শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্যাতন


ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি সাংবাদিক পিটিয়েছেন। এ নিয়ে বেশ বাদ-প্রতিবাদ চলছে। মামলা হয়েছে। রনি এখন জেলখানায়। তবে রনির বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সময়ই বলে দেবে। এ দিকে দিগন্ত টিভি বন্ধ। একই দিনে বন্ধ হলো ইসলামিক টিভি। তার অনেক আগে চ্যানেল ওয়ান। বন্ধ হলো আমার দেশ পত্রিকা। এসব গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। দিগন্ত টিভি বন্ধ হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর সেগুনবাগিচায় একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রুমে বসা ছিলাম। তিনি আমার পরিচিত ১৯৯৩ সাল থেকে। তিনি পিএকে দিয়ে কোম্পানি ফাইলের তালিকা করছিলেন। তখন দেখলাম, দিগন্ত মিডিয়ার নাম আছে। দিগন্ত বন্ধ করা প্রসঙ্গে কথা তুললাম। তিনি প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাগ্নে, আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী তার কথা খুবই গুরুত্বের সাথে শোনেন। ওই মন্ত্রীর দুর্দিনে তিনি সবার আগে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন। বললাম, দিগন্ত টিভি কী দোষ করল যে সরকার বন্ধ করে দিলো? তখন তিনি বললেন, ‘অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে; তবে ইচ্ছা করলেই দেয়া যায় না। তবে এইটুকু জেনে রাখো, এটা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ইচ্ছা করলেই এটা নিয়ে কথা বলতে পারি না।’ চ্যানেল ওয়ান যেদিন বন্ধ ঘোষণা করা হলো, তার আগের রাতে টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ফোন করেন। বললেন, ভাই একটা দুঃসংবাদ আছে। কাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনেই এটা জানানো হবে। তা হচ্ছে, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।’ কিন্তু চ্যানেল ওয়ান যে কারণ দেখিয়ে বন্ধ করা হলো সেটাই কি আসল কারণ? আমার জানা মতে, সেটিও রাজনৈতিক ব্যাপার। আমাদের দেশে রাজনৈতিক কারণে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেই সাংবাদিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ দেশে সাংবাদিক নির্যাতন একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। পত্রিকার সম্পাদককে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এমনটি হয়তো বাংলাদেশে প্রথম। যতটুকু জানা যায়, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, এখনো যে মানসিক নির্যাতন ছলছে, তাতে তিনি কোনো দিন সোজা হয়ে চলতে পারবেন বলে মনে হয় না। গোলাম মাওলা রনি শেষ পর্যন্ত কতটুকু সুবিধা করতে বা লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। সালমান এফ রহমান না হয়ে যদি শুধু সাংবাদিকদের মধ্যে বিষয়টি সীমিত থাকত, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। রনি এর আগেও সাংবাদিকদের ওপর হাত তুলেছেন বলে এখন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু আগে তো রনির বিরুদ্ধে কেউ এতটা সোচ্চার হয়নি। এখানে নিশ্চয়ই অন্য কিছু ফ্যাক্টর। নিজে প্রত্যক্ষ নির্যাতনের শিকার না হলেও পরোক্ষভাবে হয়েছি। তবে প্রতিকার পাইনি। সাগর-রুনি খুন হলো, এক বছর পার হয়ে গেছে। সাংবাদিক সমাজ আন্দোলন করে এখন কান্ত। সাগর-রুনি খুন হওয়ার মাসখানেক পর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সমাবেশ চলছিল। যখন সেদিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখা হয় এক ব্যক্তির সাথে। তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘সমাবেশের দিকে যাচ্ছেন? গিয়ে লাভ কী? বিচার পাবেন না।’ এখন বুঝতে পারছি, তার কথাই সত্য। সাগর-রুনির হত্যার নেপথ্যে এমন কী শক্তি আছে যার কারণে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না? কত সাংবাদিকই তো হত্যা আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কয়টার বিচার হয়? তবে বিচার হতো, যদি সাংবাদিকসমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকতেন। বাংলাদেশে এখন হাজারো সাংবাদিক। শত শত পত্রিকা, ২৪-২৫টির মতো বেসরকারি টিভি চ্যানেল। তার পরও কেন সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নেই? কিছু দিন আগে একটি নাটকীয় ঘটনা দেখলাম। দিগন্ত টিভিসহ যেসব চ্যানেল এবং যেসব পত্রিকা বন্ধ, সেগুলো চালু করার দাবি এবং সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকেরা একটি বিবৃতি দিলেন। তার পরপরই আরেকটি বিবৃতি দেখা গেল দুই-একটি পত্রিকায়; সম্ভবত ২৫ জন ‘সম্পাদকে’র একটি বিবৃতি। এতে যেসব পত্রিকার নাম বা সম্পাদকের নাম দেখলাম, তাদের নামই বা ক’জন জানেন? আমার জানা মতে, এসব পত্রিকা রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে ২০০ টাকা দিয়ে ৫০ বা ১০০ কপি ছাপানো হয়। ৫০ কপি পত্রিকার সম্পাদক দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পাদক বা বিশিষ্ট সাংবাদিকদের বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি দেয়ার সাহস পেলেন কী করে? উত্তরটি খুবই সহজ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ওই বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিবৃতির পর বলেছিলেন, ‘তারা না বুঝে বিবৃতি দিয়েছেন।’ যারা সাংবাদিকতা করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললেন, যাদেরকে এ দেশের কৃতী সন্তান বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন; তারা ‘না বুঝে’ বিবৃতি দিয়েছেনÑ এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাবা-ভাই হারিয়ে কষ্টের মধ্যেই বড় হতে লাগলাম। বিএ শেষ করলাম। তার আগেই সাবেক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকনের বাবা বেনু ভূষণ কর আমাকে একদিন ডেকে এনে বললেন, ‘আর সব ছাইড়া কাজ করো।’ এ কথা বলার দুই দিন পর তিনিই আমাকে চিনিকলে চাকরি দিলেন। তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জের কালিয়াচাপড়া চিনিকলের শ্রমিক লীগ নেতা এবং সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক। আর তার নেতা ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল সাংবাদিক হবো। ঢাকার কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার কিশোরগঞ্জ সংবাদদাতা ছিলাম। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ হয়েছে অনেক দিন হলো। দিগন্ত আর ইসলামিক টিভিও বেশ কিছু দিন আগে বন্ধ হয়েছে। আমার দেশ বন্ধ। মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদে আর চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেহেতু রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করা হয়েছে, আবার চালু হলে রাজনৈতিক বিবেচনায়ই হতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের শেষ সময় এসে যে অবস্থা, তাতে আশা করার মতো কিছু নেই। বাংলাদেশে সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর থেকেই এই অবস্থা চলে আসছে। যারা ক্ষমতায় থেকে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালান তাদের অনেকে রাজনীতিবিদ। তাদের বড় নেতানেত্রী হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যমের বা সাংবাদিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। এর পরও ক্ষমতায় গিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। জনমানুষের অধিকার আদায়ে সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকসমাজ সব সময় অপরিসীম ভূমিকা পালন করে আসছে। মিডিয়া আর সাংবাদিকেরা জাতির ক্রান্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কাছে সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকেরাই যেন প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দেয়। তাদের ব্যর্থতার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হোক, তাদের ভুলত্রুটি সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হোক, তা যেন সহ্যই করতে পারেন না। বাংলাদেশে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অবিলম্বে এর লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন। ক্ষমতাসীনদের হাতেই নির্যাতন বেশি হচ্ছে। সাংবাদিক সমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত। এটা শুধু বাংলাদেশেই কি না, সেটা জানা নেই। রাজনৈতিক দলের বিভক্তির মতো সাংবাদিকসমাজ বিভক্ত হবেন কেন? এটা কি গণতান্ত্রিক দেশে হওয়া উচিত? দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, যদি বাংলাদেশে সাংবাদিকসমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকত, তাহলে কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করার আগে সরকার অনেক ভেবে দেখত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads