আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি গত ২৫ জুলাই ভারত সফরে গিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তিনি অনেকবার ভারত সফর করেছেন এবং এ সফরসহ তিনি মোট ১১৫ বার বিদেশ সফরে গিয়েছেন। তার এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি করা, যাতে বাংলাদেশ তিস্তা নদী হতে ন্যায্য পানি পায়। ডা. দিপু মনি এই বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর সাথে বৈঠক করেছেন। আবার ভারতের বিরোধীদলীয় নেতার সাথেও বৈঠক করেছেন । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তিস্তায় পানি দিতে ভারতীয় পক্ষ কোন আশ্বাস দেয়নি এবং চুক্তির ব্যাপারেও কোন আগ্রহ দেখায়নি। স্বয়ং ভারতীয় পত্রিকাসমূহই রিপোর্ট করেছেÑ ডা. দিপু মনি ভারত থেকে খালি হাতে ফেরত গেছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শুনতে শুনতে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষের পথে, কিন্তু এখনো এই বিষয়ে ন্যূনতম অগ্রগতিও হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তিস্তা চুক্তি হবে কবে? বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অকৃত্রিম বন্ধু বলে পরিচিত ভারত রাষ্ট্রটি যখন আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালেও বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিল না, তিস্তার পানি দিতে আগ্রহ দেখাল না এবং তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি করার কোন কমিটমেন্ট করল না, তখন দেশবাসীর মনে এই ধারণাই সৃষ্টি হয় যে, ভারত আর তিস্তার পানি নিয়ে কোন চুক্তি করবে না। কারণ ভারত আওয়ামী লীগের বন্ধু এবং শুভাকাক্সক্ষী হলেও, বাংলাদেশের আপামর জনগণের বন্ধু এবং শুভাকাক্সক্ষী নয়। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে কাজ করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমর্থনের কথা ভারত বার বার ঘোষণা করলেও, তিস্তার পানি দেয়ার কথা ঘোষণা করতে একবারও রাজি নয়। আর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কলকাতায় বসে বসে কবির সুমন একের পর এক গান লিখলেও, তিস্তার পানি বঞ্চিত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের হাজারো মানুষের জন্য কবির সাহেব কোন গান লিখেন নাই। আওয়ামী লীগ সরকারের এই মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, তার ছেলে রাহুল গান্ধীসহ ভারতের শীর্ষ সব নেতাই বাংলাদেশে এসেছেন। একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও ভারত সফর করেছেন। উভয় দেশের নেতাদের মধ্যে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতাদেরকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভালোবাসার হালহকিকত বুঝতে হবে। তা না হলে ভারতকে ভালোবেসে সব উজাড় করে দেয়া যাবে, কিন্তু ভারতের ভালোবাসাও পাওয়া যাবে না , ভারত থেকে ভালোবাসার প্রতিদানও পাওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগ বরাবরই ভারতবান্ধব বলে পরিচিত। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক গরম হয়ে ওঠে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের দহরম মহরম শুরু হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সফর যেমন বেড়ে যায়, তেমনি ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সফরও তেমন বেড়ে যায়। শুরু হয় দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের দৌড়-ঝাঁপ এবং বন্ধুত্বের কথামালা। আরও শুরু হয় বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। মনে হয় এবার বুঝি বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়ার সবই ভারত দিয়ে দিবে। কিন্তু সময় শেষে দেখা যায় ভারত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি, বরং বাংলাদেশ থেকে ভারত সবই নিয়ে গেছে। তবু আমাদের আক্কেল হয়নি। আমরা ভারতকে সব দিয়ে এখন বেকুবের মতো পাওয়ার আশায় বসে আছি। ভারত যে মুলা আমাদেরকে দেখিয়ে চলছে, সেই মুলাটি পাওয়ার আশায় আমরা ঐতিহাসিক সেই গাধার মতো একান্ত অনুগত হয়ে এখনো ভারতের সব ক’টি চাওয়া পূরণ করেই চলছি। আওয়ামী লীগ সরকারের এমন ভারতপ্রীতি এবং ভারতের প্রতি এমন আনুগত্য দেখে ভারতীয়রাও আজ মুচকি হাসে। ভারতের রাষ্ট্রপতি জনাব প্রণব মুখার্জি যিনি একজন বাঙালি এবং বাঙালি পরিচয় দিতে যিনি গর্ববোধ করেন, যার আদি পুরুষের জন্মস্থান বাংলাদেশে আর বাংলাদেশ সফরে এসে যিনি নিজেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলে পরিচয় দেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন, সেই মান্যবর প্রণব মুখার্জিও কিন্তু তার বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য পানি দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেননি। অপরদিকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের মাননীয় প্রেসিডেন্ট জনাব প্রণব মুখার্জিকে তার পারিবারিক বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করলেও, সেই পারিবারিক বন্ধু হতে এখনো তিনি দেশের জন্য তিস্তার পানি আনতে পারেনি। অথচ তিস্তার পানি আমাদের প্রতি ভারতের দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং তিস্তার পানি হচ্ছে আমাদের আইনগত এবং ন্যায্য অধিকার। কারণ তিস্তা ভারত এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি আন্তর্জাতিক নদী, যার ওপর প্রতিটি দেশের অধিকার রয়েছে। আর বন্ধু যখন তার বন্ধুকে ন্যায্য অধিকারও দেয় না, তখন সাহায্য এবং সহযোগিতার হাত কতটুকু বাড়বে তাতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের কাছে সহজেই অনুমেয় ।
ভারতের মতো বাংলাদেশও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সহযোগিতা করেছিল। বিনিময়ে ভারত চায় বাংলাদেশ তার আনুগত্য করুক এবং ভারতের চাওয়াগুলো পূরণ করুক। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সহযোগিতার পেছনে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তার ভালোবাসা কাজ করেনি। কাজ করেছে শত্রুকে দুর্বল করার নীতি। রাজনীতির সেই ঐতিহাসিক সমীকরণ, যেখানে বলা আছে শত্রুর শত্রু বন্ধু, সেই সমীকরণের বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। চির শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখ-িত করার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বেকুব লোক অন্ততপক্ষে ভারতীয়রা নেতারা নন। আর তাই বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতার জন্য ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও, কাশ্মীর, পাঞ্জাব আর আসামের মানুষদের স্বাধীনতার জন্য ভারতের কোন সহযোগিতা নেই বরং সেই সব অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের ওপর ভারত চালাচ্ছে ভয়াবহ দমন-নির্যাতন। রাজনীতির এই সমীকরণ আজ আমাদেরকে বুঝতে হবে, না হলে অঙ্ক বরাবরই ভুল হবে। আর তাই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা ট্রানজিটের বিনিমিয়ে ভারতের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলার আয় এবং বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর স্বপ্ন দেখালেও, বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারত থেকে বিলিয়ন ডলারও আয় হয়নি, দেশটাও সিঙ্গাপুর হয়নি। বরং ভারতীয় ট্রাকের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে এদেশের রাস্তাঘাটে বিরাট বিরাট গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। আর ভারতীয় পণ্য পরিবহনের স্বার্থে তিতাস নদীর বুকে জেগে ওঠেছিল বিশাল একটি রাস্তা, যার ফলে তিতাস হারিয়েছিল তার সৌন্দর্য এবং নাব্যতা। তাই দেশ প্রেমিক জনগণ ভারতের কল্যাণে এখন আর সিঙ্গাপুর হবার স্বপ্ন দেখে না, বরং সিকিমের মতো স্বাধীনতা হারিয়ে পরাধীন হবার আতঙ্কে উদ্বিগ্ন ।
বাংলাদেশের চারদিকেই ভারত। ভারত দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট চাচ্ছে, চট্টগ্রাম এবং মংলাবন্দর ব্যবহার করতে চাচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যে সহজে মালামাল পরিবহন করা। কিন্তু ভারত যেটা চাচ্ছে সেটা কোন ট্রানজিট নয় বরং করিডোর। কারণ এ ক্ষেত্রে ভারত থেকে যাত্রা শুরু হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আবার ভারতে ঢুকবে। এরশাদ এবং বিএনপি সরকার ভারতকে এই করিডোর সুবিধা না দিলেও, আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই ভারতকে করিডোর সুবিধা দিতে আগ্রহী। অথচ এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। কিন্তু অওয়ামী লীগ সরকারের সে দিকে কোন খেয়াল নেই। ভারতের চাওয়া-পাওয়া সব বিনা শর্তে পূরণ করে চলেছে। ভারতের চাহিদা অনুসারে আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। ভারতকে তার চাওয়ার সবই দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভারত কিছুই দিচ্ছে না। ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে পানিতে মারছে, তিস্তার পানি দিচ্ছে না, চুক্তিও করছে না। নির্মাণ করছে টিপাইমুখ বাঁধ। সীমান্তে বিএসএফ প্রায়ই এদেশের নিরীহ মানুষদেরকে পাখির মতো গুলী করে হত্যা করছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন করছে কোন ফি ছাড়াই। ভারতের প্রতিটি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের আকাশে উন্মুক্ত হলেও , বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলও ভারতের আকাশে উন্মুক্ত নয়। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। টেলিফোন, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, গাড়ি সবই এখন ভারতীয়দের কব্জায় চলে যাচ্ছে। সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে, যার ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোন ধরনের লিখিত চুক্তি ছাড়াই ভারত নারায়ণগঞ্জে কন্টেইনার পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ইতোমধ্যেই ভারত সরকার দরপত্র ও আহ্বান করেছে। কিন্তু সরকারের এদিকে কোন খেয়াল নেই। এসব আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফসল। মূলত পক্ষে ভারতের একের পর এক দাবিসমূহ আওয়ামী লীগ সরকার পূর্ণ করায়, ভারতের কোন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি বর্তমান সরকার হারিয়ে ফেলেছে। আর ভারতের কাছ থেকে কিছু আদায় করার শক্তিও সরকার হারিয়ে ফেলেছে অর্থাৎ দরকষাকষির টেবিলে সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই ভারতকে সব দিয়েও, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকারও আদায় করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে কোন চুক্তি করার ক্ষেত্রে ভারত সরকার সে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। বিরোধী দলের অমতে গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নেয় না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরোধিতার মুখে তিস্তা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পিছু হটার কথা সবারই জানা। কিন্তু ট্রানজিটের নামে ভারতকে করিডোর প্রদানের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও আমাদের সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোর সাথে কোন আলোচনা করেনি, করার প্রয়োজনীয়তাও মনে করেনি। অধিকন্তু এর সমালোচনাকারীদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করতে পিছপা হয়নি। আর তিস্তার পানি যে বাংলাদেশকে দিবে না তা ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্মকা-ে প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ তিস্তার উজানে ভারত ইতোমধ্যেই একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার ফলে এই প্রকল্পসমূহ চালু না রেখে বাংলাদেশকে ভারত পানি দিবে, এটা কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ কথাটি সত্য বলেই ভারতের বন্ধু হয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনিকে এবারো ভারত থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। ফলে তিস্তা চুক্তি ও হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা নেই । দরকষাকষির টেবিলে আগে সব দিয়ে দিলে পরে যে কিছুই আদায় করা যায় না, তা আবারো প্রমাণিত হল। এতকিছুর পরও আশার কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগের এই ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আপামর জনতা আজ জেগে ওঠেছে ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন