ে বা সমর্থন না করে ভিক্ষুক চাচার মতো ‘মরবো নাকি?’
এতোদিন শোনা গেছে চর দখল, বাড়ি দখল এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দ্বারা বিরোধী দলীয় ছাত্রসংগঠনের কর্মীদেরকে উৎখাত করে হল দখলের কথা। এবারকার মহাজোট সরকারের ‘বিলবোর্ড দখল’ পূর্বেকার সকল ধরনের দখলকে হার মানিয়ে পত্রিকার হেডিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আবার এসব দখলদারিত্বের ইতিহাসে আওয়ামী সরকারের জুড়ি মেলা ভার। এতেও আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। তা না করে জনগণের মৌলিক অধিকারে সরকার নিজেই যখন হস্তক্ষেপ করে তখন কোনো বিবেকবান মানুষ তো বসে থাকতে পারে না। তাই বিষয়টি নিয়ে দু’চারটি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। রাজধানীজুড়ে সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ড ছাড়া যেন আর কোন প্রচারণা নেই। অন্য পণ্য ও সেবার কোন কথা নেই। এ প্রসঙ্গে টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেতের ভিডিও ক্যাসেটে প্রচারিত একটি নাটকের কথা মনে পড়ছে। উক্ত নাটকের নায়ক মানসিক রোগী। তিনি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তার উপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রূঢ় বাস্তবতার শিকারের বর্ণনা দিয়ে জানতে চান ‘ডাক্তার সাহেব আমাকে কি আপনার কাছে পাগল মনে হয়? যদি না হয় তাহলে আমি যে পাগল নই তার একটি সার্টিফিকেট আমাকে দিন। আমি সেটি গলায় ঝুলিয়ে রাখবো। যাতে সবাই আমাকে দেখে বুঝতে পারবে আমি পাগল নই, ভালো মানুষ।’ উপরোক্ত ডায়ালগটি হানিফ সংকেতের একটি রম্য নাটকের। দেশের উন্নয়ন মানুষ সাধারণ জীবন-যাপনে টের পাবে না। বিলবোর্ড টাঙিয়ে উন্নয়নের চিত্র প্রদর্শন করতে হবে জনসমক্ষে। সরকারের সম্মানিত নীতি-নির্ধারকদের এ আইডিয়াটা নিছক মন্দ নয়! তবে বাস্তবে কোনো দেশের উন্নয়নের চিত্র বিজ্ঞাপনে বিলবোর্ডের মাধ্যমে প্রচারের ঘটনা ঐ রম্য নাটককেও হার মানায়।
বিলবোর্ডে এই প্রচারের সমালোচনা করে বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, দেড় কোটি মিটারের ব্যানারে আওয়ামী লীগের দেড় কোটি ভোট কমবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্ম ও দুর্গন্ধ ঢাকার জন্য ব্যানার ছাপানো হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিক হত্যাকা- ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলী গুম, হেফাযতকে নির্যাতন, জিএসপি স্থগিত, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা, ডেসটিনির কেলেঙ্কারি এবং ইসিকে আজ্ঞাবহে পরিণতের যে ঘটনা ঘটেছে সেসব কথা ব্যানারে ছিল না। এসব যদি লেখা হয় তাহলে দেড় কোটি মিটারে নয় দেড় লাখ কোটি মিটার ব্যানার লিখেও শেষ করা যাবে না। সরকার যতই নতুন বিলবোর্ড লাগিয়ে উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, জনগণ তদের প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশবাসী জানে সরকার গত সাড়ে চার বছরে একটি নির্বাচনী ওয়াদাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তারা যদি এতই উন্নয়ন করে থাকে তাহলে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দিতে আপত্তি কোথায়? গত চার বছরে দেশের কোনো উন্নয়ন আওয়ামী লীগ করতে পারেনি এখন তারা বিলবোর্ড দিয়ে বলছে, সমস্ত দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। সাড়ে চার বছরে সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার চিত্র জনগণ দেখেছে। তারা কোনো উন্নয়ন করেনি। এখন বিলবোর্ডের মাধ্যমে মেকি উন্নয়নের ঢোল বাজাচ্ছে।
বিলবোর্ডের ব্যাপারে সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া : উন্নয়নের প্রচার দলীয় উদ্যোগে কি না এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘এই সমস্ত কাজ তো মূলত দলীয় উদ্যোগেই হয়ে থাকে। আমি এ বিষয়ে এর বেশি কিছু জানি না এবং বলতেও চাচ্ছি না। বেশি কিছু জানতে হলে আমাদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। পত্রিকার প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে অনেকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ‘এই বিলবোর্ডগুলো সরকারি উদ্যোগেও হতে পারে আবার দলীয়ভাবেও হতে পারে। এ বিষয়ে আমি ঠিক ভালো জানি না। এখন এমনও হতে পারে দল নতুন উদ্যমে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে।’ প্রচারণার বিষয়ে মুখ খোলেননি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। আমি এখন চুপ আছি। আমার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘সরকারি নয়, এটা দলীয় উদ্যোগেই হচ্ছে। রাজধানীসহ পর্যায়ক্রমে সারাদেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে। ভোটারদের সরকারের উন্নয়ন স্মরণ করিয়ে দিতেই এই উদ্যোগ। অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণা দুর্বল, সেই ঘাটতি পূরণ করতেই এ উদ্যোগ।’ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগ বা দলীয় উদ্যোগ অথবা অতি উৎসাহী কারো উদ্যোগে হতে পারে। বিলবোর্ডে প্রচারিত তথ্যগুলো সত্য কি না? যদি সত্য হয়ে থাকে তা নিয়ে কাজ করুন।’ স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব উন্নয়ন কাজের কথা জনগণকে জানাতে চায়। এজন্যই বিলবোর্ডের মাধ্যমে এটা প্রচার করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতে উন্নয়নের প্রচারে যে বিলবোর্ড রয়েছে তা সরকারের।’
বিলবোর্ড নিয়ে সরকারের এ মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় একটি কৌতুক না বলে পারছি না। একটি বাসে পাশাপাশি বসে যাচ্ছিলেন এক ধূমপায়ী এবং আরেক অধূমপায়ী যাত্রী। একটু পরেই ধূমপায়ী যাত্রীটি একটি সিগারেট ধরিয়ে আয়েসে টানছে। অধূমপায়ী যাত্রীটির এতে অসুবিধা হওয়ায় বাসের ডান পাশের একটি লেখা দেখিয়ে ধূমপায়ী যাত্রীটিকে বললেন- এই যে ভাই! দেখতে পাচ্ছেন না, লেখা আছে, ‘বাসের মধ্যে ধূমপান নিষেধ।’ ধূমপায়ী যাত্রীটিও ছাড়ার পাত্র নয়। সে আবার বাম পাশের আরেকটি লেখা দেখিয়ে বললেন- আপনি দেখতে পাচ্ছেন না! লেখা আছে, ‘কোনো অভিযোগ থাকলে চালককে জানান।’ অগত্যা অধূমপায়ী যাত্রীটি বহু কষ্টে পেছন থেকে ভিড় ঠেলে ঠেলে সামনে গিয়ে চালককে অভিযোগ করতেই চালক তার সামনে উপরের লেখাটি দেখিয়ে বললেন- এই যে ভাই! দেখতে পাচ্ছেন না, উপরে লেখা আছে, ‘চলন্ত গাড়ীতে চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ।’ অগত্যা অধূমপায়ী যাত্রীটি আর কি করবে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে আবার পেছনে নিজের সীটের কাছে এসে দেখে সীটটি বেদখল হয়ে গেছে। রাগে ক্ষোভে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে- ‘অভিযোগে তো কোনো কাজই হলো না বরং অভিযোগ দিতে গিয়ে সিটটি হারালাম।’ এ সরকারের অধীনে আমাদের অবস্থাও তদ্রƒপ।
বিগত আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে জাতিকে উপহার দিয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এবং ‘দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের’ খেতাব। তবে বর্তমান মহাজোট সরকার আরেকটু আগে বাড়িয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল, বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, সাংবাদিক হত্যাকা- ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলী গুম, হেফাজতে ইসলামের পীর-মাশায়েখ এবং নিরীহ-নিরপরাধ তলেবুল এলেমদের উপর নির্যাতন, জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স) স্থগিত, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা, ইসিকে আজ্ঞাবহে পরিণত করে ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্ন দেখছে যা পূর্বেকার আওয়ামী সকল সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনকে হার মানিয়েছে। এরপরও সরকারের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ বলছেন এ সরকারের আমলেই নাকি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে এবং এ সরকারের আমলেই নাকি সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, যদি তাই হয় তাহলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে সরকারের এতো ভয় কেন?
উন্নয়নের বিলবোর্ডও এ সরকারের আরেকটি নাটক। নাটক প্রেম, ট্র্যাজেডি, হাস্যরস নিয়েই বেশি হয়। কিন্তু এখন নাটক হচ্ছে রাজনীতি নিয়ে প্রতিপক্ষ হননের জন্য। কাউকে নিধন, কারো নিবন্ধন বাতিল নির্মূল বা ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য যখন একপাশে রাজনীতি আর অন্যপাশে ক্ষমতার খেলা চলতে থাকে তখনই আঁচ পাওয়া যায় পুরো রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চটির। মানুষ এখন হিংসা ও প্রতিপক্ষ হননের রাজনৈতিক নাট্যকলা দেখতে দেখতে আতঙ্কিত, শিহরিত এবং ভীত-সন্ত্রস্ত। বাস্তব জীবনের রাজনীতির মাঠ-ময়দানে প্রতিনিয়ত নানা প্রহসনকে নাটকের ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’ হিসেবে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে উদ্ভাবন করেন জার্মান পরিচালক এরভিন পিসকাটর, যাকে বলা হয় আধুনিক নাট্যগুরু বের্টোল্ট ব্রেশট-এর পূর্বসূরী। রাজনৈতিক নাট্যধারায় পিসকাটর, গাসবারা, লানিয়া ও ব্রেশট মিলে নাট্যরূপ দেন লেভ তলস্তয়ের কালজয়ী নাটক ‘রাসপুটিন’। হিটলার, জার, রাসপুটিন ইত্যাদি বিশ্বনিন্দিত স্বৈরচরিত্র দুনিয়া থেকে মিটে গেলেও ইতিহাসের পাতায় এবং নাটকের মঞ্চে এখনও বিদ্যমান। বিশ্বের যেখানেই স্বৈরশাসনের প্রেতাত্মারা আনাগোনা করে, সেখানেই মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে স্মরণ করে এই ঘৃণিত স্বৈরশাসনের প্রেতাত্মা হিটলার, জার ও রাসপুটিনকে। কিন্তু আমাদের সরকার রাজনৈতিক নাটকে হিটলার, জার ও রাসপুটিনের মতো ভিলেনের ভূমিকাকেই বেশি পছন্দ করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদেরকেও হার মানান। কিন্তু যুগ-যুগান্তরের সমস্ত সিনেমা-নাটকে যে শেষ পর্যন্ত ভিলেনদেরই পরাজয় হয় তা-ই শুধু বুঝতে পারেন না আমাদের সরকারের ভিলেনরূপী নাট্যকাররা। আট দিন পূর্বে যেমন রাতের অন্ধকারে কথিত উন্নয়নের চারশত বাহারী রঙের বেনামী ও বেওয়ারিশ বিলবোর্ড শোভা পেয়েছিল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে তেমনি আট দিনের মাথায় জনরোষ সামাল দিতে না পারায় তা রাতের অন্ধকারেই অপসারিত হয়েছে। এভাবেই সরকারের মেকী উন্নয়নের বিলবোর্ড নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। তবে সামনে আবার রাজনৈতিক মঞ্চে কোন নতুন নাটক মঞ্চস্থ হয় কিনা সে আশংকায় প্রহর গুণছে ভুক্তভোগিরা। দেশের শান্তিকামী বিজ্ঞ মহল আশা করে, আর কোন নতুন নাটক তৈরি না করে ভালোয় ভালোয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই জনগণের শান্তি। বর্তমান মহাজোট সরকারের কাছে দেশের ৯০% জনগণের এটিই একমাত্র প্রত্যাশা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন