বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা যখন বলেন, সরকার এবং সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা কি দেশটাকে নিজেদের তালুক মনে করেন, তখন শুনতে একটু খারাপ লাগে। কারণ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তো দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্যই ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। দেশকে নিজেদের তালুক মনে করে তারা যাচ্ছে তাই কাজ করতে যাবেন কেন? কিন্তু যখন সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা নানা অপকর্মের মাধ্যমে দেশের তালুকদার বনে যায় তখন আবার মনে হয়, শুনতে খারাপ লাগলেও বিরোধীদল কথাটা মিথ্যে বলেনি। এমনি একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে গত ৩০ শে জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়। ‘বিটিআরসির হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের পরিবার’ শিরোনামে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে আটকে রয়েছে বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রায় হাজার কোটি টাকা। বার বার তাগাদা দেয়ার পরও তারা টাকা পরিশোধ করছেন না। টাকা তো দিচ্ছেনই না, সেই সঙ্গে বিটিআরসির দেয়া শর্তও ভঙ্গ করে চলেছেন তারা।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে রাতুল টেলিকমের কাছে পাওনা ৭০ কোটি টাকারও বেশি। এই প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশের মালিক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের মেয়ে সৈয়দা আমরিন রাখী। আরও ২০ শতাংশের মালিক নানকের স্ত্রী সৈয়দা আর্জুমান বানু। গত দুই প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে তারা রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে বিটিআরসিকে কোন টাকা দেয়নি। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের মেয়ের কোম্পানি ক্লাউড টেলের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ভিশন টেল লিমিটেড। গত জুন পর্যন্ত ভিশন টেলের কাছে বিটিআরসির পাওনা ৯০ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি পাওনা রাষ্ট্রীয় টেলিফোন কোম্পানি বিটিসিএল-এর কাছে। তাদের কাছে বকেয়া রয়েছে শত কোটি টাকার ওপরে। বিটিআরসি সূত্রে আরো জানা গেছে, মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুর কোম্পানি ফাস্ট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের কাছে বিটিআরসির পাওনা ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবশ্য কিছু টাকা তারা পরিশোধ করেছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের কোম্পানি টেলেক্স লিমিটেড এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দুই ছেলে ও ছেলের বউদের নামে নেয়া ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সেস গেটওয়ের কাছেও বিটিআরসির পাওনা রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারের শেষ সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া এইসব কোম্পানির মালিক বিটিআরসিকে টাকা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এদিকে নিজের দলের লোকদের কাছে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা বাকি থাকা প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তা করছি, দেখা যাক কি করা যায়।
ইত্তেফাকের রিপোর্টে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের আচরণের যে চিত্র উঠে এলো তাতে মনে হয়, তারা দেশটাকে নিজেদের তালুক বলেই বিবেচনা করে থাকে। এজন্যই হয়তো বারবার তাগাদা দেয়ার পরেও তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির টাকা পরিশোধের গরজ অনুভব করছেন না। এমন অন্যায় কাজ করার সাহস তারা কীভাবে পান? দেশে তো সরকার আছে, আইন আছে, আছে প্রশাসনও। বিরোধী দলের লোকদের ব্যাপারে প্রশাসনকে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলেও সরকারি দলের লোকদের ব্যাপারে প্রশাসন আইন প্রয়োগে থমকে যায় কেন? প্রশাসনের এমন দ্বৈত রূপে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পায়। একই সাথে প্রশাসন ও আইনের প্রতি জনগণ হারায় শ্রদ্ধা। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় তো এই মর্মে শপথ নিয়েছিলেন যে, অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে তারা দেশ শাসন করবেন না। কিন্তু বাস্তব আচরণে তারা সে শপথ ভঙ্গ করছেন। ফলে তাদের সুশাসন ও দিন বদলের স্লোগান দেশে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক দেশে তো আইন সবার জন্য সমভাবে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হচ্ছে না। এ কারণেই হয়তো পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। বিষয়টি সরকার উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন