সিরাজুর রহমান
ছোটবেলায়
গোপাল ভাঁড়ের গল্পে পড়েছিলাম : গোমূর্খ জামাই শ্বশুরবাড়ি গেছে। সে বাড়িতে
পণ্ডিত লোকদের আনাগোনা। সে ধরনেরই কয়েকজন আসবেন শুনে জামাই খাটের নিচে লুকিয়ে
রইল। পণ্ডিতেরা প্রচুর অনুস্বার আর বিসর্গ ব্যবহার করে সংস্কৃত ভাষায় আলাপ
করছিলেন। শুনে শুনে জামাইয়ের সাহস হলো। খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে সদর্পে ঘোষণা
করল : ‘অনুস্বার আর বিসর্গ যদি
সংস্কৃত হয়ং, তবে কেন আমি খাটের নিচে রয়ং?’ বাংলাদেশের অস্তগামী সরকার আর শাসকদলের হয়েছে সে অবস্থা। বিলবোর্ড
পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করে থাকে। সরকারের কিংবা দলের কোনো অতি উৎসাহী সে কথা
শুনেছেন। দেশী ও বিদেশী মিডিয়া (ভারতীয় মিডিয়াসহ) প্রায় একবাক্যে বলছে, সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায় কিংবা তলানিতে ঠেকেছে। এই
মূল্যায়নে সর্বশেষ যোগ দিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী পত্রিকা লন্ডনের
ফিন্যানসিয়াল টাইমস। এ দিকে, একের পর এক
সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি হয়েছে। ভরাডুবি এড়ানোর লক্ষ্যে
রাজধানীর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পৌনে পাঁচ বছর ধরে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু
তা-ই নয়, রাজধানীকে কেটে দুই টুকরো
করেছে এই সরকার। তাদের মাথায় এসেছে, বিলবোর্ড
টাঙালে পণ্য বিক্রি বাড়ে। সুতরাং বিলবোর্ড দিয়ে গোটা রাজধানী মুড়ে দিলেই এ
সরকারের সাফল্য নামক বস্তাপচা মালটা নিয়েও কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। বিজ্ঞাপন
কোম্পানিগুলোর বিলবোর্ড জবরদখল করে তার ওপর সরকারের ‘সাফল্যের’ বিবরণ লেপ্টে দেয়া হয়েছে।
এই অপকর্ম পরের সম্পত্তি গ্রাস করে নেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। কোম্পানিগুলোর যে
ক্ষতি হচ্ছে সেটা চিন্তা করার মতো মনের সুস্থতা নেই সরকারের। কারণ তারা চিন্তা করে
পেশি শক্তি দিয়ে। গায়ের জোরে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি কেড়ে নেয়ার
নজির আগেও দেখা গেছে হিটলারের জার্মানিতে এবং স্ট্যালিনের রাশিয়ায়। আরো বহু
প্রশ্ন ওঠে এ ব্যাপারে। বাড়াবাড়ি প্রায় সব সময়ই উল্টো ফল দেয়। সুখাদ্য
স্বাস্থ্যকর কিন্তু অতিভোজনে বদহজম হবেই। গোটা রাজধানী মুড়ে নিñিদ্র বিলবোর্ড হাটভর্তি জনতার সমবেত চিৎকারের মতোই দুর্বোধ্য হতে
বাধ্য। কোনো সন্দেহ নেই, জনসাধারণ বিলবোর্ডের সয়লাবে
বিরক্ত ও ুব্ধ। সরব প্রশ্ন উঠছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রচারে এই বিলবোর্ডগুলো
টাঙাতে যে ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, সেটা কি
রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে এসেছে? অন্যকে বলছেন, পৌনে পাঁচ বছর যে লাখ লাখ কোটি টাকা চুরি ও লুটপাট করা হয়েছে তার
অতি সামান্য অংশই ব্যয় হয়েছে এসব বিলবোর্ডে। গিল্ড করা হয় ধাতুর ওপর, কয়লার কিংবা মাটির ওপর গিল্ড হয় না। ইমেজ (ভাবমূর্তি) উন্নত করতে
হলে কিছু ভাব এবং কিছু মূর্তি থাকতেই হবে। সরকারের ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা
যেখানে মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, সেখানে
বিলবোর্ড দিয়ে লাভ হবে না, বরং লোকসান হতে বাধ্য।
অবিভক্ত ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পাকিস্তানে ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান তার সরকারের
নিঃশেষিত জনপ্রিয়তা তুলে ধরার জন্য ভাড়া করা লেখককে (আলতাফ গওহর) দিয়ে বিরাট বই
লিখিয়েছিলেন ফ্রেন্ডস, নট মাস্টার্স নামে। ডিকেড অব
প্রোগ্রেস নামে আরেকখানি বিরাট বই প্রকাশ করা হয়েছিল। ভাড়া করা লেখকদের দিয়ে
পত্রপত্রিকায় বহু কলাম লিখিয়েছিল সরকার। কিন্তু কী লাভ হয়েছে তাতে? কোথায় এখন আইয়ুব খান, কোথায় তার
ভাবমূর্তি? প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সুদীর্ঘ
তালিকা বিলবোর্ডের আবর্জনা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে; এমনকি আওয়ামী লীগের ভেতরেও। নেতারা বলছেন, বিএনপি তাদের সরকারের সাফল্য দেখতে পায় না, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে, সাফল্যগুলো
দেখিয়ে দেবার জন্যই এত বিলবোর্ডের আয়োজন। অর্থাৎ কেউ যদি তোমার গুণকীর্তন না করে, তাহলে মাথায় মুগুর মেরে তার কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করো। আওয়ামী
লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ নিজেকে বুদ্ধিমান ও রসিক মনে
করেন। তিনি অনুরূপভাবে বিলবোর্ড টাঙানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপিকেও। ভাবখানা এই, বিলবোর্ড টাঙিয়ে আমরা ডুবতে বসেছি,
তোমরা ডাঙায় দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে কেন, ঝাঁপ দিয়ে পানিতে নামো। মনে করে নিন, একটা বিলবোর্ডের স্থান রয়েছে বিএনপির জন্য। তাতে সরকারের
ব্যর্থতার তালিকায় কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেত? এক নম্বরে অবশ্যই লিখতে হতো, ২০০৮ সালে
নির্বাচনের আগে ‘যে-যা চাও চেয়ে চেয়ে নাও’ গোছের নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করেছিল আওয়ামী লীগ, তাদের নেত্রী আরো এগিয়ে মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়ার এবং এক কথায় দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট
সমাধান করে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দলের কিংবা নেত্রীর প্রতিশ্রুতিগুলো
পূরণ করা হয়নি। রোজই যখন অত্যন্ত অসুবিধাজনক সময়ে হঠাৎ লোডশেডিং হয়, গ্যাসের অভাবে রান্না করতে গিয়ে গিন্নিদের নাকের জল চোখের জল
একাকার হয়, বাজারে গিয়ে চাল-ডাল কিংবা
মসলা কিনতে কর্তাকে পাঁচবার ভাবতে হয়, তখন বাংলাদেশের
মানুষের সে প্রতিশ্রুতিগুলোর কথা মনে পড়ে, তারা
প্রতিশ্রুতিদাতাদের মুণ্ডুপাত করে। মন্ত্রীদের সম্পদের তালিকা কোথায়? শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,
মন্ত্রী ও সংসদসদস্যদের সম্পত্তি ও সম্পদের বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ
করা হবে। পরে থুড়ি খেয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তার পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী ঘোষিত হয়েছে, মন্ত্রীরা সম্পদের বিবরণ জমা
দেবেন শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তবে সে বিবরণ প্রকাশ করা হবে না। ব্যাপকভাবে
সন্দেহ করা হয়, সেসব তালিকাকে ব্ল্যাকমেইলের
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের আনুগত্য ধরে
রাখা হয়েছে। কেউ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সমর্থন না করলে কিংবা সামান্যতম সমালোচনা
করলে তার দুর্নীতির বিবরণ প্রকাশ করে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খতম করে দেয়া হবে।
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতি আর খুনখারাবির
মামলা বিচারাধীন ছিল। স্বয়ং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাশিয়া থেকে মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান
আর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কোনো প্রকার অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ফ্রিগেট ক্রয়
বাবদ মোটা কমিশন নেয়াসহ পাঁচটি দুর্নীতির মামলা ছিল বিচারাধীন। কিন্তু ক্ষমতা
পেয়ে প্রথমেই আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের অধীনে একটি কমিটি
করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোসহ সোয়া সাত হাজার মামলা তুলে
নেয়া হয়। পেছনের সারির উকিলের কলমের আঁচড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সব অপরাধ
ধুয়েমুছে দেয়া হয়। এভাবে তারা আবার কেঁচেগণ্ডুষের মতো নতুন করে দুর্নীতিতে
ঝাঁপিয়ে পড়ার লাইসেন্স পেলেন। আর সে কী ঝাঁপিয়ে পড়া! বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে
ভর্তি, ছাত্রাবাসে স্থান,
সরকারি কাজের টেন্ডার, টোল তোলা ও
চাঁদাবাজি এমনকি রেল ও অন্যান্য বিভাগে নিয়োগ ইত্যাদি ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী
লীগের শাখা-প্রশাখাগুলোর নিয়মিত বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এ বাণিজ্যগুলো এতই লাভজনক
যে, এর বখরা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংস্থাগুলোতে
মারামারি ও খুনোখুনি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের আগে যারা
আওয়ামী লীগকে ‘দাদন’ (আগাম মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান) দিয়েছিলেন, শেয়ারবাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়ে
প্রথম চোটেই চক্রবৃদ্ধি হারের সুদে সেই দাদন আদায় করে নেয়ার সুযোগ তাদের দেয়া
হলো। শেয়ারবাজারে দেশের ৩৫ লাখ মধ্যবিত্তের লগ্নি মুহূর্তের মধ্যে লোপাট হয়ে
গেল। তাদের পোষ্য সোয়া কোটি-দেড় কোটি মানুষ রাতারাতি সর্বহারা হয়ে গেল। স্টক
এক্সচেঞ্জের সামনে প্রতিবাদ করে তারা প্রতিকার পাননি, বরং পুলিশের লাঠি ও গুলির ঘায়ে তারা রক্তাক্ত হয়েছেন, টিয়ার গ্যাসের শিকার হয়ে অনেকের ফুসফুস বরাবরের মতো ঘায়েল
হয়েছে। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন। আত্মীয়-বন্ধুদের বড়লোক বানানোর কলকাঠি
মন্ত্রিসভা ও শাসকদলে সরকারের শীর্ষব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন আছেন অনেক। ভবিষ্যতে
ভোট ক্রয় ও পেশি শক্তি ভাড়া করে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তাদের বিপুল অর্থের
প্রয়োজন। আগামী নির্বাচনে জয়ের চেষ্টাতেই ভোট ক্রয়, পেশি শক্তি ভাড়া করা ইত্যাদিতেও কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে
আওয়ামী লীগকে। পাইকারি হারে বিলবোর্ড লাগানো বাবদ ৬০ কোটি টাকা ব্যয় ুদ্র একটি
দৃষ্টান্ত মাত্র। অতএব বিনা টেন্ডারে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়ার নামে ২০ হাজার
কোটি টাকা পাইয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। ডেসটিনি ও হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে
ব্যাংকগুলোতে সাধারণ মানুষের আমানত, আরো কয়েক
হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। হলমার্কই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুই হাজার
কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ইচ্ছা নেই
তাদের। শুনেছি, হলমার্কের শীর্ষব্যক্তির সাথে
বিলেত প্রবাসী আওয়ামী লীগের এক শীর্ষনেত্রীর বন্ধুত্ব আছে। বিনা টেন্ডারে এক
মার্কিন তেল কোম্পানিকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের লাইসেন্স পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে
কমিশন পেয়েছিলেনÑ এই মর্মে খবর প্রকাশের দরুন
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মন্দভাগ্যের সূচনা হয়। জেলখানা থেকে
মাহমুদুর রহমানকে কতবার যে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে,
তার হিসাব হারিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশে বর্তমানে রিমান্ডের অর্থ
সরকারের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির গায়ের ঝাল মেটানোর জন্য র্যাব ও পুলিশের অমানুষিক
দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতন করেই সরকারের আক্রোশ হালকা
হয়নি; আমার দেশ পত্রিকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা না
হলেও যাতে সে পত্রিকা ছাপা সম্ভব না হয় তার সব ব্যবস্থা করেছে সরকার। দুর্নীতির
রাজা-বাদশাহ বর্তমান সরকারের দুর্নীতির রাজা-বাদশাহ দেখা গেছে পদ্মা সেতু
নির্মাণের ব্যাপারে। সেতুর নীলনকশা পাকা হয়ে গিয়েছিল। অর্থায়নেরও ব্যবস্থা হয়ে
গিয়েছিল। সব কিছু ভালোয় ভালোয় গেলে এত দিনে ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সেতুটি তৈরি
হয়ে যেত, দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ
অঞ্চলের সাথে অন্যান্য এলাকার চলাচল ও পরিবহন দ্রুতগতি হতো। কিন্তু সেতু তৈরির
ঠিকাদার নির্বাচন বাবদ ৩৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে বলে
খবর পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক (প্রস্তাবিত সেতুর প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান) দুর্নীতিবাজদের
শাস্তি দাবি করে। বিশ্বব্যাংক বলে যে, অন্যথায় তারা
সেতু তৈরির টাকা দেবে না। বিশ্বব্যাংক এই দুর্নীতিতে লিপ্ত ব্যক্তিদের তালিকাও
দিয়েছিল সরকারকে। কিন্তু সরকারের হুকুমের মুখাপেক্ষী দুর্নীতি দমন কমিশন গোড়ায়
নানা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করছিল। শেষে বিশ্বব্যাংকের দেয়া
ব্যক্তিদের নামের তালিকা নিয়েও তারা দরকষাকষি শুরু করে। সরকারের নির্দেশে, দুদক কিছুতেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে
তদন্ত কিংবা মামলা করতে রাজি হয়নি। অথচ তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের তালিকায় এক
নম্বর দাগি ব্যক্তি। তাতে সবারই ধারণা হয়েছে যে,
তিনি দুর্নীতি করেছিলেন প্রক্সিতে,
অন্য কারো তরফে। সেই ‘অন্য কারো’ পরিচয় জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়েই সরকার সর্বপ্রযতেœ আবুল হোসেনকে রক্ষা করছে। বিশ্বব্যাংকের তাগিদে কানাডা সরকার সে
দেশের এসসি লাভালিন কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। কানাডার পুলিশ সে
কোম্পানির দু’জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত
করেছে। কানাডায় ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ক’জন বাংলাদেশীর
বিরুদ্ধেও তদন্ত করছে কানাডার পুলিশ। সরকার এখন বলছে, আরো একবার তাদের গদি দেয়া হলে তারা পদ্মা সেতু তৈরি করে ফেলবে।
অর্থাৎ অতল সমুদ্রের মতো গভীর চুরি আর পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার জন্য তার পুরস্কার
চায় দেশবাসীর কাছে। কিন্তু একবার যারা চোর এবং ব্যর্থ ও অকর্মণ্য প্রমাণিত হয়, মানুষ কখনো তাদের বিশ্বাস করতে পারে না। নির্যাতন, গুম-খুন চুরির পরেই এই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকায় থাকতে
বাধ্য অত্যাচার-নির্যাতন, গুম ও খুনখারাবি। সরকারের
সশস্ত্র ক্যাডার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি অঙ্গসংগঠনগুলো এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাবের
লোকেরা বেছে বেছে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের খুন করেছে। র্যাবের হাতে
কয়েক শ’ মানুষ খুন হয়েছে। গত
ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত খুন হয়েছে ১২০ জন। ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত এই ব্যাপক হত্যার সমালোচনা করেছে বিশ্বের সব ক’টি প্রধান মানবাধিকার সংস্থা এবং সরকার। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক
ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক গুম হয়েছেন গত বছরের এপ্রিল মাসে। সরকার আজ পর্যন্ত
তাদের সম্পর্কে কোনো খবর দেয়নি। এই ব্যর্থতার প্রতিবাদে সিলেটের মানুষ এবারে ঈদের
দিনে আনন্দের পরিবর্তে অনশন করেছেন। বাকশাল করার আগে সরকারি মালিকানাধীন চারটি
পত্রিকা রেখে অন্য সব পত্রপত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের
মিডিয়ার গলা টিপে মারার পদ্ধতি ভিন্ন রকম, তবে একই
লক্ষ্যে পরিচালিত। সরকার বেছে বেছে কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বরাদ্দ করেছে। প্রায় সব পত্রিকাই পরিচালনা করছেন
সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ব্যবসায়ী পরিবার ও গোষ্ঠীগুলো। টকশোতে কাকে আমন্ত্রণ করা
যাবে কিংবা পত্রিকায় কার লেখা কলাম প্রকাশ করা যাবে, সে সম্পর্কে নির্দেশ যায় এসব মিডিয়া গ্রুপের কাছে। সরকারের যারা
সমালোচনা করে তাদের মুণ্ডুপাত করার জন্য সরকার সব সময়ই খড়গহস্ত। গণমাধ্যমের
গণহত্যা দুর্নীতির খবর প্রকাশের দায়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রথমবার
জেলে গিয়েছিলেন। সরকারের ইচ্ছা পূরণ করে আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড
দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে রেখেছিল নয় মাসেরও বেশি।
বর্তমান দফায় তার ওপর নির্যাতন চলছে এ কারণে যে,
তিনি তার পত্রিকায় ফাঁস করে দিয়েছিলেন, শাহবাগে যে মঞ্চ স্থাপিত হয় সেটা সরকারই করিয়েছিল কিছু
ধর্মদ্রোহী ব্লগার দিয়ে। অনেক দিন তিনি নিরাপত্তার খাতিরে আমার দেশ পত্রিকায়
অফিসবন্দী ছিলেন। পরে হিটলারের এসএস বাহিনীর কায়দায় কমান্ডো স্টাইলে তাকে অফিস
থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাতেও সরকারের আক্রোশ মেটেনি। আমার দেশ পত্রিকার
ছাপাখানা গালা-মোহর করে বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার বলছে তারা এ পত্রিকা নিষিদ্ধ
করেনি। কিন্তু বিকল্প কোনো ছাপাখানা থেকে যাতে আমার দেশ ছাপা হতে না পারে, তার সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে সরকার। গত ৫ মে শাপলা চত্বরে কারো
কারো মতে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক হয়েছিল। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া এই
জনসমুদ্রের খবর ব্ল্যাক-আউট করেছিল। দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন এই
ঐতিহাসিক সমাবেশের বিবরণ প্রচার করেছিল বলে চ্যানেল দু’টি তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সরকারের আমলে সরকারের
সমালোচক বেশ ক’জন সাংবাদিককে খুন করা
হয়েছে। রুনি আর সাগরের খুনিদের গ্রেফতার করতে দেয়নি প্রশাসন। নির্যাতিত হয়েছেন
আরো অনেকে। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা এখন গভীর আতঙ্কে আছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার
পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ বিশ্বজনীন। লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, নিউ ইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মানবাধিকার সম্পর্কে মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকার পর্যালোচনা ইত্যাদি
বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত উদ্বেগ জানাচ্ছে এ বিষয়ে। এবারে বাংলাদেশ সরকার
দেশের মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর ওপরই হাত দিয়েছে। এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গত ১০ আগস্ট
রাতে গুলশানে তার বাড়ির সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশ। মানবাধিকার
সংস্থাটির ওপর এ সরকার মহা খ্যাপা। গত ৬ মে ভোর রাতে শাপলা চত্বরে ঘুমিয়ে থাকা
হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ সমর্থকের ওপর পাইকারি গুলিবর্ষণ চালিয়ে বহু লোক হত্যা
করা হয়েছে। সে রাতের ঘটনার বহু ভিডিওচিত্র আমি নিজেও দেখেছি। সরকারের সমর্থক একটি
পত্রিকা পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছিল, সে রাতে এক লাখ
৫২ হাজার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার তখন নীরব ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে তারা এখন
বলছে, সে রাতে পুলিশ মোটেও গুলি চালায়নি। প্রধানমন্ত্রী
এই বলে সারা দুনিয়ার মানুষ হাসিয়েছেন যে, মানুষগুলো
জামাকাপড়ে লাল রঙ লাগিয়ে শাপলা চত্বরে শুয়েছিল। ‘অধিকার’ ৬১ জন লোকের নাম-ঠিকানা-পরিচয় প্রকাশ করে অভিযোগ করেছে যে, অন্তত এই লোকগুলো খুন হয়েছিল সে রাতে। সরকারের বুজরুকি তাতে ফাঁস
হয়ে গিয়েছিল। অনেক উপমা, অনেক প্রবাদ আছে বাংলা ভাষায়, যা দিয়ে এই সরকারের শেষ সময়ের এসব কার্যকলাপের বর্ণনা দেয়া
যায়। ‘নেভার আগে প্রদীপের দপ দপ করে
জ্বলা’, ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে’, ‘মারণকামড়’Ñ এগুলো হচ্ছে মাত্র কয়েকটি।
ওরা বুঝতে পারছে না, এসব অমানুষিক কার্যকলাপ দিয়ে
ওরা দেশের মানুষের ক্রোধের অনলে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মাত্র। তারা অত্যাচার করবে আর
কোনো দিন দেশের মানুষ কিছু করবেন না, এটা ধরে নিয়ে
সরকার মারাত্মক ভুল করছে। সরকার ভুলে যাচ্ছে আমাদের কবির কথা : ‘ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে, মোদের বাঁধন
টুটবে’।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন