আমরা রাজনীতিকরা যা নিয়েই আলোচনা করি ও কথা বলি না কেন- তা গিয়ে এক জায়গাতেই দাঁড়ায়, আর সেটি হলো দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে আমাদের রাজনীতি। রাজনীতিকদের কাজ যেহেতু দেশ ও দেশের মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত, সেই জন্য আমরা এসব বিষয় নিয়ে সবসময় চিন্তা-ভাবনা করি। স্বাভাবিকভাবেই একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমিও সবার মতোই অনেক আগে থেকেই দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় ভাবি।
আমি কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলে, কেবল দেশ ও মানুষকে নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবো। কারণ আমাদের দেশটি আয়তনে ছোট হলেও ১৬ কোটি মানুষের দেশ। জনসংখ্যার বিষয়টি অনেক বড় একটি চিন্তার কারণ। কাজেই এ দেশটি নিয়ে যখন ভাবতে হয়, তখন এত বেশি জনসংখ্যার দেশের পরিকল্পনাও হতে হয় অনেক বড় ও ভিশনারি। তাই এ বিষয়ে সংক্ষেপে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরতে চাই। আমার বিশ্বাস, আমার এই চিন্তাধারার সঙ্গে আপনারাও একমত হবেন।
আমাদের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কি শুধু ক্ষমতায় যাওয়া? না, মূল উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতায়ন নয়। সেটি আমাদের রাজনীতির কেবল একটি অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নও কিন্তু এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে-বিদেশে যারা আমরা বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবি, আমাদের ধর্ম, বিশ্বাস, মত কিংবা আদর্শ ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু দেশ তো আমাদের সবার। আমরা সবাই এদেশকে ভালবাসি। আর তাই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে, একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। এই অগ্রযাত্রায় গতি হতে হবে দ্রুত। লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। অতীতমুখী নয়, আমাদের চেতনা ও দায়বদ্ধতা হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। গতানুগতিক রাষ্ট্র পরিচালনার ধারায় অভ্যস্ত থাকলে কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হবে না। আমাদের উৎসাহ দিতে হবে আধুনিকতাকে, বরণ করে নিতে হবে অভিনবত্বকে। সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আমাদের আলিঙ্গন করতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনকে, যার আবর্তন রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বিবর্তন জনগণের সমস্যার সমাধান।
আমি এখানে খুব সংক্ষেপে দেশের গঠন-উন্নয়নে কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরতে চাই।
ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই জেনেছি, দেখেছি বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। আসুন, আমরা এই কৃষি নিয়ে প্রথমে কথা বলি। কৃষি নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে দেশ এবং মানুষ বাঁচানোর পূর্বশর্ত কৃষির মানোন্নয়ন ও কৃষকের জীবন উন্নয়ন। অতীত ও বর্তমানের মতো আমাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধিরও মূল ভিত্তি হতে যাচ্ছে কৃষি। যাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে তথা কৃষি ও কৃষককে বাঁচানোর তাগিদে নতুন কিছু ভাবা ও নতুন কিছু করা আজ সময়ের দাবি। কৃষি ক্ষেত্রে করণীয়কে আমরা ছয়টি মৌলিক বিষয়ে ভাগ করতে পারি।
এক. কৃষির প্রয়োজনীয় মূলধনকে কৃষকের কাছে সহজলভ্য করে তোলা প্রয়োজন। কৃষি ব্যাংক হচ্ছে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান। তাই কৃষি ব্যাংকের কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ঋণ প্রস্তাবনায় বৈচিত্র্য এনে এগুলোকে সময়োপযোগী এবং বাস্তবমুখী করা জরুরি। কৃষি ভর্তুকির সর্বোচ্চ উপযোগিতা নিশ্চিত হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দুই. কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রধান তিন ধরনের উপাদান, যথা: চারা ও বীজ, সার ও কীটনাশক এবং যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি, এগুলোর আমদানি ও বিতরণ পরিকাঠামো পরিবিন্যাস করা।
তিন. দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে কৃষকদেরকে কম দামে ফসল বিক্রয় করতে হয়। সেই একই ফসল ভোক্তারা চরম মূল্যে ক্রয় করে। এই অবস্থা নিরসন করতে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি- যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফসলের মূল্য নির্ধারণ করবে। এক একটি কৃষিপণ্যের মোট উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে লাভে বিক্রির জন্য কৃষকের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। এই লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য কৃষিনির্ভর দেশের মতোই আমাদের দেশেও একটি স্বাধীন কৃষিবান্ধব মূল্য নির্ধারণ কমিশন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
চার. দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু ও সুষম বিতরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে একদিকে কৃষকদের কাছে ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় করা এবং আরেকদিকে ক্রয়কৃত পণ্যের অনেকাংশ জনগোষ্ঠীর মাঝে কমমূল্যে বা বিনা মূল্যে নিয়মতান্ত্রিক ও পরিকল্পিতভাবে বিতরণ বা বিক্রয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে, অন্যদিকে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
পাঁচ. কৃষি সংক্রান্ত সকল ডাটা ও তথ্য যেন একসঙ্গে পাওয়া যায়, সেসব তথ্যের বিশ্লেষণের লক্ষ্যে একটি কৃষি তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই তথ্য ভাণ্ডারের উদ্দেশ্য হবে দেশের সার্বিক কৃষি পরিস্থিতির চিত্র এক স্থানে ধারণ করা, দেশের কোন অঞ্চলে, কোন মওসুমে কোন ফসল, কোন হারে, কত খরচে উৎপাদিত হয়; তা জেনে সেই আলোকে কৃষি পণ্যের উৎপাদন পরিকল্পনা করা হবে একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। তাই তথ্য ভাণ্ডার নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়টি মূল বিষয় থাকতে পারে- ১. কৃষিপণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্য, ২. কৃষি উপকরণ, ৩. সার ও কীটনাশক, ৪. অঞ্চলভিত্তিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, ৫. অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা, ৬. হিমাগার ও সংরক্ষণাগার, ৭. কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, ৮. কৃষিপণ্যের পরিবহন, এবং ৯. আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বা রপ্তানির সুযোগ।
ছয়. আমাদের দেশে কৃষি বলতে সাধারণত শুধু সমতলভূমির কৃষিকে বোঝানো হয়। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ি ভূমিকে যদি কৃষির মূল পরিকাঠামোর মধ্যে আনা যায়, তাহলে দেশের কৃষির উৎপাদন ও ফসলের বৈচিত্র্য শুধু বাড়বে না, বরং স্থানীয় চাহিদা পূরণ-পূর্বক বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর শিক্ষা সম্পর্কে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করতে চাই। একটি শিক্ষিত জাতি একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। উন্নয়ন ও প্রগতির লক্ষ্যে আমাদের যত উদ্যোগ সেগুলোর দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতার পূর্বশর্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত শিক্ষানীতি। আর তা সম্ভব হবে যদি আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী ও ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলতে পারি। এ জন্য একজন শিক্ষিত বাংলাদেশীকে গড়ে তুলতে হবে একজন মূল্যবান বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। এ জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বাংলাদেশীরা যেন সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তৃতীয় এমনকি চতুর্থ ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, আরবি, জার্মানসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা প্রয়োজন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। এই উদ্যোগের ফলে বিশ্বের মেধা দরবারে ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ নতুন মাত্রা পাবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি বেগবান হবে। চলমান বাণিজ্য পরিকাঠামোর মাধ্যমেই কেবল পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের রেমিটেন্সকে ১৪ মিলিয়ন থেকে ২০ মিলিয়নে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের অপশন খুবই সীমিত অবস্থায় রয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন এনে সিস্টেমকে আরও সমপ্রসারিত করা এবং পাঠক্রমে আরও নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, পার্সোনাল ও প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি বিষয় যদি সংযোজন করা হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের প্র্যাকটিক্যালি সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে, উৎকর্ষের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি সহযোগিতা করবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। অ্যাসেসমেন্টের জন্য লিখিত পরীক্ষায় পুরো মার্ক না রেখে আমরা এক-তৃতীয়াংশ মার্ক গ্রুপ ডিসকাশন, প্রেজেন্টেশন ও ক্লাস পরীক্ষার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি। এর মধ্য দিয়েই শুধু পরীক্ষায় ভাল ফল করার উদ্দেশ্যেই পড়াশোনার যে সংস্কৃতি রয়েছে, তাতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সংস্কারের মাধ্যমে মেধা তালিকায় শীর্ষ পর্যায়কে প্রকৃত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অবস্থানটি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে করা দরকার কর্মমুখী তথা রিয়াল লাইফ বা জব ওরিয়েন্টেড। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষয় ভিত্তিক জেনারেলাইজেশন করার ফলে শিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান হারের যে সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভুগছি- তা অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করে তার আওতায় দেশব্যাপী সাবজেক্ট, এরিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগ দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, যাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম গঠিত ও পরিচালিত হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন: এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স ইত্যাদি শিক্ষার্থীরা বিষয় অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে নানা মেয়াদে কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক চাহিদা এবং বাংলাদেশের শিল্প পরিস্থিতি বিবেচনায় আবর্তিত হবে। প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেট পেয়ে সরাসরি চাকরি জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। এই উদ্যোগ দু’টি প্রধান ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।
প্রথমত, দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি কর্মক্ষম বেকার রয়েছে। এ সংখ্যা ইনশাআল্লাহ কোটির নিচে নেমে আসবে এবং কর্মজীবী বাংলাদেশীদের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি থেকে আট কোটিতে উন্নীত হবে। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা শতকরা ৩১ ভাগ থেকে ১০ ভাগের নিচে নেমে আসবে।
একটি দেশের উন্নতির জন্য শিল্পায়ন খুবই জরুরি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর উৎকর্র্ষ সাধনের মূলে ছিল শিল্প।
চলবে
আমি কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলে, কেবল দেশ ও মানুষকে নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবো। কারণ আমাদের দেশটি আয়তনে ছোট হলেও ১৬ কোটি মানুষের দেশ। জনসংখ্যার বিষয়টি অনেক বড় একটি চিন্তার কারণ। কাজেই এ দেশটি নিয়ে যখন ভাবতে হয়, তখন এত বেশি জনসংখ্যার দেশের পরিকল্পনাও হতে হয় অনেক বড় ও ভিশনারি। তাই এ বিষয়ে সংক্ষেপে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরতে চাই। আমার বিশ্বাস, আমার এই চিন্তাধারার সঙ্গে আপনারাও একমত হবেন।
আমাদের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কি শুধু ক্ষমতায় যাওয়া? না, মূল উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতায়ন নয়। সেটি আমাদের রাজনীতির কেবল একটি অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নও কিন্তু এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে-বিদেশে যারা আমরা বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবি, আমাদের ধর্ম, বিশ্বাস, মত কিংবা আদর্শ ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু দেশ তো আমাদের সবার। আমরা সবাই এদেশকে ভালবাসি। আর তাই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে, একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। এই অগ্রযাত্রায় গতি হতে হবে দ্রুত। লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। অতীতমুখী নয়, আমাদের চেতনা ও দায়বদ্ধতা হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। গতানুগতিক রাষ্ট্র পরিচালনার ধারায় অভ্যস্ত থাকলে কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হবে না। আমাদের উৎসাহ দিতে হবে আধুনিকতাকে, বরণ করে নিতে হবে অভিনবত্বকে। সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আমাদের আলিঙ্গন করতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনকে, যার আবর্তন রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বিবর্তন জনগণের সমস্যার সমাধান।
আমি এখানে খুব সংক্ষেপে দেশের গঠন-উন্নয়নে কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরতে চাই।
ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই জেনেছি, দেখেছি বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। আসুন, আমরা এই কৃষি নিয়ে প্রথমে কথা বলি। কৃষি নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে দেশ এবং মানুষ বাঁচানোর পূর্বশর্ত কৃষির মানোন্নয়ন ও কৃষকের জীবন উন্নয়ন। অতীত ও বর্তমানের মতো আমাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধিরও মূল ভিত্তি হতে যাচ্ছে কৃষি। যাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে তথা কৃষি ও কৃষককে বাঁচানোর তাগিদে নতুন কিছু ভাবা ও নতুন কিছু করা আজ সময়ের দাবি। কৃষি ক্ষেত্রে করণীয়কে আমরা ছয়টি মৌলিক বিষয়ে ভাগ করতে পারি।
এক. কৃষির প্রয়োজনীয় মূলধনকে কৃষকের কাছে সহজলভ্য করে তোলা প্রয়োজন। কৃষি ব্যাংক হচ্ছে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান। তাই কৃষি ব্যাংকের কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ঋণ প্রস্তাবনায় বৈচিত্র্য এনে এগুলোকে সময়োপযোগী এবং বাস্তবমুখী করা জরুরি। কৃষি ভর্তুকির সর্বোচ্চ উপযোগিতা নিশ্চিত হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দুই. কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রধান তিন ধরনের উপাদান, যথা: চারা ও বীজ, সার ও কীটনাশক এবং যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি, এগুলোর আমদানি ও বিতরণ পরিকাঠামো পরিবিন্যাস করা।
তিন. দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে কৃষকদেরকে কম দামে ফসল বিক্রয় করতে হয়। সেই একই ফসল ভোক্তারা চরম মূল্যে ক্রয় করে। এই অবস্থা নিরসন করতে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি- যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফসলের মূল্য নির্ধারণ করবে। এক একটি কৃষিপণ্যের মোট উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে লাভে বিক্রির জন্য কৃষকের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। এই লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য কৃষিনির্ভর দেশের মতোই আমাদের দেশেও একটি স্বাধীন কৃষিবান্ধব মূল্য নির্ধারণ কমিশন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
চার. দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু ও সুষম বিতরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে একদিকে কৃষকদের কাছে ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় করা এবং আরেকদিকে ক্রয়কৃত পণ্যের অনেকাংশ জনগোষ্ঠীর মাঝে কমমূল্যে বা বিনা মূল্যে নিয়মতান্ত্রিক ও পরিকল্পিতভাবে বিতরণ বা বিক্রয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে, অন্যদিকে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
পাঁচ. কৃষি সংক্রান্ত সকল ডাটা ও তথ্য যেন একসঙ্গে পাওয়া যায়, সেসব তথ্যের বিশ্লেষণের লক্ষ্যে একটি কৃষি তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই তথ্য ভাণ্ডারের উদ্দেশ্য হবে দেশের সার্বিক কৃষি পরিস্থিতির চিত্র এক স্থানে ধারণ করা, দেশের কোন অঞ্চলে, কোন মওসুমে কোন ফসল, কোন হারে, কত খরচে উৎপাদিত হয়; তা জেনে সেই আলোকে কৃষি পণ্যের উৎপাদন পরিকল্পনা করা হবে একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। তাই তথ্য ভাণ্ডার নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়টি মূল বিষয় থাকতে পারে- ১. কৃষিপণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্য, ২. কৃষি উপকরণ, ৩. সার ও কীটনাশক, ৪. অঞ্চলভিত্তিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, ৫. অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা, ৬. হিমাগার ও সংরক্ষণাগার, ৭. কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, ৮. কৃষিপণ্যের পরিবহন, এবং ৯. আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বা রপ্তানির সুযোগ।
ছয়. আমাদের দেশে কৃষি বলতে সাধারণত শুধু সমতলভূমির কৃষিকে বোঝানো হয়। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ি ভূমিকে যদি কৃষির মূল পরিকাঠামোর মধ্যে আনা যায়, তাহলে দেশের কৃষির উৎপাদন ও ফসলের বৈচিত্র্য শুধু বাড়বে না, বরং স্থানীয় চাহিদা পূরণ-পূর্বক বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর শিক্ষা সম্পর্কে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করতে চাই। একটি শিক্ষিত জাতি একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। উন্নয়ন ও প্রগতির লক্ষ্যে আমাদের যত উদ্যোগ সেগুলোর দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতার পূর্বশর্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত শিক্ষানীতি। আর তা সম্ভব হবে যদি আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী ও ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলতে পারি। এ জন্য একজন শিক্ষিত বাংলাদেশীকে গড়ে তুলতে হবে একজন মূল্যবান বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। এ জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বাংলাদেশীরা যেন সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তৃতীয় এমনকি চতুর্থ ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, আরবি, জার্মানসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা প্রয়োজন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। এই উদ্যোগের ফলে বিশ্বের মেধা দরবারে ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ নতুন মাত্রা পাবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি বেগবান হবে। চলমান বাণিজ্য পরিকাঠামোর মাধ্যমেই কেবল পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের রেমিটেন্সকে ১৪ মিলিয়ন থেকে ২০ মিলিয়নে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের অপশন খুবই সীমিত অবস্থায় রয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন এনে সিস্টেমকে আরও সমপ্রসারিত করা এবং পাঠক্রমে আরও নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, পার্সোনাল ও প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি বিষয় যদি সংযোজন করা হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের প্র্যাকটিক্যালি সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে, উৎকর্ষের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি সহযোগিতা করবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। অ্যাসেসমেন্টের জন্য লিখিত পরীক্ষায় পুরো মার্ক না রেখে আমরা এক-তৃতীয়াংশ মার্ক গ্রুপ ডিসকাশন, প্রেজেন্টেশন ও ক্লাস পরীক্ষার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি। এর মধ্য দিয়েই শুধু পরীক্ষায় ভাল ফল করার উদ্দেশ্যেই পড়াশোনার যে সংস্কৃতি রয়েছে, তাতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সংস্কারের মাধ্যমে মেধা তালিকায় শীর্ষ পর্যায়কে প্রকৃত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অবস্থানটি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে করা দরকার কর্মমুখী তথা রিয়াল লাইফ বা জব ওরিয়েন্টেড। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষয় ভিত্তিক জেনারেলাইজেশন করার ফলে শিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান হারের যে সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভুগছি- তা অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করে তার আওতায় দেশব্যাপী সাবজেক্ট, এরিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগ দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, যাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম গঠিত ও পরিচালিত হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন: এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স ইত্যাদি শিক্ষার্থীরা বিষয় অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে নানা মেয়াদে কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক চাহিদা এবং বাংলাদেশের শিল্প পরিস্থিতি বিবেচনায় আবর্তিত হবে। প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেট পেয়ে সরাসরি চাকরি জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। এই উদ্যোগ দু’টি প্রধান ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।
প্রথমত, দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি কর্মক্ষম বেকার রয়েছে। এ সংখ্যা ইনশাআল্লাহ কোটির নিচে নেমে আসবে এবং কর্মজীবী বাংলাদেশীদের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি থেকে আট কোটিতে উন্নীত হবে। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা শতকরা ৩১ ভাগ থেকে ১০ ভাগের নিচে নেমে আসবে।
একটি দেশের উন্নতির জন্য শিল্পায়ন খুবই জরুরি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর উৎকর্র্ষ সাধনের মূলে ছিল শিল্প।
চলবে
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন