মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

বিলবোর্ড দখলের কেলেঙ্কারি


ঢাকা মহানগরীর বেশির ভাগ বিলবোর্ড দখল এবং অন্যের পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে নিজেদের সাফল্য প্রচারের যে কৌশল বা ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে তা টক অব দ্য কান্ট্রি পরিণত হয়েছে। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেছেন, এই পদ্ধতিটি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। সরকার কী পরিমাণ উন্নয়ন করেছে সেটা নাকি বিএনপি চোখে দেখে নাÑ সেটা তাদের দেখানো প্রয়োজন, পাশাপাশি জনগণকে জানানো দরকার। পরপর পাঁচ সিটি করপোরেশনে হারার পর তাদের এই বোধোদয় জন্মেছে। একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের একমাত্র ব্যর্থতা পাবলিসিটি। প্রচারই প্রসারতা বাড়ায়।তার পরই ঘটল এই বিলবোর্ড অভ্যুত্থান। এই ঘটনা নিয়ে অনলাইন থেকে পাঠকেরা যে মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন সেটা আরো কৌতূহলোদ্দীপক। তারা বলতে চাইছেন, সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে দখল করা বিলবোর্ডে অপপ্রচারে ভোট আসবে না। বিলবোর্ড ভোট দেয় না, দেন ভোটারেরা। তাদের মাথার ভেতরে অনেক বিলবোর্ড। তাই গোটা দেশকে বিলবোর্ডে মুড়ে দিলেও কোনো ফায়দা হবে না। জনগণের মস্তিষ্কে বিলবোর্ডগুলোতে রয়েছেÑ ক্ষমতার শুরুতে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৭০ জন সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হওয়া, শেয়ারবাজারে ৩৩ লাখ মানুষের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনা, ডেসটিনির প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ৪৮ লাখ ডিস্ট্রিবিউটরের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হওয়া, পদ্মা সেতুর শত শত কোটি টাকার লজ্জাকর কেলেঙ্কারিÑ যা সরকারকে বহির্বিশ্বে দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। আরো আছে, গ্রামীণ ব্যাংককে দখল করার ষড়যন্ত্র, ছাত্র ও যুবলীগের দখল ও টেন্ডারবাজি। চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ জন ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সাগর-রুনিসহ ১৭ জন সাংবাদিককে নির্মমভাবে খুনের ঘটনা, ব্যাংক জালিয়াতি, ফেব্রুয়ারি মাসে শদুয়েক সাধারণ মানুষকে খুনের ঘটনা, ৫ মে হেফাজতের মহাসমাবেশে রাতের অন্ধকারে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে প্রেরণসহ দুই শতাধিক বিয়োগবিধুর ঘটনা জনগণের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এগুলোকে ঢেকে দেয়ার উপায় নেই। পাঠকের মন্তব্যÑ ক্ষমতাসীনেরা সারা বছর অপকর্ম করে শেষ প্রহরে এসে উন্নয়নের চিন্তা মাথায় এলে কোনো কাজ হবে না। বেআইনিভাবে অন্যের ভাড়া করা বিলবোর্ড দখল করে সরকারি দল যেভাবে নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছে, এটা অবৈধ বা বেআইনি কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত হবে না কেন? এই প্রশ্ন গোটা দেশবাসীর। একজন সচেতন পাঠক অনলাইনে লিখেছেনÑ এখন বিলবোর্ড, কিছু দিন পর বাড়ি বাড়ি নোটিশ বোর্ড পাঠাবে সরকারি দলের লোকজন। এত কাজ সরকার করল জনগণের কোনো শোকর নেই। এ জন্যই উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ সময়ে নিজেদের ঢোল নিজেদেরই পেটাতে হচ্ছে। রাজনীতিকদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জনগণও তাদের মতো উটপাখি হয়ে বালুতে মাথা গুঁজে বসে নেই। আরেক পাঠক নিজ মন্তব্য জাতীয় দৈনিকে এভাবে প্রকাশ করেছেনÑ বিলবোর্ড ও হাওয়া ভবনের খরচের উৎস একই প্রকৃতির। আপনারা কী করে ভাবছেন, জনগণ দেশটাকে দুই দলের কাছে ইজারা দিয়েছে? ৭ আগস্ট পত্রিকায় আমরা দেখেছি, দেশের দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার বিলবোর্ড রাতারাতি দখল করল সরকারি দলের লোকজন। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছিল দেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। অথচ এত বড় একটি বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পরও প্রকাশ্যে কেউ দায় স্বীকার করছে না। দেশের বিচার বিভাগ এত বড় একটি জবরদখলের ঘটনায়ও নীরব ভূমিকা পালন করছে, যা বিস্ময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশ আউটডোর অ্যাডভার্টাইজিং এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বিলবোর্ড মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, প্রায় ২০০ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার বিলবোর্ড দখল হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। কারা এই কাজ করেছে, বিলবোর্ডে তার কোনো তথ্য নেই। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একজন সাংবাদিককে বলেছেন, এই প্রচার আমরাই করছি। অর্থাৎ সরকারের সহায়তায় সরকার সমর্থকেরাই এ অন্যায় কাজটি করেছে। সরাসরি সরকারের তরফ থেকে করা হলে বিজ্ঞাপনের নিচে লোগো থাকতÑ এই কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ৭ আগস্ট একটি পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লিখেছেÑ এটা বড় ধরনের একটি ছিনতাই বা জবরদখল। কে ছিনতাই করেছে সরকার না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, তা স্পষ্ট ভাষায় সরকার বা তার দল বলছে না। মিডিয়ার বিভিন্ন তথ্যে বোঝা যাচ্ছে, সরকারের মদদে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই এই জবরদখল করে কথিত উন্নয়নের ফিরিস্তি বর্ণনা করেছে। বিলবোর্ড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাশেদ অভিযোগ করেছেনÑ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন পরিকল্পিতভাবে বিলবোর্ড দখলের এই কাজ করেছে। এই আকস্মিক ও অভিনব তৎপরতা নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি হিসেবে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে লেখা থাকবে। কারণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব বিলবোর্ডের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এ টাকা তারা সিটি করপোরেশনকে দেয়। সিটি করপোরেশন ও বিলবোর্ড ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে চুক্তি রয়েছে, তার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে সরকার বা ক্ষমতাসীন দল ওইসব বিলবোর্ড ছিনতাই করে ফৌজদারি অপরাধ করেছে। মূলত সরকার তার নিজ দায়িত্ব নিজেই লঙ্ঘন করেছে। সরকার যেখানে মানুষের অধিকার রক্ষা করবে, সেখানে সরকারই অন্যের অধিকার হরণ করেছে। এর বিচার কে করবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। আইন যদি নিজস্ব গতিতে চলত তাহলে এর উপযুক্ত একটা সুরাহা হতো। এই জবরদখলের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সোচ্চারভাবে কিছু বলতে সাহস পায়নি। কারণ এমন প্রবল ক্ষমতাধর সরকারকে কে না ভয় পায়? চুলজ্জা বলতে একটি বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেটাও সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা বাতুলতা। সরকার তার নিজের গুণগান যেভাবে যে ভঙ্গিতে করেছেÑ তাতে জনগণের মন জয় করা এবং আসন্ন জাতীয় ১০তম নির্বাচনে জনগণের ভোট নিজেদের অনুকূলে আনা দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। নিজের ঢোল নিজে পেটাতে গেলে লাভ হয় নাÑ উল্টো এটা বুমেরাং হতে পারে সরকারি দলের জন্য। এমন একটি অন্যায় কাজ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অর্থাৎ অপরের বিলবোর্ড দখল করাÑ সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনারেরও বড় ভূমিকা নেয়া উচিত ছিল। কারণ এতে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন মুছে দেয়ার ফলে তারা যে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং নতুন করে বিজ্ঞাপন প্রতিস্থাপন করতে তাদের যে অর্থ ব্যয় করতে হবে, সেই বাবদ তাদের সব ক্ষতিপূরণ সরকারের দেয়া উচিত। ১৩ আগস্ট পত্রিকায় দেখলামÑ প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড থেকে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিজ্ঞাপন অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জানান, সাত দিনের জন্য এই বিলবোর্ডগুলো ভাড়া নিয়েছিল সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে ভাড়া পরিশোধ করা হবে। ১২ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এজেন্ডাবহির্ভূত আলোচনায় বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় এ ব্যাপারে সমালোচনা হচ্ছে। এ কারণে এগুলো অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে তাদের অর্জন নিজ উদ্যোগে দেশব্যাপী প্রচার-প্রচারণার নির্দেশ দেন। জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সরকারের পৌনে পাঁচ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরতে তিনি নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুই-এক দিনের মধ্যেই বিভাগীয় শহরগুলোয় বিলবোর্ডে প্রচার শুরু হবে। ১৩ আগস্টের একটি জাতীয় দৈনিকে দেখেছিÑ বনানী মোড়ের একটি বিলবোর্ড থেকে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পাশের ফিরিস্তিটি অক্ষত আছে। অর্থাৎ দখল করা বিলবোর্ড থেকে নামিয়ে ফেলা হলেও খালি জায়গার বিলবোর্ড যথাস্থানেই রয়েছে। নগরীতে কিছু বিলবোর্ডে এখনো সরকারের বিজ্ঞাপন আছে (১৪-৮-১৩)। ওই মন্ত্রিসভায় দুজন মন্ত্রী বিলবোর্ডে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচারণাকে যথার্থ বলে বক্তব্য রাখেন। তারা বলেছেন, সমালোচনার ভয়ে বিলবোর্ড থেকে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিজ্ঞাপন নামানো উচিত হবে না। যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা সঠিক। জনগণের এসব বিষয় জানা দরকার। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে সরকার নিজের গুণগান এভাবে বিলবোর্ড দখল করে করার কোনো নজির আছে কি না জানা নেই। এটা একটি বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় অপচয়। ইসলাম ধর্মেই বর্ণিত আছে, অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। অপচয় সেটা রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগতÑ দুটি অপচয়ই দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে। অপচয়কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। রোজার পবিত্র মাসে সরকার যেভাবে কোটি কোটি টাকা বিলবোর্ডের পেছনে অযথা খরচ করেছেÑ সেটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তারই অপছন্দনীয়। এটা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি আবার খাটো করল। সরকারের উচিত জাতির কাছে নিজের ভুল স্বীকার এবং স্রষ্টার কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। সরকারের উচিত, সহিংসতা পরিহার করে দশম জাতীয় নির্বাচন কিভাবে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে করা যায় তার চিন্তাভাবনা করা। সরকারি ও বিরোধী দল জাতীয় স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সংলাপে বসে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করেÑ তার প্রচেষ্টা চালানো।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads